বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশায় অফিসে যাচ্ছিলাম। সেদিন ছিল অক্টোবর মাসের প্রথম দিন। ২০১২ সাল। কিছুদূর যেতেই সকাল সাড়ে সাতটার দিকে হঠাৎ একটি গাড়ি রিকশার গতি রোধ করল। জোর করে আমাকে গাড়িতে তুলেই চোখ ও হাত বেঁধে ফেলা হলো। নিয়ে যাওয়া হলো একটি বাড়িতে। সেখানে টানা ৯ দিন চোখ বেঁধে রাখা হয় আমার। শুধু খাবারের সময় ১০ মিনিটের জন্য হাত খুলে দেওয়া হতো। কী যে ভীতিকর পরিস্থিতি ছিল, বলে বোঝাতে পারব না। এরপর সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলো আমাকে।’
সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া তানভীর রহমান প্রথম আলোকে এসব কথা বলেন। সাগর-রুনি হত্যার প্রায় আট মাস পর ওই মামলায় তানভীরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তখন তিনি ইংরেজি মাধ্যম একটি স্কুলে চাকরি করতেন। প্রায় দুই বছর কারাভোগের পর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে জামিনে মুক্তি পান তিনি। গত বুধবার রাজধানীর উত্তরা এলাকায় প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন তানভীর রহমান।
১০ বছর পরও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তানভীর রহমান বলেন, ‘আসল রহস্য বেরিয়ে এলে, প্রকৃত খুনি গ্রেপ্তার হলে আমি অন্তত এই অপবাদ থেকে মুক্তি পেতাম। আমি এখনো পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করছি। আমার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা এখনো আমাকে ভয় পায়। ভয়ে তারা আমাকে ফোন পর্যন্ত দেয় না। এটা যে কত কষ্টের, তা কাউকে বোঝাতে পারব না।’
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাড়িতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির লাশ পাওয়া যায়। সাগর তখন মাছরাঙা টিভিতে আর রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের সময় বাসায় ছিল তাঁদের সাড়ে চার বছরের ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘ।
চোখ বেঁধে রাখার ৯ দিন কী কী জিজ্ঞেস করা হয়েছে জানতে চাইলে তানভীর রহমান বলেন, ‘শুধু চোখ বেঁধে বসিয়ে রেখেছে। তেমন কিছু জিজ্ঞেস করেননি তাঁরা। তবে এক–দুবার বলেছেন, আপনি ঘটনার শিকার। এটা আপনাকে মেনে নিতে হবে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে আপনার জামিন হয়ে যাবে। আমি তাঁদের কথা মেনে নিয়েছিলাম। তখন আমি বুঝতে পারিনি, হত্যা মামলায় একবার নাম জড়ালে তার ভয়াবহতা কত হতে পারে।’
তানভীর রহমান আরও বলেন, ‘নতুন দায়িত্ব নেওয়ার পরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর কোনো একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, ১০ অক্টোবরের মধ্যে সাগর-রুনির হত্যা মামলার রহস্য উন্মোচন করা হবে। মন্ত্রীর ওই ঘোষণার পর ১ অক্টোবর আমাকে তুলে নেওয়া হয়। ১০ অক্টোবর সাগর-রুনির বাসার দারোয়ানের সঙ্গে আমাকেও গ্রেপ্তার দেখানো হয়।’
তানভীর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে অবিচার করা হয়েছে। হত্যার সঙ্গে আমার কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা পায়নি পুলিশ ও র্যাব। শুধু মুঠোফোনে কয়েক সেকেন্ড কথোপকথনের সূত্র ধরে এই ঘটনায় আমাকে জড়ানো হয়, যা আমার ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক-সামাজিক অবস্থান ধ্বংস করে দিয়েছে।’
তানভীর রহমান আরও বলেন, ‘ঘটনার পরই মুঠোফোনে কথোপকথন ও বার্তা আদান–প্রদানের সূত্র ধরে আমাকে ডিবি অফিসে ডাকা হয়েছিল। ডিবির কর্মকর্তারা আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা না পেয়ে আমাকে ছেড়ে দেন তাঁরা। মামলা র্যাবে হস্তান্তরের আগে ও পরে র্যাবের কর্মকর্তারা আমাকে অন্তত ২০ বার ডেকেছেন। আমার ব্যবহৃত সমস্ত ডিজিটাল ডিভাইস র্যাব ফরেনসিক করেছে। আমাকে যতবার তাঁরা ডেকেছেন, আমি ততবার গিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করেছি।’
সাংবাদিক মেহেরুন রুনির সঙ্গে কীভাবে পরিচয় ও যোগাযোগ, জানতে চাইলে তানভীর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাগর-রুনি জার্মানিতে থাকা অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রুনির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। রুনি বিভিন্ন ইস্যুতে ব্লগে লিখতেন। তাঁর একটি লেখার নিচে আমি মন্তব্য করেছিলাম। সেই কমেন্টের সূত্র ধরে পরিচয় হয়েছিল। দেশে ফিরে আসার পর তিনি একদিন আমাকে ফোন দিয়ে জানান। তারপর বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের কথা হতো। ঘটনার আগের দিন রাত নয়টার দিকে আমাদের কয়েক সেকেন্ড কথা হয়েছিল।’
তানভীর রহমান বলেন, ‘গ্রেপ্তার হওয়ার পর ছয় মাস আমার বাবা উকিলদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কোনো উকিল পর্যন্ত পাননি।’ তিনি বলেন, খুনের আসল রহস্য বেরিয়ে আসুক। প্রকৃত খুনিকে গ্রেপ্তার করা হোক। তবে কোনো নিরপরাধ লোক যেন হয়রানির শিকার না হন।