ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার একটি গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ২৩টি বাড়িঘরে ও পাঁচটি দোকানপাটে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গত মঙ্গলবার রাতে উপজেলার সদর ইউনিয়নের মংলারগাঁও গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় ওই গ্রামের এক হিন্দু কিশোরকে (১৭) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে আরেকজনের ফেইসবুক পোস্টে গিয়ে ধর্মকে অবমাননা করে মন্তব্য করার অভিযোগ তুলেছেন এলাকার লোকজন।
দোয়ারাবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহিদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফেসবুকে পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে মামলা হয়েছে। ওই মামলায় ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরকে আটকের পর গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। দোয়ারাবাজার থানায় সাইবার নিরাপত্তা আইনে উপপরিদর্শক (এসআই) আরাফাত ইবনে সফিউল্লাহ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। বর্তমানে ওই গ্রামের পরিস্থিতি স্বাভাবিক।’
পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার বিকালে ওই কিশোর ফেসবুকে আরেকজনের পোস্টের মন্তব্যের ঘরে পবিত্র কোরআন অবমাননা করেছে অভিযোগ করে স্থানীয় উত্তেজিত জনতা রাতে মিছিল করেন। ঘটনা জেনে পুলিশ কিশোরকে তাদের হেফাজতে নেয়। মিছিল থেকে উত্তেজিত জনতা ওই কিশোরের বাড়িসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২৩টি বাড়িঘর ও পাঁচটি দোকানপাটে হামলা চালায়। খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
গ্রেফতার কিশোরের স্বজনরা জানিয়েছেন, ওই কিশোরের বাবা দীর্ঘদিন ধরে ওমানপ্রবাসী। বাড়িতে ওই কিশোর, তার মা ও বড় ভাই থাকেন। বড় ভাই স্নাতক প্রথম বর্ষে এবং ওই কিশোর দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে। গ্রামে ৮০-৯০টি পরিবারের বাস। দুটি পরিবার ছাড়া সবাই সংখ্যালঘু।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
মঙ্গলবার রাতে মংলারগাঁও গ্রামের ওই কিশোর একটি ফেসবুক পোস্টের মন্তব্যে কোরআন অবমাননা করেছে বলে অভিযোগ তোলেন এলাকার কয়েকজন ব্যক্তি। পরে একটি স্ক্রিনশটের সঙ্গে কিশোরের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ার পর এলাকার মুসলিম লোকজন বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিল থেকে ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ২৩টি বসতঘর ভাঙচুর করা হয়। এর মধ্যে ১০টি ঘর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি দোকানপাটে হামলার ঘটনা ঘটে। তখন বাড়ির একটি মন্দিরও ভাঙচুর করা হয়। খবর পেয়ে রাতেই ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। সেইসঙ্গে অভিযুক্ত কিশোরকে আটক করা হয়।
ভুক্তভোগী হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ১০টি পরিবার বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে দোয়ারাবাজার স্কুল মাঠে জড়ো হতে থাকেন স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন। তারা বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে এসে গ্রামের হিন্দুদের বাড়ি-দোকানপাটে হামলা চালানো হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ঘটনাস্থলে আসে সেনাবাহিনী। পরে অভিযুক্তকে আটক করে পুলিশ। রাত ১২টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। তবে এখনও আতঙ্কে আছেন গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন।
বৃহস্পতিবার বিকালে সরেজমিনে গ্রামটিতে গিয়ে দেখা গেছে, গ্রামের বাসিন্দা রঞ্জন দাস, কানু দাস, কাজল দাস, চিত্তরঞ্জন দাস, মতি সুত্রধর, সতন দাস, সুবোধ দাস, বিনা সরকার, হরিধন দাস, সঞ্জয় শীল, মোহন দাস, মন্টু দাস, সুনীল দাস, নিশি দাস, শ্যামল দাস, নিকলেস দাস, রণধীর সরকার, রনি সরকার, মানিক দাস, সুজিত দাস, কৃষ্ণমোহন দাস, দ্বিগেন্দ্র দাস ও তিলক দাসসহ ২৩ জনের বসতঘর ভাঙাচোরা অবস্থায় আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০ জনের ঘর। পাশাপাশি বিপ্লব দাস, সুনীল দাস, রনি সরকার, সজীব দাস ও কানু দাসের দোকানপাট ভাঙচুরের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখনও তাদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ নিয়ে বারবার কথা বলার চেষ্টা করলেও কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি কেউ।
ঘটনার পর সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস মিয়া, পুলিশ সুপার আ ফ ম আনোয়ার হোসেন খান ওই গ্রামে গিয়েছিলেন। তারা গ্রামের বাসিন্দাদের আশ্বস্ত করেছেন, আর কোনও সমস্যা হবে না।
পাশের নৈনগাঁও মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আবদুর করিম হোসাইন বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আর যাতে কোনও রকম বিশৃঙ্খলার চেষ্টা না হয়, সেটি সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছি আমরা।’
দোয়ারাবাজার থানার ওসি জাহিদুল হক বলেন, ‘কোরআন অবমাননার অভিযোগে আটক কিশোরের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এখন গ্রামের পরিস্থিতি পুরোপুরি শান্ত আছে।’
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নেহের নিগার তনু বলেন, ‘এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন আছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে অনেকে ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তবে আশপাশের গ্রামের মানুষ, পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় বড় অঘটন থেকে রক্ষা পেয়েছি আমরা।’