সন্ত্রাসী সারোয়ারের গাড়িতে গুলি করে দুজনকে হত্যা, নেপথ্যে প্রতিশোধ
বাংলাদেশ

সন্ত্রাসী সারোয়ারের গাড়িতে গুলি করে দুজনকে হত্যা, নেপথ্যে প্রতিশোধ

‌‘আমাদের চলন্ত গাড়ি লক্ষ্য রেখে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া হচ্ছিল। চার-পাঁচটি মোটরসাইকেল থেকে আট-নয় জন লোক এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে যাচ্ছিল। আমাদের চালক গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন। পেছন থেকে মোটরসাইকেল আরোহীরা ধাওয়া করতে থাকে। একপর্যায়ে গাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে তারা। এতে চালকসহ দুজন মারা যান, আমরা চার জন আহত হই।’

শনিবার মধ্যরাতে চট্টগ্রাম নগরের বাকলিয়া এক্সেস রোড এলাকায় প্রাইভেটকারে গুলি ছোড়ার ঘটনার এমন বর্ণনা দিয়েছেন গাড়িতে থাকা মো. রবিউল ইসলাম রবিন (২৪)। গুলিতে গাড়িতে থাকা দুজন নিহত হয়েছেন। তারা হলেন বখতিয়ার হোসেন মানিক (৩০) ও মো. আবদুল্লাহ (৩৬)। তাদের লাশ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আছে। হাসপাতালের সামনে আহাজারি করতে দেখা গেছে স্বজনদের।

বাঁ পায়ে গুলি লেগে আহত হন রবিন। পেশায় গাড়িচালক রবিন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রবিবার দুপুরে হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে তার সঙ্গে কথা হয়। রবিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হামলাকারীদের টার্গেট ছিল প্রাইভেটকারে থাকা সারোয়ার হোসেন বাবলা। মূলত তাকে হত্যার জন্য এভাবে গুলি চালানো হয়। এতে সারোয়ারের প্রাইভেটকার চালক মানিক এবং তার সহযোগী আবদুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তবে অক্ষত আছেন সারোয়ার ও তার সহযোগীরা।’ 

শনিবার (২৯ মার্চ) রাত পৌনে ৩টার দিকে নগরের বাকলিয়া এক্সেস রোড এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ রবিন ও হৃদয় চট্টগ্রাম মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন। তবে সারোয়ার ও ইমন কোথায় চিকিৎসা নিচ্ছেন, তা জানাননি রবিন। নিহত ও আহতরা সবাই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। 

পুলিশ জানায়, চট্টগ্রাম নগর পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সারোয়ার হোসেন। ৫ আগস্টের পর জামিনে মুক্তি পান। তার বিরুদ্ধে ১৬টি হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। চান্দগাঁও এলাকার বাসিন্দা সারোয়ার।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, প্রাইভেটকারটি কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে বাকলিয়া এক্সেস রোডে আসতে থাকে। এক্সেস রোডের মুখে প্রবেশের পর পেছন দিকে চার-পাঁচটি মোটরসাইকেল সেটিকে ধাওয়া করে। একপর্যায়ে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। প্রাইভেটকারের ভেতর থেকে মোটরসাইকেল আরোহীদের লক্ষ্য করে কয়েকটি গুলি ছোড়া হয়। পেছন ও পাশ থেকে গুলি করা হয় গাড়িতে। গুলিতে অনেকটা ঝাঁঝরা করে ফেলা হয় গাড়ি। এতে প্রাইভেটকারের দুই আরোহী নিহত হন।

নিহত মানিকের স্বজনরা জানিয়েছেন, মানিক পেশায় প্রাইভেটকার চালক। সারোয়ারের প্রাইভেটকার চালাতেন। হাটহাজারী উপজেলার মদুনাঘাট এলাকায় তার বাড়ি।

চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রবিন বলেন, ‘আমরা সারোয়ার ভাইয়ের রাজনীতি করি। রাতে আমি আর আবদুল্লাহ ঘর থেকে বের হয়েছি ঈদের মার্কেট করার জন্য। তখন আবদুল্লাহকে সারোয়ার ভাই ফোন দিয়ে নতুন ব্রিজ বালুর টাল এলাকায় যেতে বলেন। আমরা গিয়ে দেখি সারোয়ার ভাই বৈঠকে আছেন। সেখানে আবদুল্লাহ যুক্ত হন। তখন আমি কিছু খেতে দোকানে যাই। আধাঘণ্টা পর ফিরে এসে দেখি বৈঠক ভেঙে গেছে। সারোয়ার ভাই মানিককে গাড়ি বের করতে বলেন। আমাদের বলা হলো বহদ্দারহাট হয়ে সারোয়ার ভাইকে বাসায় নামিয়ে দেওয়া। এরপর আমি আর আবদুল্লাহ ঈদের কেনাকাটার জন্য মার্কেটে যাবো। প্রাইভেটকারে আমি, সারোয়ার, ইমন, হৃদয়, আবদুল্লাহ এবং মানিক ছিলাম। এর মধ্যে মানিক গাড়িচালক।’ 

রবিন বলেন, ‘গাড়িটি তিন-চার মিনিট চলার পর দেখি চার-পাঁচটি মোটরসাইকেলে আট-নয় জন লোক আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। একপর্যায়ে গুলি এসে আবদুল্লাহর ঘাড়ে লাগে। তার রক্তক্ষরণ হওয়ায় আমি চেপে ধরি। আমাদের গাড়িটি লক্ষ্য করে দীর্ঘক্ষণ গুলি করার পর আমরা বাকলিয়া এক্সেস রোডে ঢুকে পড়ি। সেখানে টহল পুলিশের গাড়ি দেখে তাদের সামনে সাহায্যের জন্য যাই। ততক্ষণে মোটরসাইকেল আরোহীরা আমাদের গাড়ি ঝাঁঝরা করে পালিয়ে যায়। তারা পালিয়ে যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন আমাদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসক মানিক ও আবদুল্লাহকে মৃত ঘোষণা করেন। আমি ও হৃদয় চিকিৎসা নিচ্ছি। সারোয়ার ও ইমন ভাই অন্যত্র চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে কোথায় নিচ্ছেন, তা জানা নেই।’

হামলাকারীদের চিনতে না পারলেও সম্প্রতি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেনের লোকজন এর সঙ্গে জড়িত বলে ধারণা করছেন রবিন। তিনি বলেন, ‘সাজ্জাদের সঙ্গে সারোয়ার ভাইয়ের আগে থেকে দ্বন্দ্ব ছিল। সম্প্রতি সাজ্জাদের গ্রেফতার এবং রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝামেলা বেড়েছে। তাই সাজ্জাদের লোকজন সারোয়ারকে খুন করতে এ হামলা চালাতে পারে।’

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হৃদয় বলেন, ‘আমাদের যারা গুলি করেছে তারা গ্রেফতার সাজ্জাদের বস দুবাইয়ে পলাতক বড় সাজ্জাদের লোক। সম্প্রতি বড় সাজ্জাদের অন্যতম সহযোগী ছোট সাজ্জাদকে গ্রেফতারের জন্য সারোয়ার ভাই সহযোগিতা করেন। হয়তো এ কারণে প্রতিশোধ নিতে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।’ 

গুলিতে ঝাঁঝরা প্রাইভেটকার

গত ১৫ মার্চ ঢাকার বসুন্ধরা শপিং মল থেকে গ্রেফতার করা হয় চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদকে। তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সারোয়ারকে দায়ী করা হয়। অনেকের ধারণা, এ ঘটনার জের ধরে সারোয়ারকে হত্যার উদ্দেশ্যে এ ঘটনা ঘটতে পারে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে বাকলিয়া এলাকায় আওয়ামী লীগের সাবেক এক এমপির জমি দখলকে কেন্দ্র ঘটনাটি ঘটতে পারে।

আরেকটি কারণও বলছে পুলিশ। যেটি হচ্ছে নতুন ব্রিজ এলাকায় বালুর মহাল নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী সারোয়ারের সঙ্গে সন্ত্রাসী খোরশেদ, রায়হান এবং হাসানের দ্বন্দ্ব ছিল। এই দ্বন্দ্বের জের ধরে ঘটনা ঘটতে পারে। পুলিশ এসব বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করছে। 

সারোয়ার বিদেশে পলাতক সাজ্জাদ আলী খানের একসময়ের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ হিসেবে পরিচিত। তিনি নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার খোন্দকার পাড়ার কালা মুন্সির বাড়ির আব্দুল কাদেরের ছেলে। 

নগর পুলিশের উত্তর জোনের উপ-কমিশনার আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ হয়ে দুইজন মারা গেছেন। তাদের লাশ চমেক হাসপাতালে রাখা হয়েছে। এ ঘটনায় আহত আরও দুই জনকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নিহত এবং আহতরা প্রাইভেটকারে ছিল। কারা, কী কারণে ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সাজ্জাদকে ধরিয়ে দেওয়া কিংবা জায়গা দখল নিয়ে বিরোধ আছে কিনা, সব বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।’

Source link

Related posts

বাবাসহ চার ছেলেকে হত্যা: ২২ জন‌ কারাগারে

News Desk

অধ্যাদেশ জারি, তেল গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়াতে-কমাতে পারবে সরকারও

News Desk

ঈদের আগে দূরপাল্লার গণপরিবহন চালুর দাবি মালিক-শ্রমিকদের

News Desk

Leave a Comment