২০১৩ সালের ১১ আগস্ট মারা যান যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার মহিরন গ্রামের পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল গনি হাওলাদার। মারা যাওয়ার পর গত ১০ বছর ধরে তার পেনশন ভাতা তুলতে হিসাবরক্ষণ অফিস ও সাতক্ষীরা পুলিশের রিজার্ভ অফিসে ধরনা দিতে হচ্ছে আব্দুল গনির ষাটোর্ধ্ব স্ত্রী সূর্যবান বিবিকে। পেনশনের টাকার আশায় ঘুরতে ঘুরতে হতাশ গোটা পরিবারটি।
নিয়মানুযায়ী একজন সরকারি চাকরিজীবী অবসরে যাওয়ার পর মাসিক পেনশন ভাতা নিয়ে চলে তার পরিবার। ওই পেনশনভোগী মারা গেলে পেনশন পাবে উত্তরাধিকার হিসেবে তার স্ত্রী অথবা অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান থাকলে সেই সন্তান।
পরিবার জানায়, ২০০৬ সালের ৭ মার্চ সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ থেকে অবসর গ্রহণ করেন আব্দুল গনি। যার পিপিও নং-১৩৪১। পেনশন ভোগরত অবস্থায় ২০১৩ সালের ১১ আগস্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
মারা যাবার তিন মাস পর তার স্ত্রী সূর্যবান বিবি স্বামীর পেনশন তুলতে বাঘারপাড়া উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে যান। এ সময় তৎকালীন উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসার জিল্লুর রহমান মৃত আব্দুল গনির সকল কাগজপত্র জমা দিতে বলেন। অফিসের নিয়ম অনুযায়ী সকল কাগজপত্র জমা দিলেও কোনও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিস। দীর্ঘদিন ঘুরিয়ে হিসাবরক্ষণ অফিসার বলেন, ‘আপনার স্বামীর পেনশন সাতক্ষীরা পুলিশ রিজার্ভ অফিস থেকে মঞ্জুরি করিয়ে নিয়ে আসেন। তাহলে স্বামীর পেনশন ভাতা পাবেন, অন্যথায় পাবেন না।’
এরপর সরকারি নিয়ম অনুযায়ী মৃত পুলিশ সদস্যের স্ত্রী সূর্যবান বিবি সাতক্ষীরা পুলিশ রিজার্ভ অফিসে সকল কাগজপত্র জমা দেন। সেখানে পেনশন আবেদন জমা দিলে সাতক্ষীরা রিজার্ভ অফিস থেকে বাঘারপাড়া থানা পুলিশকে উত্তরাধিকার নির্ণয় সংক্রান্তে তদন্ত প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি দেয়।
বাঘারপাড়া পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদনে মৃত আব্দুল গনির অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনও সন্তানাদি নেই এবং তার স্ত্রী সূর্যবান বেগমকে পেনশনের উত্তরাধিকার হিসেবে দেখানো হয়। সূর্যবান বিবি পুলিশ প্রতিবেদন নিয়ে সাতক্ষীরা পুলিশ রিজার্ভ অফিসে গেলে নানাভাবে হয়রানি করে তাকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। বলা হয় বাঘারপাড়া উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে যেতে।
এরপর বাঘারপাড়া উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে গেলে সেখান দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলেন, ‘সাতক্ষীরা রিজার্ভ অফিস থেকে পেনশন মঞ্জুরির কাগজপত্র আসেনি।’
এভাবেই গত ১০ বছর ধরে বাঘারপাড়া উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিস ও সাতক্ষীরা পুলিশ রিজার্ভ অফিসে ঘুরছেন তিনি।
সূর্যবান বিবি জানান, এ পর্যন্ত সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার এবং ঢাকা পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ওয়েল ফেয়ার অ্যান্ড পেনশন বিভাগে মৃত স্বামীর পেনশন পাওয়ার জন্য আবেদন করেও কোনও সাড়া মেলেনি।
সর্বশেষ গত ২৭ অক্টোবর সাতক্ষীরা পুলিশ রিজার্ভ অফিসে গেলে তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আপনি কেন আসেন এ অফিসে? আমরা না ডাকলে আর আসবেন না।’
সূর্যবান বিবি বলেন, ‘স্বামী মারা যাবার পর থেকে নানা রোগে ভুগে এখন স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারি না। বাম হাত অচল প্রায়। আমার স্বামী ডিউটিরত অবস্থায় আসামি ধরতে গিয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেন এবং তারপরই সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ থেকে অবসরে যান। তার মৃত্যুর পর থেকে পেনশন পেতে বাঘারপাড়া হিসাবরক্ষণ অফিস ও সাতক্ষীরা পুলিশ রিজার্ভ অফিসে ছোটাছুটি করে আমিও মৃত্যুপথযাত্রী।’
এ বিষয়ে বাঘারপাড়া উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসার শাহানা আক্তার বলেন, ‘মৃত পেনশনারের স্ত্রীর সকল কথা শুনে সাতক্ষীরা জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে যোগাযোগ করেছি। সর্বশেষ সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার বরাবর পেনশন মঞ্জুরির ব্যাপারে লিখিত পাঠিয়েছি। তিন মাস হতে চলেছে এখনও সাতক্ষীরা থেকে ওই পত্রের কোনও জবাব আসেনি।’
তিনি বলেন, ‘পেনশন আইনে আছে একজন পেনশনারের মৃত্যুর ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হয়। মঞ্জুরির কাগজপত্র সাতক্ষীরা হতে পাওয়ামাত্রই দুই দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করবো।’
এ বিষয়ে কথা হয় সাতক্ষীরা রিজার্ভ অফিসের আরও-ওয়ান (এসআই) লিটন বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এমন একটি বিষয় কিন্তু আমি জানি না। ওনাকে (নিহতের স্ত্রী) অথবা তার সন্তানকে কাগজপত্র নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।’