সংকট বাড়ছে সেন্ট মার্টিনে, ঈদ আনন্দের বদলে দুশ্চিন্তা
বাংলাদেশ

সংকট বাড়ছে সেন্ট মার্টিনে, ঈদ আনন্দের বদলে দুশ্চিন্তা

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনীর মধ্যে এখনও সংঘাত চলছে। এই সংঘাতে মিয়ানমার সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের দিকে ছোড়া হচ্ছে গুলি। এ কারণে গত সাত দিন প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে নৌ চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে দ্বীপের প্রায় ১০ হাজার মানুষ খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অভাবে সংকটে পড়েছে। ফলে কোরবানির ঈদ উদযাপনের বদলে সংকট নেমে এসেছে সেন্ট মার্টিনবাসীর মাঝে।

বৃহস্পতিবার (১৩ জনু) দুপুরে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ থেকে বঙ্গোপসাগর দিয়ে আটকে পড়া ৬০০ নারী-পুরুষ-শিশু দুটি দ্বীপে পারাপার হয়েছে। নাফ নদে নৌরুটে যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বিকল্প রুট হিসেবে ঝুঁকি নিয়ে পার হয়েছে তারা। এর আগে চিকিৎসাসহ কোরবানির ঈদে কেনাকাটা করতে এসে টেকনাফে আটকে পড়েছিল ৩০০ মানুষ।

তবে বিকাল ৫টার দিকে ট্রলারে করে টেকনাফে আটকা থাকা ৩০০ জন সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ফিরে গেছে। সাগর উত্তাল থাকায় সবাই প্রচণ্ড ভয়ের মধ্যে ছিলেন। ঝুঁকি নিয়েই তারা ট্রলারে উঠে বসে।

সরেজমিনে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভে মুন্ডার ডেইল ঘাটে সেন্ট মার্টিন যেতে শত শত মানুষ সৈকতে ভিড় করে। যারা মিয়ানমারের গুলিবর্ষণের কারণে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন রুট বন্ধ থাকায় আটকা পড়েছিল। সকালে তিনটি ট্রলারে করে শাহপরীর দ্বীপে আটকে থাকা ৩০০ মানুষ টেকনাফে এসেছে। পরে এসব ট্রলারে করে টেকনাফে আটকা থাকা ৩০০ জন সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ফিরে গেছে।

সেন্ট মার্টিন থেকে ট্রলারে টেকনাফে ফিরে আসা চাকরিজীবী ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘আমি একটি রিসোর্টের কাজে সেন্ট মার্টিন গিয়েছিলাম। ১০ থেকে ১২ দিন ধরে দ্বীপে খাবার নেই। সেখানে খাবারের জন্য হাহাকার করছে দ্বীপের মানুষ। সেন্ট মার্টিনে এমন একটি জায়গা, যেখানে বাহিরে থেকে খাদ্য গেলে খাবারের ব্যবস্থা হয়। চাল ছাড়া কিছু নেই। প্রশাসন ব্যবস্থা না নিলে খাদ্যাভাবে মানুষ কষ্ট পাবে। অনেক কষ্ট করে টেকনাফ এসেছি।’

টেকনাফের মেরিন ড্রাইভে মুন্ডার ডেইল সৈকতে দিয়ে ট্রলারে ওঠার আগে কথা হয় সেন্ট মার্টিন পূর্ব পাড়ার বাসিন্দা ফেরদৌসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১৭ দিন আগে চট্টগ্রামে চিকিৎসা নিতে এসেছিলাম। কিন্তু নাফ নদে মিয়ানমারের গুলিবর্ষণের কারণে সেন্ট মার্টিনে যেতে না পেরে এখানে আটকা আছি। ছেলে-মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে আছি। তা ছাড়া সাগরের ঢেউ দেখে ভয় পাচ্ছি কীভাবে যাবো। তবু কোরবানি ঈদে বাড়ি না ফিরে উপায় নেই।’

পরে আজ বিকাল ৫টার দিকে ট্রলারে উঠে বাকিদের সঙ্গে সেন্ট মার্টিন রওনা দেন ফেরদৌস।

আরেক নারী আফরোজা আক্তার স্বপ্না বলেন, ‘সকাল থেকে সেন্টমার্টিন যেতে টেকনাফ সৈকতে অপেক্ষা করছি। কিন্তু সাগরের অবস্থা দেখে এখন ভয় পাচ্ছি। এত লোকজন এখানে কীভাবে থাকবো। তা ছাড়া আমাদের হাতে টাকাও শেষ হয়ে গেছে। কোরবানি ঈদ আনন্দে কেনাকাটা করতে টেকনাফ এসেছি। কিন্তু আনন্দের বদলে বেদনা নিয়ে ফিরতে হচ্ছে। সাগর উত্তাল থাকায় ভয় পাচ্ছি। তবু ছোট ডিঙি নৌকায় সাগরে বড় ট্রলারে উঠিয়ে দেবে, সেখান থেকে দ্বীপে রওনা দেবো।’

উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে পারাপার হচ্ছে নারী-শিশু-পুরুষ

জানতে চাইলে সেন্ট মার্টিন বোট-মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদ বলেন, ‘নাফ নদে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌরুটে মিয়ানমারের গুলিবর্ষণের কারণে সাত দিন ধরে এ রুট বন্ধ ছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালে তিনটি ট্রলারে করে দ্বীপে আটকে পড়া ৩০০ মানুষ দ্বীপ থেকে টেকনাফে ফিরেছে। এ ছাড়া টেকনাফ যেসব মানুষ আটকা আছে, তারা এসব ট্রলারে করে সেন্ট মার্টিনে রওনা দিয়েছে। তবে সাগর উত্তাল থাকায় খুব চিন্তা হচ্ছে।

গতকাল বুধবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া মর্টার শেল ও গুলির বিকট শব্দ টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে শোনা গেছে বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত। এ ছাড়া শাহপরীর দ্বীপে গোলারচরের নাফ নদের ওপারে মাঝপথে সে দেশের জলে মর্টার শেল বিস্ফোরিত হয়েছে।

শাহপরীর দ্বীপে জেটিতে থাকা স্থানীয় মোহাম্মদ নোমান বলেন, ‘দুপুরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরের জলসীমায় নাফ নদে মর্টার শেল বিস্ফোরিত হয়ে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। এ সময় বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে শাহপরীর দ্বীপ। এরপরই ওপারের তুমুল সংঘর্ষে গুলাগুলির শব্দও শোনা যায়। এতে সীমান্তে বসবাসকারীরা আতঙ্কে রয়েছে।’

শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে গোলার বিকট শব্দের বিষয়টি স্বীকার করে টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপে ইউপি সদস্য আবদুস বলেন, ‘সীমান্তে রাতে খুব বেশি গুলির শব্দ শোনা গেছে। এখানে নাফ নদ থাকায় আমরা গোলার শব্দ শুনলেও ঠিক ওপারে কোন এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে, সেটা বলা মুশকিল। বিকাল পর্যন্ত ওপারের গোলার শব্দ পাওয়া গেছে। কিন্তু রাতে এত বিকট আওয়াজ ছিল যে ঘুমাতে পারিনি।’

শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘রাতে মিয়ানমারের গোলার এত বিকট শব্দে কোনোভাবে ঘুমাতে পারেনি। এমনকি সকালে বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত ওপার থেকে ভারী গোলার শব্দ এপারে পাওয়া গেছে। এসব নিয়ে সীমান্তের মানুষ ভয়ভীতির মধ্য রয়েছে। ঈদের আনন্দের সময় মানুষের মাঝে ভয় ও চিন্তা নেমে এসেছে।’

বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে শাহপরীর দ্বীপ, আতঙ্কে দ্বীপবাসী

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ‘গেলো কয়েক দিন ধরে সেন্ট মার্টিন এসে আটকা পড়া এসব মানুষকে বিশেষ ব্যবস্থায় বিকল্প পথে ফেরানোর চেষ্টা চলছিল। অবশেষে বৃহস্পতিবার তারা ফিরতে পেরেছে। দ্বীপের মানুষের জন্য এখন খাদ্যসহায়তা খুবই প্রয়োজন।’ 

এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ‘এখনও মিয়ানমার সীমান্তে গুলিবর্ষণের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌরুট আট দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। কিন্তু কোরবানি ঈদ সামনে রেখে মানুষের কষ্টের কথা চিন্তা করে আজ বৃহস্পতিবার আটকে থাকা দুই পারের মানুষ ট্রলারে করে ফিরেছে। এবার দ্বীপে কীভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য পাঠানো যায়, সেই চেষ্টা চলছে।’

গত মঙ্গলবার দুপুরেও সেন্ট মার্টিন থেকে টেকনাফগামী দুটি ট্রলার ও কয়েকটি স্পিডবোট লক্ষ্য করে মিয়ানমারের ওপার থেকে গুলি চালানো হয়। এর আগে গত বুধবার ও শনিবারে মিয়ানমার সীমান্ত থেকে বাংলাদেশি ট্রলারকে লক্ষ্য করে দুই দফায় গুলি চালানো হয়েছে।

মিয়ানমারের বর্ডার পুলিশ (বিজিপি) নাকি সেখানকার বিদ্রোহী কোনও গোষ্ঠী গুলি চালিয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কোনও তথ্য জানাতে পারেনি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।

Source link

Related posts

জাতিসংঘ শান্তি পদক পেলেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা

News Desk

এবারও চালু হচ্ছে ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’, ঢাকায় আম আনতে খরচ কত?

News Desk

মই দিয়ে উঠতে হয় দেড় কোটি টাকার সেতুতে

News Desk

Leave a Comment