চট্টগ্রামের মাছ ব্যবসায়ী পরিচয়ে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে বাসা ভাড়া নিয়ে সহযোগীদের নিয়ে বসবাস করতেন রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনী। চিকিৎসার জন্য থাকার কথা বলে গত ২০ নভেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জের ভূমি পল্লী আবাসিক এলাকার ৬ নম্বর সড়কের ১০তলা ভূমি পল্লী টাওয়ারের আটতলার ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। গত প্রায় চার মাস ধরে সেখানে থাকতেন। ওই ফ্ল্যাট থেকে আতাউল্লাহসহ ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন একই ভবনের অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা।
ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা বলছেন, অসুস্থতার ভান করে চিকিৎসা নেওয়ার কথা বলে ফ্ল্যাটে উঠেন আতাউল্লাহ। তার ফ্ল্যাটে প্রায় সময় আত্মীয় পরিচয়ে একাধিক নারীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি যাতায়াত করতেন। কিন্তু কখনও ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলতেন না আতাউল্লাহ। বুধবার (১৯ মার্চ) দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত ভূমি পল্লী টাওয়ারের একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে এসব তথা জানা গেছে।
গত সোমবার দিবাগত রাত ২টার দিকে ভূমি পল্লী টাওয়ারের আটতলার ফ্ল্যাট থেকে আতাউল্লাহ, পরিবারের সদস্য ও সহযোগীসহ ছয় জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় আতাউল্লাহর শিশুসন্তানরাও ছিল। একই দিন ময়মনসিংহ নতুন বাজার এলাকার ১৫তলা গার্ডেন সিটির ১০ তলার ফ্ল্যাট থেকে দুজন নারী এবং দুজন পুরুষসহ চার জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের সঙ্গেও শিশুসন্তান ছিল। এ ঘটনায় র্যাব-১১-এর ওয়ারেন্ট অফিসার শাহনেওয়াজ বাদী হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি এবং অবৈধ অনুপ্রবেশ আইনে পৃথক দুটি মামলা করেন। পৃথক দুটি মামলায় আতাউল্লাহসহ ছয় জনকে পাঁচ দিন করে মোট ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তবে তিন থেকে আট বছর বয়সী পাঁচ শিশুকে গ্রেফতার দেখানো হয়নি। তারা মায়েদের সঙ্গে আছেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
গত ২০ নভেম্বর আরসা প্রধান আতাউল্লাহ তার কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে ভূমি পল্লী টাওয়ারের তিনতলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। পরে সেটি ছেড়ে একই ভবনের আটতলায় ফ্ল্যাট ভাড়া নেন।
ভূমি পল্লী টাওয়ারের ১০তলা ভবনের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটের মালিক চট্টগ্রামের ফল ব্যবসায়ী মো. শাহ আলম। ফ্ল্যাটটির দেখাশোনা করেন তার শ্বশুর হুমায়ুন কবীর। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত ২০ নভেম্বর অসুস্থ অবস্থায় ওই ব্যক্তি (আতাউল্লাহ) লাঠিতে ভর করে হুজুর বেশে তিনতলার ফ্ল্যাটটি ১১ হাজার টাকায় ভাড়া নেন। চট্টগ্রাম থেকে এসে চিকিৎসা নিতে সমস্যা হয়, এ কারণে রাজধানীর কাছাকাছি এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার কথা বলেন। তখন শিশুসহ তিন জন পুরুষ মিলে ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। পরিবারের নারী সদস্যরা পরে আসবে বলে জানিয়েছেন। সোমবার গ্রেফতারের ঘটনা শুনে জানতে পারি, অসুস্থ ওই ব্যক্তি আরসা প্রধান। এটি আমাদের জন্য কতটা নিরাপত্তা হুমকি ছিল, তা ভেবে অবাক হচ্ছি। কারণ আমরা কেউ তাকে চিনতে পারিনি।’
হুমায়ুন কবীর আরও বলেন, ‘পেশা হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে ট্রলার দিয়ে মাছ ধরার ব্যবসা করেন বলে জানান। অসুস্থতার কথা বলে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি পরে দেবেন বলেছেন। ওই সময় তার সরকারি আইডি কার্ড দেখিয়েছিলেন। ফ্ল্যাটে ওঠার ১৫-১৬ দিন পর পরিচয়পত্রের ফটোকপি দেওয়ার জন্য চাপ দিলে তখন বাসা পরিবর্তন করার কথা জানান। কারণ হিসেবে বড় ফ্ল্যাট প্রয়োজন বলে আমাকে জানান আতাউল্লাহ। ২০ নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই মাসের ভাড়া দিয়ে তিনতলার ফ্ল্যাট ছেড়ে আটতলার ফ্ল্যাটে ওঠেন।’
আটতলার ফ্ল্যাটটির মালিক ইতালিপ্রবাসী আব্দুল হালিম। সেটি দেখাশোনা করেন তার বেয়াই খোরশেদ আলম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তৃতীয় তলায় ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকায় তাদের (আতাউল্লাহ) আটতলার ফ্ল্যাটে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, মসজিদে যান। তাদের কথাবার্তা ও চলাফেরায় কখনও রোহিঙ্গা বলে মনে হয়নি। তারা প্রথমে আমাকে বলেছিল, তিনতলার ফ্ল্যাটে থাকতেন। পরে তাদের বড় ফ্ল্যাটের প্রয়োজন হলে আমাদের ফ্ল্যাটে ২০ হাজার টাকা ভাড়ায় ওঠেন। এই ভবনের নিরাপত্তাপ্রহরী ইমরান হোসেন মূলত আতাউল্লাহকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিল। এ বিষয়ে সে ভালো বলতে পারবে।’
বাড়ির নিরাপত্তাপ্রহরী ইমরান হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চার মাস আগে কালো হাইয়েস মাইক্রোবাসে জুব্বা ও মাথায় টুপি পরা আতাউল্লাহসহ চার-পাঁচ জন এসে ফ্ল্যাটে ওঠেন। ওই সময় তিনি একজনের কাঁধে ধরে লাঠিতে ভর করে ফ্ল্যাটের ওপরে ওঠেন। তারা ফ্ল্যাটেই থাকতেন। কারও সঙ্গে মিশতেন না। প্রয়োজন হলে বাইরে যেতেন। তবে আতাউল্লাহ খুব কম বের হতেন। সময়মতো তারা ভাড়া পরিশোধ করে দিতেন। কয়েকদিন পর পর তাদের আত্মীয় পরিচয়ে লোকজন আসতেন। গত সোমবার বাদ এশা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে আতাউল্লাহর স্ত্রী শাহীনা আক্তার, দুই সন্তান এখানে আসেন। এরপর ওই দিন রাতেই অভিযানে গ্রেফতার হন তারা।’
ইমরান হোসেন আরও বলেন, ‘বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় আতাউল্লাহ বলেছেন কাতারে একটি মসজিদের ইমামতি করতেন। তার সঙ্গে থাকা অন্যরা চট্টগ্রামে মাছ ধরার ব্যবসায় জড়িত। এ ছাড়া বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় একটি বাহিনীর সদস্যের আত্মীয় পরিচয় দিয়েছেন তার সঙ্গে থাকা লোকজন।’
ফ্ল্যাট পরিবর্তনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আতাউল্লাহ আমাকে জানান তাদের পরিবারের সদস্য বেশি। তাই বড় ফ্ল্যাট প্রয়োজন। এই কথা শুনে আমি আটতলার ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে দিই। ওই ফ্ল্যাটে তাদের পরিবারের আট জন সদস্য বসবাস করতেন। প্রায় সময় তার বাসায় আত্মীয় পরিচয়ে নারীসহ বিভিন্ন লোকজন যাতায়াত করতেন। তবে বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি চাইলেও দেননি। পরে দেবেন বলেছেন। কিন্তু তিন মাসেও দেননি। দেখা হলেই অসুস্থতার কথা বলতেন। এজন্য চাপাচাপি করিনি।’
এদিকে আরসার প্রধান আতাউল্লাহ সহযোগীদের নিয়ে গত প্রায় চার মাস ভবনটিতে অবস্থান করলেও বুঝতে পারেননি অন্য ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীরা। ভবনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কারও সঙ্গে মিশতেন না। মাঝেমধ্যে ইমরান নামের একজনকে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে ও বাজার করতে দেখেছেন। মাঝেমধ্যে আতাউল্লাহকে চিকিৎসার কাগজপত্র নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে দেখেছেন।
আতাউল্লাহর ফ্ল্যাটের বিপরীতে বসবাসকারী রোজিনা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুখে দাড়ি, মাথায় পাগড়ি ও জুব্বা পরিহিত ওই ব্যক্তি আমার বিপরীত ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। তিনি কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। নীরবে চলাফেরা করতেন। এমনকি ওই ফ্ল্যাটে নারী-শিশু থাকলেও কারও কোনও শব্দ কখনও শুনিনি। ফ্ল্যাটের দরজা খুব অল্প পরিমাণে খোলা হতো ও যাতায়াত করতো, যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে।’
তিনি বলেন, ‘১৭ মার্চ রাত আনুমানিক ৩টার দিকে যখন র্যাব অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে তখন টের পাইনি। পরে নিচতলায় শিশুদের শব্দ পেয়ে উঠে বিষয়টি জানতে পারি। আমার বাসার পাশের ফ্ল্যাটে একজন দুর্ধর্ষ অপরাধী থাকতো, ভেবে ভয়ে আঁতকে উঠছি। এখনও আমাদের ভয় কাটেনি।’
এ ঘটনার পর ওই ভবনের ফ্ল্যাটের মালিকরা বাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগানো শুরু করেছেন। ভবনের চারতলার ফ্ল্যাটের মালিক মোশারফ হোসাইন বলেন, ‘এত বড় দুর্ধর্ষ সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসার প্রধান আমাদের ভবনের ফ্ল্যাটে ভাড়া ছিলেন, আমরা কেউ জানতাম না। তাকে কেউ চিনতেও পারেনি। আতাউল্লাহ ও তার সহযোগীরা যদি আমাদের ফ্ল্যাটের সবাইকে জিম্মি করে ফেলতেন, তখন আমাদের কী অবস্থা হতো। যারা তাদের ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছেন, এই দায় এড়াতে পারেন না তারা।’
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহীনুর আলম বলেন, ‘আরসার প্রধান পাহাড় থেকে পড়ে ঘাড়ে ও কাঁধে ব্যথা পান। পরিচয় গোপন করে চিকিৎসার জন্য তারা এখানে এসেছিলেন বলে দাবি করেছেন। তারা কী উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিলেন, তাদের কী পরিকল্পনা ছিল, রিমান্ডে এসব তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সোমবার রাতে আরসা প্রধান আতাউল্লাহসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। তাদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। দুই মামলায় তাদের ১০ দিনের রিমান্ড হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পরে বলা যাবে, তারা কেন ওই বাসায় উঠেছেন এবং তাদের কী ধরনের পরিকল্পনা ছিল।’