লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষাসহ বায়োমেট্রিক এনরোলমেন্টের মাধ্যমে পাস করে সরকারের নির্ধারিত ফি জমা দিয়েও স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ড পাচ্ছেন না ময়মনসিংহের চালকরা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ময়মনসিংহ কার্যালয় তিন-চার বছর ধরে স্মার্ট কার্ড দিচ্ছে না বলে অভিযোগ তাদের। এই সময়ের মধ্যে মেয়াদ চলে যাওয়ায় অনেককে নতুন করে আবেদন করতে হয়েছে। এ অবস্থায় সড়কে যানবাহন চালাতে গিয়ে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চালকরা।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রতি বছর অন্তত সাত লাখ স্মার্ট কার্ড প্রয়োজন। আগের ঘাটতি আছে আরও আট লাখ। এর সঙ্গে চুক্তি পরিবর্তনের সময় প্রায় ১২ লাখ আবেদন জমা পড়েছিল। চলতি বছর গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করতে হলে অন্তত ২৭ লাখ কার্ড প্রয়োজন। অথচ গত সাড়ে তিন বছরে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মাত্র ১৬ লাখ কার্ড পেয়েছে বিআরটিএ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৯ জুলাই ডুয়েল ইন্টারফেস পলিকার্বনেট স্মার্ট কার্ড তৈরির জন্য ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স (এমএসপি) প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে বিআরটিএ। চুক্তির দিন থেকে পরবর্তী তিন বছর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ২৪ লাখ কার্ড সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু সাড়ে তিন বছরে কার্ড সরবরাহ করেছে মাত্র ১৬ লাখের মতো। চুক্তির দিন থেকে ২০২৫ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি কাজ করবে। এই পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ৪০ লাখ কার্ড প্রিন্ট করে সরবরাহ করার কথা আছে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে চাহিদা অনুযায়ী কার্ড না পাওয়ায় সরবরাহ করতে পারছে না বিআরটিএ।
আসলাম মিয়া ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে চলাচলকারী সৌখিন পরিবহনের চালক। জেলা সদরের এই বাসিন্দা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষাসহ বায়োমেট্রিক এনরোলমেন্টের মাধ্যমে পাস করেছি। এরপর সরকার নির্ধারিত ফি বিআরটিএর কার্যালয়ের মাধ্যমে ব্যাংকে জমা দিয়েছি। ইতোমধ্যে পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। এখনও স্মার্ট কার্ড পাইনি। এর মধ্যে মেয়াদ চলে যাওয়ায় আবারও আমাকে ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করতে বিআরটিএ কার্যালয়ে যেতে হয়েছে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। এই কার্ড কবে পাবো জানি না। গত পাঁচ বছর ধরে এ নিয়ে ভোগান্তির মধ্যে পড়ে আছি। সড়কে নামলে ট্রাফিক পুলিশ স্মার্ট কার্ড না পেলে হয়রানি করে, অনেক সময় তাদের অর্থ দিয়ে গাড়ি ছাড়াতে হয়। ময়মনসিংহের শত শত পেশাদার চালক আমার মতো সমস্যায় পড়েছেন।’
হালুয়াঘাট-ঢাকা সড়কে যাতায়াতকারী শ্যামলী পরিবহনের চালক কামরুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তিন বছর হয়ে গেছে, এখনও স্মার্ট কার্ড পাচ্ছি না। কেন সময়মতো দেওয়া হচ্ছে না এর উত্তর বিআরটিএর কার্যালয় থেকেও পাওয়া যাচ্ছে না। কার্ডের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। আবার আবেদন করতে হয়। বিআরটিএর কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। এখান থেকে টোকেন দেওয়া হলেও তা গ্রহণ করতে চায় না ট্রাফিক পুলিশ। হয়রানির শিকার হচ্ছি। দ্রুত সময়ে কার্ড দেওয়ার দাবি জানাই।’
একই ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন মুক্তাগাছা-ঢাকা সড়কে চলাচলকারী ইমাম পরিবহন বাসের চালক কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি পেশাদার চালক। দুই বছর আগে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিলাম। ব্যাংকে টাকাসহ প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জমা দিয়েছি। ইতোমধ্যে দুই বছর পার হয়ে গেলেও এখনও স্মার্ট কার্ড পাইনি। কার্ডের জন্য বিআরটিএর কার্যালয়ে কয়েকবার গিয়েছি। কবে দেবে, তাও বলছেন না কর্মকর্তারা। এ অবস্থায় সড়কে নামলেই ট্রাফিক পুলিশের কাছে হয়রানির শিকার হতে হয়।’
ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে যাতায়াতকারী ট্রাকচালক পাভেল হোসেন বলেন, ‘স্মার্ট কার্ড সঙ্গে না থাকায় সড়কে গাড়ি চালাতে গেলেই নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। বিআরটিএর কার্যালয় থেকে দেওয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্লিপ ট্রাফিক পুলিশকে দেখালে মানতে চায় না। তাদের নগদ টাকা দিয়ে গাড়ি ছাড়াতে হয়।’
শুধু তারা নন, ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করতে গিয়ে বিআরটিএর কার্যালয়ে মাসের পর মাস ঘুরছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। মাস পেরিয়ে বছর গড়ালেও কাঙ্ক্ষিত ড্রাইভিং লাইসেন্স পাচ্ছেন না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ বিআরটিএর সহকারী পরিচালক এস এম ওয়াজেদ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সময়মতো ঢাকা থেকে স্মার্ট কার্ড আমাদের অফিসে এসে পৌঁছায় না। এ কারণে চালকদের সরবরাহ করতে পারছি না। দুই-তিন বছর পার হয়ে গেছে, এখনও স্মার্ট কার্ড পাননি এমন অনেক চালক আছেন। হিসাবে এক হাজার ১৫০ জন চালকের স্মার্ট কার্ড আটকে আছে।’
কেন আটকে আছে, কবে নাগাদ পাবে জানতে চাইলে ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘তা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। কারণ ঢাকার বিআরটিএ অফিস থেকে আমাদের এ বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। যতটুকু জানি, স্মার্ট কার্ডের উপাদান বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আমদানি সমস্যার কারণে সরবরাহে সমস্যা তৈরি হয়েছে। ঢাকা থেকে প্রিন্ট হয়ে আসলেই চালকদের স্মার্ট কার্ড সরবরাহ করবো আমরা।’