স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশ ও তন্ত্রমন্ত্রের গুজব ছড়িয়ে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় বাবা ও চার ছেলেকে কুপিয়ে ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ সময় ওই ব্যক্তির আরেক ছেলে পালিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে গ্রেফতারকৃত ২২ জন।
এর আগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে উপজেলার দুর্গম গ্যালেংগ্যা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আবুপাড়ার কারবারি পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হত্যা করে কয়েকজন প্রতিবেশী। শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় অভিযান চালিয়ে আবুপাড়ার ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে আবুপাড়া।
শনিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় বান্দরবানের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. নূরুল হক গ্রেফতার ২২ জনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
আরও পড়ুন: হামলায় প্রাণ গেলো পাড়া প্রধান ও চার ছেলের
নিহতরা হলেন—আবুপাড়ার পাড়াপ্রধান কারবারী ল্যাংরুই ম্রো (৬০) এবং তার চার ছেলে রুংথুই ম্রো (৪০), লেংরুং ম্রো (৩৭), মেনওয়াই ম্রো (৩৫) ও রিংরাও ম্রো (২৫)।
গ্রেফতারের পর পুলিশের কাছে পাড়াপ্রধান ও তার চার ছেলেকে হত্যার চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয় ২২ জন। প্রাথমিকভাবে তারা হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলে জানায় পুলিশ। তারা রুমারর গ্যালেংগা ইউনিয়নের পান্তলা মৌজার আবুপাড়ার বাসিন্দা। এ ঘটনায় শুক্রবার সন্ধ্যায় লেংরুং ম্রোর স্ত্রী হাইপো ম্রো বাদী হয়ে ২২ জনকে আসামি করে রুমা থানায় হত্যা মামলা করেন।
পুলিশ জানায়, আবুপাড়ার কারবারি ও তার পাঁচ ছেলে একই বাসায় থাকতেন। ল্যাংরুই ম্রো একজন তান্ত্রিক। তার পরিবারের সঙ্গে কেউ খারাপ আচরণ করলে তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে অসুস্থ কিংবা পঙ্গু করে দিতেন বলে অভিযোগ পাড়াবাসীর। এরই মধ্যে জুম চাষের জমি নিয়ে পাড়াবাসীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয় ল্যাংরুই ম্রোর। তিনি ভালো জমিগুলো দখলে নিয়ে পাড়াবাসীকে খারাপ জমিগুলো দিতেন চাষের জন্য। এ নিয়ে কয়েকবার তাদের মধ্যে বৈঠকও হয়। কিন্তু কোনও সমাধান হয়নি।
এ বিষয়ে যারা প্রতিবাদ করেছিল তারা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ পরিবারের সদস্যদের ধারণা তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে অসুস্থ কিংবা পঙ্গু করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে ল্যাংরুই ম্রোর বিরুদ্ধে।
এরই মধ্যে কয়েকজন স্বপ্নে গায়েবি নির্দেশ পান—ল্যাংরুই ম্রো ও তার ছেলেদের হত্যা করলে মুক্তি মিলবে। স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশের গুজব ছড়িয়ে পাড়াবাসী একত্রিত হয়ে ল্যাংরুই ম্রো ও তার ছেলেদের পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে।
পুলিশ আরও জানায়, কয়েকদিন ধরে ওই পরিবারের সদস্যদের হত্যার জন্য পরিকল্পনা করেছিল পাড়াবাসী। বৃহস্পতিবার রাতে ল্যাংরুই ম্রো ও তার ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়লে পাড়াবাসী তাদের ঘর চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। পরে ঘরে ঢুকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে বাবা ও চার ছেলেকে হত্যা করে। হত্যার পর তাদের লাশ পাশের ঝিরিতে ফেলে দেয়। এ সময় এক ছেলে কোনোরকমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচান।
আরও পড়ুন: বাবাসহ চার ছেলেকে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার ২২ জন কারাগারে
স্থানীয়রা জানায়, আবুপাড়ায় সাতটি পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে এক পরিবারের পাঁচ জনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় বাকি ছয় পরিবারের ২২ জন পুরুষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে এই হত্যাকাণ্ডে কোনও নারী জড়িত নয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ল্যাংরুই ম্রোর নাতনি ও বড় ছেলের বড় মেয়ে জানান, ‘পাড়াবাসীরা মিলে আমার বাবা, দাদা ও চাচাদের কুপিয়ে হত্যা করেছে। আমাদের পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়েছে তারা। আমরা তাদের বিচার চাই।’
গ্যালেংগা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেনরত ম্রো বলেন, পাড়ার নারী ও পুরুষদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি, দীর্ঘদিন ধরে তাদের ধারণা ছিল, ল্যাংরুই ম্রো ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কোনও বিষয়ে বিবাদ হলে তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে পাড়াবাসীকে অসুস্থ কিংবা পঙ্গু করে দেন। এরই মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধে কয়েকজন অসুস্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তাই ক্ষুব্ধ হয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন পাড়াবাসী।
রুমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী রাকিব উদ্দিন বলেন, গ্রেফতার ২২ জন হত্যার কথা স্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, স্বপ্নে পাওয়া সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছেই জবাব দেবে তারা। মূলত কুসংস্কার এবং ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকেই একই পরিবারের পাঁচ জনকে হত্যা করা হয়। আদালতের মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত ২২ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অশোক কুমার পাল বলেন, স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশ ও তন্ত্রমন্ত্রের গুজব ছড়িয়ে বাবা ও চার ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করেছে পাড়াবাসী। তারা বিষয়টি স্বীকার করেছে এবং হত্যার কারণ জানিয়েছে। এরপরও আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। অন্য কোনও কারণ আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখছি।