১০ই এপ্রিল ৭১ নির্বাচিত সাংসদগণ আগরতলায় একত্রিত হয়ে এক সর্বসস্মত সিদ্ধান্তে সরকার গঠন করেন। এই সরকার স্বাধীন সার্বভৌম ”গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার”। স্বাধীনতার সনদ (Charter of Independence) বলে এই সরকারের কার্যকারিতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হয়। ১৭ই এপ্রিল ৭১ মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়া গ্রামে বৈদ্যনাথ তলায় ”গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার” আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির এই সরকারের মন্ত্রী পরিষদ সদস্যদের শপথ পাঠ করান জাতীয় সংসদের স্পীকার অধ্যাপক ইউসুফ আলী। যে সমস্ত নেতৃবৃন্দকে নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় তাঁরা হলেনঃ
১। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তানে বন্দী)
২। উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি)
৩। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ (প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত)
৪। অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত)
৫। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ (আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত)
৬। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান (ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত)
এই অনুষ্ঠানে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসাবে (বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে) এবং কর্নেল এম এ জি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে সরকারী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দেশ বিদেশের শতাধিক সাংবাদিক ও হাজার হাজার দেশবাসীর উপস্থিতিতে এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাংসদ জনাব আবদুল মান্নান। নবগঠিত সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এই স্থানটির নামকরণ করা হয় ”মুজিব নগর”।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। রাজনৈতিকভাবে এই যুদ্ধকে সার্বজনীন করার লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সর্বসম্মতিক্রমে একটি ”সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ” গঠন করেন। এই উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেনঃ
ক) জনাব আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (সভাপতি)–ন্যাপ ভাসানী
খ) শ্রী মনি সিং (সভাপতি)–বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি
গ) অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ (সভাপতি)–ন্যাপ মোজাফ্ফর
ঘ) শ্রী মনোরঞ্জন ধর (সভাপতি)–বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস
ঙ) জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ (প্রধানমন্ত্রী)–পদাধিকারবলে
চ) খন্দকার মোশতাক আহমেদ (পররাষ্ট্রমন্ত্রী)–পদাধিকারবলে
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ৯ মাসব্যাপী সশস্ত্র এই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহ, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ সরকার প্রায় এক কোটি শরণার্থীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কূটনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমে বিশ্বের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতায় উপস্থাপনসহ এবং একটি সময় উপযোগী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের অত্যাচারে প্রায় এক কোটি বাঙালি দেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ভারত সরকার ও ভারতের জনগণ দেশত্যাগী এই জনগোষ্ঠীর সার্বিক সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা দান করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোয় কর্মরত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গঃ
১। যে সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রশাসনিক কাঠামোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনঃ
ক) রাষ্ট্রপতির পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা জনাব আবদুস সামাদ আজাদ, এম এন এ
খ) প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম, এম এন এ
গ) তথ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত জনাব আবদুল মান্নান, এম এন এ
ঘ) জয় বাংলা পত্রিকার উপদেষ্টা জনাব জিল্লুর রহমান, এম এন এ
ঙ) যুব শিবির নিয়ন্ত্রণ পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এম এন এ
২। বেসামরিক প্রশাসনঃ
ক) ক্যাবিনেট সচিব জনাব হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম)
খ) মুখ্য সচিব জনাব রুহুল কুদ্দুস
গ) সংস্থাপন সচিব জনাব নূরুল কাদের খান
ঘ) অর্থ সচিব জনাব খন্দকার আসাদুজ্জামান
ঙ) পররাষ্ট্র সচিব জনাব মাহাবুবুল আলম চাষী এবং জনাব আবুল ফতেহ
চ) প্রতিরক্ষা সচিব জনাব এম এ সামাদ
ছ) স্বরাষ্ট্র সচিব জনাব এ খালেক
জ) স্বাস্থ্য সচিব জনাব এস টি হোসেন
ঝ) তথ্য সচিব জনাব আনোয়ারুল হক খান
ঞ) কৃষি সচিব জনাব নুরউদ্দিন আহমেদ
ট) আইন সচিব জনাব এ হান্নান চৌধুরী
৩। কুটনৈতিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে যে সমস্ত ব্যক্তিবর্গ মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেনঃ
ক) মিশন প্রধান যুক্তরাজ্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (বহিঃর্বিশ্বে সরকারের বিশেষ দূত)
খ) মিশন প্রধান কলিকাতা জনাব হোসেন আলী
গ) মিশন প্রধান নতুন দিল্লী জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী
ঘ) মিশন প্রধান যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা জনাব এম আর সিদ্দিকী
ঙ) মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত ইরাক জনাব আবু ফতেহ
চ) মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত সুইজারল্যান্ড জনাব অলিউর রহমান
ছ) মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিলিপাইন জনাব কে কে পন্নী
জ) মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেপাল জনাব মোস্তাফিজুর রহমান
ঝ) মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত হংকং জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ
ঞ) মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত জাপান জনাব এ রহিম
ট) মিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত লাগোস জনাব এম এ জায়গীরদার
৪। স্বাধীন বাংলাদেশের গণমুখী প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো কি হবে সেই লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন
বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে পরিকল্পনা কমিশন একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে। যে সমস্ত উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি
এই পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন তাঁরা হলেনঃ
(ক) ডঃ মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী
(খ) ডঃ মোশারাফ হোসেন
(গ) ডঃ খান সরওয়ার মুরশিদ
(ঘ) ডঃ এম আনিসুজ্জামান
(ঙ) ডঃ স্বদেশ বোস।
৫। মুক্ত এলাকায় সুষ্ঠু প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা এবং ভারতে অবস্থান গ্রহণকারী শরণার্থীদের দেখাশুনা ও যুব শিবির পরিচালনার জন্য সরকার সমস্ত বাংলাদেশকে ১১টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করেন। প্রতিটি প্রশাসনিক এলাকায় চেয়ারম্যান ও প্রশাসক নিয়োগ করেন।