সীতাকুণ্ডের বেসরকারি বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত এখনও চলমান। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার এক মাস পার হলেও মামলার তদন্তে নেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। মামলায় আট জনকে আসামি করা হলেও গ্রেফতার হয়নি কেউ। মালিকপক্ষকে বাদ দিয়ে ডিপোর কর্মীদের এ মামলায় আসামি করা নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন বণিক বালা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলমান। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২০-২৫ ধরনের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়া গেলে বোঝা যাবে কী কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমরা চেষ্টা করছি, কার কী অবহেলা ছিল তা বের করার। এর সঙ্গে যেই দায়ী হোক তাকে মামলায় আসামি করা হবে। যাদের আসামি করা হয়েছে তারা যদি নির্দোষ হয় তাদের অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হবে।’
সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘মামলাটি এখনও বিচারাধীন। তদন্তকাজ চলছে। তদন্ত শেষ হলে বোঝা যাবে কী কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। কবে নাগাদ তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’
গত ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুনে ভয়াবহ এ বিস্ফোরণে ৫০ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন কয়েক শ’। এ ঘটনায় ৭ জুন রাতে সীতাকুণ্ড থানার এসআই আশরাফ সিদ্দিকী বাদী হয়ে ডিপোর আট কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন।
মামলায় বিএম কনটেইনার ডিপোর মহাব্যবস্থাপক নাজমুল আক্তার খান, উপমহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) নুরুল আক্তার খান, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) খালেদুর রহমান, সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্বাস উল্লাহ, জ্যেষ্ঠ নির্বাহী (প্রশাসন) নাছির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক আবদুল আজিজ, ডিপোর শেড ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম ও সহকারী ডিপো ইনচার্জ নজরুল ইসলামকে আসামি করা হয়।
মামলায় অগ্নিকাণ্ডে হাত হারানো নুরুল আক্তার খান এবং শরীরের ১২ শতাংশ পুড়ে যাওয়া খালেদুর রহমানকেও মামলার আসামি করায় হতবাক হয়েছেন স্বজনরা।
এ ঘটনায় ডিপোর মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন চট্টগ্রাম শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) সমন্বয়ক তপন দত্ত। তিনি বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে রাসায়নিক দ্রব্য থাকার বিষয়টি ফায়ার সার্ভিসের কাছে গোপন করার কারণে এতগুলো তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। তথ্য গোপন করে মালিকপক্ষ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে। এ ঘটনায় মালিকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি দূরে থাক বরং তাদের বাঁচানোর জন্য নানা প্রক্রিয়া ও ফন্দিফিকির আমরা দেখছি।’
ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ডিপোতে দুর্ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ কার্গো চালক মো. ইয়াসিনের স্বজনরা। ইয়াসিনের বাড়ি ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়নের গোসাইপুর গ্রামে। তার বাবা বদিউল আলম খোকা মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলে বিএম কনটেইনার ডিপোতে মালামাল নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে আগুন লাগার পর তার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমনকি তার লাশটিও আমরা পাইনি। কোনও ক্ষতিপূরণও আমাদের দেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় দায়ীদের সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দাবি জানাচ্ছি। আমার ছেলের লাশটি হলেও আমাকে যাতে দেওয়া হয়– এ দাবি করছি।’
নিখোঁজ ইয়াসিন স্পিড কার্গো নামে একটি কার্গোর চালক ছিলেন। ঢাকা থেকে ইয়াসিন পণ্য নিয়ে বিএম ডিপোতে গিয়েছিলেন। স্পিড কার্গোর মালিক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ইয়াসিন আমার যে গাড়িটি চালাতো সেটি দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে আমি দেখে এসেছি। গাড়িটির সামনের কেবিনসহ ইঞ্জিন পুড়ে গেছে। এতে অন্তত ১০-১৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মালামালগুলো গাড়িতে ছিল। সেগুলো অক্ষত ছিল। আমরাও কোনও ক্ষতিপূরণ পাইনি। চালক ইয়াসিন নিখোঁজ রয়েছে। তার পরিবারও কোনও ক্ষতিপূরণ পায়নি।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মালিকপক্ষকে আসামি না করে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় মৃত্যু দায়িত্বে অবহেলার কারণে নয়, এটি হত্যাকাণ্ড। এর জন্য দায়ীদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। তা না হলে এ ধরনের অপরাধ সমাজে বাড়বে।’
ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় করা মামলার এজাহারেও বলা হয়, সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ড্রামভর্তি কেমিক্যাল কনটেইনারে থাকার কথা ফায়ার সার্ভিসকে জানায়নি মালিকপক্ষ। এ কারণে কেমিক্যালভর্তি কনটেইনারের আগুন পানিতে নেভানো সম্ভব হয়নি। কেমিক্যালের কারণে এক কনটেইনার থেকে আরেক কনটেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে হতাহতের ঘটনা ঘটে। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৩৩৭/৩৩৮/৩০৫.ক/৪২৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, বিএম কনটেইনার ডিপোতে আমদানি-রফতানি করা গার্মেন্ট পণ্য কনটেইনারে রাখার পাশাপাশি কেমিক্যালভর্তি ড্রামও রাখা হতো। কিন্তু অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলায় ডিপো কর্তৃপক্ষের অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষিত জনবল ছিল না। কেমিক্যাল জাতীয় পদার্থের আগুন নেভানোর মতো কোনও ধরনের প্রস্তুতিও তাদের ছিল না। এ অবস্থায় ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হলে ফায়ার সার্ভিসের একাধিক টিম পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ডিপো কর্তৃপক্ষ ড্রামভর্তি কেমিক্যাল কনটেইনারে থাকার বিষয়টি ফায়ার সার্ভিসকে জানায়নি। ড্রামভর্তি কেমিক্যালের কারণে এক কনটেইনার থেকে আরেক কনটেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এই আগুন পানিতে নেভানো সম্ভব হয়নি। উল্টো ড্রামভর্তি কেমিক্যালের ছয়-সাতটি কনটেইনার একযোগে বিস্ফোরিত হয়।
মামলার এজাহারে পুলিশ আরও উল্লেখ করেছে, বিস্ফোরণের ভয়াবহতায় আশপাশের দুই-তিন কিলোমিটারের মধ্যে থাকা অনেকগুলো ভবনের কাচ টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। বিস্ফোরিত কনটেইনারের ছড়িয়ে পড়া টুকরোর আঘাতে ঘটনাস্থলে থাকা ফায়ার সার্ভিস কর্মী, পুলিশ সদস্য এবং বিপুল সংখ্যক মানুষ হতাহত হন। এজন্য আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে এত সময় লেগেছে। কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা, ডিপো পরিচালনায় দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে অগ্নিকাণ্ড ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।