স্বপ্ন ও চ্যালেঞ্জের টানেল এখন বাস্তবতা, আপ্লুত প্রকল্প কর্মকর্তা
বাংলাদেশ

স্বপ্ন ও চ্যালেঞ্জের টানেল এখন বাস্তবতা, আপ্লুত প্রকল্প কর্মকর্তা

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বাস্তবায়নে অসংখ্য নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। এমনকি টানা চার মাস কাজ বন্ধও রাখতে হয়েছিল। পরে বিদেশি বিশেষজ্ঞ দল এনে জটিলতা নিরসন করে এগিয়ে নিতে হয়েছে টানেলের কাজ। ছোট ছোট এমন হাজারও প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে শুধুমাত্র আন্তরিকতা ও উদ্যমের কারণেই নির্ধারিত সময়েই সম্ভব হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সুড়ঙ্গ সড়কের সফল বাস্তবায়ন। এই মেগা প্রকল্প উদ্বোধনের আগে বিশাল এই কর্মযজ্ঞের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন টানেলের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুন উর রশিদ।

বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) বিকালে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রবেশ মুখে তিনি এ কথা বলেন।

হারুন উর রশিদ বলেন, ‘টানেল প্রকল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি প্রকল্প কর্মকর্তা হিসেবে যুক্ত ছিলাম এখনও আছি। আমার ৪৪ বছর চাকরি জীবনের দীর্ঘ  অভিজ্ঞতায় বলে প্রত্যেকটি প্রকল্পের কমন কিছু সমস্যা থাকে। আমাদের দেশের জন্য সেটা হচ্ছে ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যা। ভূমি অধিগ্রহণ একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এখানে ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যাটা অন্যভাবে অনুভব করেছি। এটা একটি জি টু জি প্রজেক্ট। চীনের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয় তখন একটা ধারা ছিল প্রকল্পের কাজ শুরু করার আগেই প্রকল্পে যা জমি দরকার হবে সবই তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে হস্তান্তর করতে হবে। যেটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্ভব নয়। পরে এক্সিম ব্যাংকে আমরা বিষয়টি বুঝিয়ে এ সমস্যা সমাধান করেছি।’

এই প্রকৌশলী বলেন, ‘এর আগে বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা টানেলের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। দেশের বাইরে যারা গিয়েছেন তারা শুধু টানেল দেখেছেন কিংবা ভেতর দিয়ে গেছেন। টানেলের নির্মাণ কৌশল সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। আমাদের দেশের মাটির যে ধরন তাতে টানেল করা খুবই চ্যালেঞ্জিং। যেহেতু নরম মাটি। তবে শক্ত মাটিতে টানেল করা খুবই সহজ। এটা যেহেতু আমাদের প্রকৌশলীদের জন্য নতুন। আমরা দেখে দেখে শিখেছি। এখানে বিদেশি বিশেষজ্ঞরাও ছিলেন। তাদের সহায়তা নিয়ে আমরা বিভিন্ন সমস্যা অতিক্রম করেছি।’

তিনি বলেন, ‘টানেলের যখন উত্তর টিউবের খনন কাজ শুরু হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেছিলেন। টানেলের খনন কাজ যখন শুরু করি তখন পাঁচ শতাংশ যাওয়ার পর বিশেষজ্ঞ দল এবং আমরা একটা বিষয় অনুভব করি। খননের বোরিং মেশিন মাটির নিচের দিকে যাওয়ার পরিবর্তে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করে। এ কারণে চার মাসের মতো কাজ বন্ধ ছিল। মাটি নরম হওয়ার কারণে এটি হচ্ছে। শক্ত মাটি হলে এটা হতো না। পরে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ দল আসার পর এ সমস্যার সমাধান করেছি।’

হারুন উর রশিদ বলেন, ‘টানেলে দুটি টিউব। এর মধ্যে উত্তর টিউবটি প্রথমে খনন করা হয়। এ উত্তর টিউব খনন করতে আমাদের ১৭ মাস সময় লেগেছে। দক্ষিণ টিউব খননে সময় লেগেছে ১০ মাস। প্রথম টিউবে আমরা যেসব সমস্যায় পড়েছি সেসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ টিউবটি দ্রুত শেষ করতে পেরেছি।’

‘আর যেটি চ্যালেঞ্জিং ওয়ার্ক ছিল সেটি হল তিনটি ক্রস ম্যাসিস নির্মাণকাজ। যদিও দুটি টিউবের মধ্যে ৮০ মিটার পর পর ইমার্জেন্সি স্কেপ চ্যানেল আছে। তবে টানেল নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতায় এই চ্যালেঞ্জও বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়নি।’

হারুন উর রশিদ বলেন, ‘টানেল নির্মাণে অনেক শ্রমিক কাজ করেছে। তবে সেটি একেক সময়ে একেক রকম। যখন যে কাজটি করা হয়েছে তখন ওই কাজে দক্ষ শ্রমিকদের প্রকল্পে আনা হয়। প্রথম দিকে দৈনিক প্রায় আড়াই হাজারের মতো শ্রমিক কাজ করেছে। শেষের দিকে চাইনিজরা ৭০০-৮০০ জন কাজ করেছে। সব মিলিয়ে চাইনিজ এবং বাংলাদেশি শ্রমিক মিলে দৈনিক সাড়ে তিন হাজার মানুষ কাজ করেছে।’

তিনি বলেন, ‘যে দিন উদ্বোধন হবে সেদিন টানেল দিয়ে গাড়ি চলবে না। উদ্বোধনের পরদিন সকাল ৬টা থেকে গাড়ি চলাচল করবে। অতি উৎসাহী লোক যাতে টানেল পার হতে না পারে এ বিষয়ে আমরা সতর্ক থাকবো। এখন মেরামত খাতে যারা দায়িত্ব পেয়েছেন তারাই কাজ করছেন। আমাদের কাজ শেষ। গত ১ আগস্ট টানেল মেরামতে নিয়োজিত কর্মকর্তার কাছে আমরা টানেল হস্তান্তর করেছি। মেরামতের জন্য ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্য চুক্তি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আগামী পাঁচ বছর টানেল প্রকল্পটি দেখভাল করবেন।’

তিনি বলেন, ‘ছোট গাড়ির জন্য পতেঙ্গা প্রান্তে তিনটি এবং আনোয়ারা প্রান্তে তিনটি করে ছয়টি স্ক্যানার মেশিন বসানো হয়েছে। ভারী গাড়ির জন্য দুই প্রান্তেই একটি করে দুটি স্ক্যানার মেশিন বসানো হয়েছে। স্ক্যানারে আগ্নেয়াস্ত্র বা অন্যান্য বিস্ফোরক দ্রব্য নিতে চাইলে স্ক্যানারে সেটা ধরা পড়বে। অর্থাৎ এসব নিতে না দেওয়ার জন্যই এই স্ক্যানার বসানো হয়েছে।’

হারুন উর রশিদ বলেন, ‘টানেলে পায়ে হেঁটে পার হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। একইভাবে দুই চাকা এবং তিন চাকার গাড়ি এখানে চলতে দেওয়া হচ্ছে না। চলতে দেওয়াটাও উচিত হবে না। টানেলের ভেতর নেমে দাঁড়ানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে টানেল দিয়ে দৈনিক ১৭ হাজার গাড়ি পারাপার হওয়ার কথা রয়েছে। সেটা ২০৪০ সালে ৬২ হাজারে উন্নীত হবে। এ টানেল অর্থনীতিতে অনেক প্রভাব ফেলবে।’

‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরে টানেলটি নির্মাণ করা হয়েছে। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। চার লেন বিশিষ্ট দুটি টিউবের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। গত বছরের ২৬ নভেম্বর টানেলের দক্ষিণ প্রান্তের একটি টিউবের পূর্ত কাজের সমাপ্তি উদযাপন করা হয়েছে। এই উদযাপন অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া, মূল টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি ফ্লাইওভার থাকবে।’

২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। পরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ সুদে ৫ হাজার ৯১৩ দশমিক ১৯ কোটি টাকা দিচ্ছে। বাকি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন করা হবে আগামী শনিবার (২৮ অক্টোবর)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেল উদ্বোধন করবেন। ওই দিন সকাল ১০টায় নগরীর পতেঙ্গা প্রান্তে টানেলের নামফলক উন্মোচন করবেন তিনি। এরপর টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে কাফকো কলোনি সংলগ্ন কেইপিজেড মাঠে জনসভায় বক্তব্য দেবেন। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এ জনসভার আয়োজন করা হয়েছে।

Source link

Related posts

দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলবে অক্টোবরে

News Desk

‘দৌলতদিয়া ঘাটে গাড়িতেই ঘুম, গাড়িতেই খাওয়া’

News Desk

বন্যার্ত মা-বাবার খোঁজে রাবারের নৌকায় যাত্রা

News Desk

Leave a Comment