ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে সুন্দরবনে বন বিভাগের ইকোট্যুরিজম পয়েন্টসহ ফরেস্ট স্টেশনগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুপেয় পানির আধার পুকুরগুলোও। এতে সংকটে পড়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবি হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীরা। সুপেয় পানির সংকটে বনকর্মীরাও।
সুন্দরবন বিভাগের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বলেন, ‘সুপেয় পানি এখন সবচেয়ে বড় সংকট সুন্দরবনের। কেননা, বনের বন্যপ্রাণী, বনজীবী এবং বনে অবস্থানরত বনকর্মীদের সুপেয় পানির একমাত্র উৎস ছিল পুকুরগুলো। যার সবই নোনাপানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। ফলে তারা বর্তমানে খাবার পানির মারাত্মক সংকটে ভুগছে। খুব শিগগিরই এই সমস্যা নিরসন হবে না। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিটি পুকুর সেচ দিয়ে সেখান থেকে লবণপানি বের করে দেওয়া হবে। পরবর্তীতে বৃষ্টির পানিতে পুকুরগুলো ভরার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। জলোচ্ছ্বাসে ৮০টি মিঠাপানির পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘৩১ মে পর্যন্ত সুন্দরবনের কটকা ও দুবলা এলাকাসহ বনের বিভিন্ন স্থান থেকে মোট ১১১টি মৃত হরিণ ও ৪টি শূকর উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া আহত অবস্থায় আরও ১৮টি হরিণ ও একটি অজগর সাপ উদ্ধার হয়। রিমালের আঘাতে প্রাথমিকভাবে সুন্দরবনে অবকাঠামোগত ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মো মহসীন হোসেন বলেন, ‘পশ্চিম সুন্দরবনের আওতাধীন খুলনা ও সাতক্ষীরায় অবকাঠামোগত ২ কোটি ৬১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে পন্টুন গ্যাংওয়ে ১টি, জেটি ১৮টি, সুপেয় পানির পুকুর ১৪টি ডুবে লবণাক্ততায় পড়েছে, ৯টি অফিসের ২ হাজার ৬৩০ ফুট রাস্তা, বনকর্মীদের ব্যারাক ৩টি, সোলার প্লেট ৮টি, ওয়্যারলেস টাওয়ার ২টি, জেনারেটর ২টি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অবকাঠামোগত ক্ষতি অর্থ দিয়ে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু রিমালের আঘাতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির আর্থিক নিরূপণ করা অসম্ভব। এ ক্ষতি সুন্দরবন নিজেই কাটিয়ে উঠতে পারবে। সেজন্য সুন্দরবনকে সময় দিতে হবে। বিরক্ত করা চলবে না। আর এ জন্য ৩০-৪০ বছর লাগতে পারে। বুড়িগোয়ালিনি, নলিয়ান ও বানিয়াখালি এলাকার ১১ কিলোমিটার গোলপাতা বন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুন্দরবনজুড়ে পাখির হাজার হাজার বাসা ছিল। সেসব বাসায় ডিম ও বাচ্চা ছিল। সে ক্ষতি পরিসংখ্যানে নিরূপণ করা কঠিন। হরিণের মরদেহগুলো গণনা করা গেলেও ভেসে যাওয়ার হিসেব মিলবে না। জোয়ার-ভাটার এ সুন্দরবনে ৪৮ ঘণ্টা ভাটা দেখা যায়নি। ৩-৯ ফুট পানির নিচে ছিল সুন্দরবন। ৩ ফুটের নিচের প্রাণীগুলো যারা পানি সহ্য করতে পারে না তাদের অবস্থা নিরূপণ করা কঠিন। সাপ পানিতে ভাসলেও তার পানিতে থাকারও একটা নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। সেক্ষেত্রে এসব প্রাণীর ক্ষতিও নিরূপণ করা অসম্ভব। জোয়ার-ভাটার সুন্দরবনে ৪৮ ঘণ্টা ভাটা দেখা না যাওয়ার ক্ষতির ব্যাপকতা অনেক।’
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো নুরুল কবির বলেন, ‘পূর্ব সুন্দরবনে রিমালের আঘাতে সাড়ে ৩ কোটি টাকার অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে। দুবলা, শ্যালা, আলোর কোল, কটকা, কচিখালীতে জেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুকুর তলিয়ে লবণাক্ত হয়েছে। হরিণ, শূকরসহ বিভিন্ন প্রাণী মারা গেছে। মৃত প্রাণী মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। আর জীবিত প্রাণীকে সেবা দিয়ে বনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। করমজল, কটকা, কচিখালী, দুবলার চরে রাস্তার ক্ষতি হয়েছে। ২০টি স্টেশন ও ৫০টি পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন বিভাগের তথ্যমতে, পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী স্টেশনের অবকাঠামো ক্ষতির পরিমাণ ২৫ লাখ টাকা, কলাগাছিয়া ইকোট্যুরিজম ১৫ লাখসহ মান্দারবাড়িয়া, হলদেবুনিয়া, নোটাবেকী অভয়ারণ্য ও কৈখালী, কবাদক ও কদমতলা স্টেশনের বিভিন্ন টহল ফাঁড়ির ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ১ কোটি ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা।’
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক ইকবাল হোসেন চৌধুরী জানান, কলাগাছিয়া ইকোট্যুরিজমসহ বুড়িগোয়ালিনী, কৈখালী, কবাদক ও কদমতলা স্টেশনের জলযান ও অবকাঠামোসহ ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বনের ভেতরে বন্যপ্রাণী হতাহতসহ গাছপালার ক্ষতি এখনও নিরূপণ করা যায়নি। বুড়িগোয়ালিনী এলাকা থেকে দুটি ও কদমতলা স্টেশন এলাকা থেকে একটি আহত হরিণকে উদ্ধার করে চিকিৎসা শেষে আবারও বনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। স্টেশনের আশপাশের সুপেয় পানির আধারগুলোর পানি সেচে শুকিয়ে ফেলে সামনের বৃষ্টির পানি ধরে রাখার কাজ চলছে।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. আব্দুল্লাহ হারুণ চৌধুরী বলেন, ‘বন্যপ্রাণীর জন্য সুপেয় পানির আধার দ্রুত সৃষ্টি করতে হবে। আপাতত ছোট পুকুরগুলোতে শ্যালো মেশিন দিয়ে লোনাপানি বাইরে ফেলে ফ্রি করা যেতে পারে। এখন বৃষ্টির মৌসুম আছে। সেখানে বৃষ্টির পানি জমে প্রাণীর জন্য সুপেয় সুপেয় পানির আধার দ্রুত সৃষ্টি হবে।’
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোস্তফা সরোয়ার বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস সুন্দরবনকে বিপর্যস্ত করেছে। লবণাক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এমন পরিস্থিতিতেও আশার কথা হলো, এখন বৃষ্টির মৌসুম। তাই লবণাক্ততা কাটতে সহায়ক হবে। এ অবস্থায় সুপেয় পানি ধরে রাখার জায়গা ঠিক রাখতে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।’