মাঠে মাঠে হলুদের সমারোহ, বাতাসে দোল খাচ্ছে হলুদ ফুল। ফুলে উড়ে মধু আহরণ করছে মৌমাছি। কিন্তু গত কয়েক মৌসুমের চেয়ে এবার আলাদা কিছু দেখছেন যশোরের বিভিন্ন গ্রামের সরিষা চাষিরা। এবার ক্ষেতে মৌমাছি আসছে কম। এতে সরিষার আশানুরূপ উৎপাদন না হওয়ার শঙ্কায় কৃষক। তবে, আশঙ্কার কিছু নেই বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সুশান্ত কুমার তরফদার। তার মতে, মৌমাছি ছাড়াও প্রায় ১০০ প্রজাতির পতঙ্গ প্রকৃতিতে রয়েছে, যারা পরাগায়ন ঘটায়। এছাড়া বায়ুর মাধ্যমে পরাগায়ন ঘটে থাকে। সবমিলিয়ে এবার যশোরে উৎপাদন কমবে না বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
কৃষকরা বলছেন, গতবার ফলন ভালো ছিল, সেকারণে এবার সরিষায় আগ্রহ বেশি চাষিদের। কিন্তু বৃষ্টির ফলে মাঠ ভেজা থাকায় সরিষা গাছের বেশ ক্ষতি হয়। কিছু গাছে ফুল থাকলেও মৌমাছি আসছে না আগের মতো। মৌমাছির অনুপস্থিতি পরাগায়নে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, ফলে উৎপাদনও কমে যায়।
সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) তথ্য অনুযায়ী, মৌমাছির মাধ্যমে সফল পরাগায়ন সম্ভব এটি সর্বজনস্বীকৃত। ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর সময় মৌমাছিরা তাদের পা এবং বুকের লোমে ফুলের অসংখ্য পরাগরেণু বয়ে বেড়ায়। এক ফুলের পরাগরেণু অন্য ফুলের গর্ভমুণ্ডে পড়লে পরাগায়ন ঘটে, যার ফলশ্রুতিতে উৎপন্ন হয় ফল। বিভিন্ন মধুফুল মৌসুমে মৌমাছি দ্বারা পরাগায়িত ফসলের ১০ থেকে ১৫ ভাগ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার দরাজহাট ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের কৃষক জাহিদুল ইসলাম। এবার ৩৫ কাঠা জমিতে তিনি সরিষার আবাদ করেছেন। বললেন, সরিষা গাছের অবস্থা বেশ খারাপ। মনের দুঃখে ক্ষেতেও যাচ্ছি না। এবার মৌসুমের শুরুতেই ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে লাগাতার বৃষ্টিতে সরিষাগাছগুলোর বেশ ক্ষতি হয়। গাছগুলোর বেশিরভাগই নেতিয়ে পড়েছে। তারপরও কিছু ছিল। দুইদিন কুয়াশার পর দেখি, আবারও কাহিল। এবার বিঘা প্রতি প্রায় ৭ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। বৃষ্টির সাথে সাথে এবার মৌমাছির আনাগোনাও দেখছি না।
তিনি বলেন, আমার বাড়িতে ৩০-৩৫টি মৌমাছির চাক হয় প্রতিবছর, পাশে আমার ভাইয়ের বাড়িতে ১০-২০টি। কিন্তু এবার একটাও চাক বাঁধেনি। কতটুকু ফলন হবে— তা এই মুহূর্তে বলতে পারছেন না বলে জানান এই চাষি।
ঝিকরগাছা উপজেলার কুলিয়া গ্রামের জবেদ আলী এক বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছেন। গতবার প্রায় ৬ মণ ফলন ছিল। কিন্তু এবার বৃষ্টির কারণে ফলন ভালো হবে না। মণ দুয়েক হতে পারে বলে তার ধারণা।
মৌমাছির উপস্থিতি কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তেমন একটা দেখছি না। ক্ষেতে আগের মতো এখন আর ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি দেখতে পাই না— বলছিলেন তিনি।
সদর উপজেলার ইছালি ইউনিয়নের শুড়ো গ্রামের প্রকাশ বিশ্বাস ২৫ কাঠা জমিতে সরিষার আবাদ করেছেন। গতবারও করেছিলেন। এবার ফসলের উৎপাদন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেন। কারণ হিসেবে জানান, শেষসময়ে তুমুল বৃষ্টি আর মাঠে মৌমাছির আগমন খুবই কম। সার, বীজ, কীটনাশক ব্যবহার করে খরচ প্রায় ৪ হাজার টাকা হয়েছে। মাঠের যে অবস্থা, সরিষা না আনা পর্যন্ত বলতে পারছেন না তিনি।
একই ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের আব্দুল মতলেব বলেন, দুই বিঘা জমিতে চাষ করেছি সরিষার। বীজ, সার, কীটনাশক বাবদ খরচ প্রায় ৫ হাজার টাকা। এবার ফলন ভালো হবে না। মাঠে গাছ খুব পাতলা আর ফাঁকা। সবমিলিয়ে ১০ কেজি সরিষা পাবো কি না বলতে পারছি না।
ফলন খারাপ হলো কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এবার অসময়ে ঘূর্ণিঝড়ের সাথে বৃষ্টি ছিল। এছাড়া সরিষার ক্ষেতে তেমন একটা মৌমাছি দেখা যাচ্ছে না। তারই প্রতিবেশী অপর কৃষক শাহজাহান আলীও একই কথা বলেন। তার ১ বিঘা জমিতে সরিষা রয়েছে। তিনি আশা করছেন, ১৫-২০ কেজি ফলন হতে পারে।
মণিরামপুর উপজেলার দোনার গ্রামের কৃষক হাফিজুর রহমান বলেন, গত বছর আড়াই বিঘা জমিতে বারি সরিষা-১৮ জাতের চাষ করে ফলন হয়েছিল ২২ মণ। এবার দেড় বিঘা জমিতে চাষ করেছি, সরিষার অবস্থা খুব ভালো না। অর্ধেক গাছের ফুল পড়ে গেছে। সেখানে এখন ফল দানা বাধতে শুরু হয়েছে। কিন্তু ক্ষেতে মৌমাছি নেই। এই সময় হাজার হাজার মৌমাছিতে ক্ষেত ভরে যায়। কিন্তু এবার পুরো ক্ষেতে অল্প কিছু মৌমাছি।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেওয়া গত তিন রবি মৌসুমে সরিষা চাষের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জেলায় গত তিন রবি মৌসুমে সরিষার চাষ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২১-২০২২ রবি মৌসুমে জেলায় সরিষা চাষ হয় ১৫ হাজার ২৮১ হেক্টর জমিতে। গত ২০২২-২৩ রবি মৌসুমে চাষ হয়েছিল ২৪ হাজার ৩০২ হেক্টর জমিতে। চলতি রবি মৌসুমে আবাদ হয়েছে ৩১ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের চেয়ে এবার ৭ হাজার ২৭৮ হেক্টর বেশি জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে।
সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমের শুরুতে সরিষাচাষে উৎসাহী করতে কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। জেলার ৩৭ হাজার ৮০০ জন কৃষককে ১ কেজি করে বারি সরিষা-১৪ জাতের বীজ এবং ১০ কেজি করে ডিএপি (ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট) ও ১০ কেজি করে এমপি (মিউরেট অব পটাশ) সার দেওয়া হয়েছে। তবে এবার ক্যানোলা গুণাগুণসম্পন্ন বারি সরিষা-১৮ জাতের বীজ দেওয়া হয়নি।
সূত্র জানায়, উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ও স্থানীয়— জেলায় এই দুই ধরনের জাতের সরিষার চাষ হয়েছে। এরমধ্যে টরি-৭, টরি-১০, বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭,বারি সরিষা-১৮ ও বিনা সরিষা-৯ জাতের সরিষা চাষ বেশি জমিতে হয়েছে।
জানতে চাইলে ঝিকরগাছা উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আইয়ুব আলী অবশ্য বলছেন, মাঠে প্রচুর সরিষার ফুল রয়েছে। ফলন ভালো হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। বৃষ্টির কারণে যেসব গাছের ফুল নষ্ট হয়ে গেছিল, সেইসব গাছে নতুন করে ফুল আসছে। তবে, মাঠে মৌমাছির সংখ্যা বেশ কম। মূলত মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহারে আমাদের উপকারী পোকার ৯০ শতাংশেরই মৃত্যু হয়। ইকোলজিক্যাল সিস্টেম নষ্টের কারণেই এবার ধানে কারেন্ট পোকার আক্রমণ হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, এখন পর্যন্ত আবহাওয়া সরিষা চাষের অনুকূলে আছে। রোগবালাই এবং পোকামাকড়ের আক্রমণও কম। তবে এবার মৌমাছি কম দেখা যাচ্ছে। এটা প্রাকৃতিক বিষয়।
তিনি বলেন, পরাগায়ন শুধু মৌমাছি দিয়ে হবে- তা নয়, ১০০ প্রজাতির কীটপতঙ্গ ফুলের পরাগায়ন ঘটায়। বাতাসও ফুলের পরাগায়ন ঘটায়। তবে মৌমাছি পরাগায়ন ঘটালে ফলন ৫ থেকে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
মৌমাছির সংখ্যা কম কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরিষার পর পরই মৌমাছি কালোজিরার ফুলের সন্ধানে চলে যায়। ফরিদপুরে কালোজিরা চাষ এবং সেখানে মৌমাছির অভয়ারণ্য রয়েছে। মৌমাছি থাকলে যেমন পরাগায়ন এবং ফলন বাড়ে সাথে সাথে অতিরিক্ত হিসেবে মধুও পেয়ে থাকেন কৃষক। সেইটাও লাভের বিষয় বলে তিনি জানান।