চট্টগ্রামে হরতাল-অবরোধে গাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ সহিংসতার ঘটনা বেড়েই চলেছে। সহিংসতার ঘটনাকে ঘিরে জনমনে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ২৯ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া হরতাল-অবরোধে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে নগরী ও জেলায় ১৯টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। যদিও ফায়ার সার্ভিসের হিসেবে আগুন লাগা গাড়ির সংখ্যা ১৩টি। এ সময় গাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ নানা সহিংস ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নগরী ও জেলায় মামলা হয়েছে ৫৪টি। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ৯২৪ জনকে।
জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ করতে না পারার প্রতিবাদে ২৯ অক্টোবর সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেয় বিএনপি। এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে জামায়াত ইসলামীসহ অন্যান্য সমমনা দল। এরপর ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত চলে প্রথম দফায় অবরোধ কর্মসূচি, দ্বিতীয় দফায় ৫ নভেম্বর সকাল ৬টা থেকে ৭ নভেম্বর সকাল ৬টা পর্যন্ত অবরোধ, তৃতীয় দফায় ৮ ও ৯ নভেম্বর, চতুর্থ দফায় ১২ ও ১৩ নভেম্বর এবং পঞ্চম দফায় ১৫ ও ১৬ নভেম্বর অবরোধ ঘোষণা করা হয়। পরে রবিবার (১৯ নভেম্বর) ভোর ৬টা থেকে মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) ভোর ৬টা পর্যন্ত দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেয় দলটি।
৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত প্রথম দফায় অবরোধ কর্মসূচিতে চট্টগ্রামে ৯টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এরমধ্যে অবরোধের আগের দিন ৩০ অক্টোবর রাত ৯টা ৫০ মিনিটে নগরীর খুলশী থানার জিইসি মোড়ের কে স্কয়ারের সামনে বরযাত্রীবাহী একটি মিনিবাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৩১ অক্টোবর ভোর ৪টায় বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন ট্যানারি বটতল এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওইদিন সকাল ৬টায় ইপিজেড থানাধীন সলগোলা ক্রসিং এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ১ নভেম্বর ভোরে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নের চৌধুরী গোট্টা এলাকায় পাথরবোঝাই দুটি ট্রাক এবং একটি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া হয়। ওইদিন সকালে কর্ণফুলী থানাধীন পোশাক শ্রমিকদের বহন করা একটি বাস আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দুপুরের দিকে সীতাকুন্ডের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একটি রড বোঝাই লরিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
দ্বিতীয় দফায় ৫ নভেম্বর সকাল ৬টা থেকে ৭ নভেম্বর সকাল ৬টা পর্যন্ত অবরোধে তিনটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এরমধ্যে ৫ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টায় নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন অক্সিজেন মোড়ের রেলবিট এলাকায় একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৬ নভেম্বর ভোরে নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন আতুরার ডিপো এলাকায় চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা একটি সিএনজি অটোরিকশায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। একইদিন ভোরে জেলার আনোয়ারা উপজেলার চাতুরী চৌমুহনী এলাকায় পাকিংয়ে থাকা একটি বাস আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
১৯ নভেম্বর ভোর ৬টা থেকে ২০ নভেম্বর ভোর ৬টা পর্যন্ত ডাকা হরতালে ৭টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এরমধ্যে ১৯ নভেম্বর ভোরে মীরসরাইয়ে দুটি কাভার্ডভ্যানে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর আগের দিন ১৮ নভেম্বর রাতে নগরীর পাহাড়তলী এলাকায় একটি রেলব্রিজে আগুন দেওয়া হয়। ওই দিন নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন বহদ্দারহাট এলাকায় একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। একই দিন কর্ণফুলী থানাধীন নতুন ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় একটি পিকআপ ভ্যানে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
২০ নভেম্বর ভোর ৪টায় সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়া এলাকায় নিজস্ব ডিপোতে থাকা শ্যামলী পরিবহনের দুটি এবং হানিফ পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়।
এদিকে, ১৯ নভেম্বর মধ্যরাতে রহস্যজনকভাবে গাড়ির গ্যারেজে আগুন লাগে। এতে আগুনে পুড়েছে ২০টি সিএনজি অটোরিকশা, ৫টি মোটরসাইকেল ও একটি রিকশা। এটি নাশকতার ঘটনা হতে পারে বলে মনে করছে স্থানীয়রা। হালিশহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কায়সার হামিদ বলেন, ‘আগুন লাগার বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। নাশকতার ঘটনা হয়ে থাকলে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক এম এ মালেক বলেন, ‘২৮ অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগে ২০টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এরমধ্যে আগুনে পুড়েছে ১০টি বাস, ৫টি ট্রাক, ৩টি কাভার্ডভ্যান, একটি লেগুনা এবং একটি লরি। ২০টি গাড়ির মধ্যে ১৩টি চট্টগ্রামে, ফেনীতে দুটি, খাগড়াছড়িতে দুটি, নোয়াখালীতে একটি, চাঁদপুরে একটি এবং কুমিল্লায় একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।’
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির দফতরে দায়িত্বরত মো. ইদ্রিস আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২৮ অক্টোবরের পর পুলিশ অত্যন্ত মারমুখী হয়ে উঠেছে। প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না। নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হানা দিচ্ছে। ছেলেকে না পেলে পিতাকে, ভাইকে না পেলে আরেক ভাইকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।’
তিনি আরও বলেন, ‘২৮ অক্টোবরের পর থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নগরী ও জেলায় ৫৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ৯২৪ জনকে। এরমধ্যে মহানগরে মামলা হয়েছে ২০টি। গ্রেফতার করা হয়েছে ৪৩৪ জনকে। উত্তর জেলার আওতাধীন থানাগুলোতে মামলা হয়েছে ১৯টি। গ্রেফতার করা হয়েছে ২৫০ জনকে। একইভাবে দক্ষিণ জেলার আওতাধীন থানাগুলোতে ১৫টি মামলা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ২৪০ জন নেতাকর্মীকে।’
সীতাকুন্ড থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অর্থনীতির লাইফলাইন। এ সড়ক দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সারা দেশে পণ্য আনা-নেওয়া করা হয়। এবার এ সড়কে যাতে পণ্য পরিবহন সচল থাকে এজন্য সীতাকুন্ডের অংশে আমরা ব্যাপক নজরদারির মধ্যে রাখি। যে কারণে এখন পর্যন্ত আমরা এ সড়ক সচল রাখতে পেরেছি। নাশকতা প্রতিরোধে পোশাকের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।’
চান্দগাঁও থানার ওসি জাহিদুল কবির বলেন, ‘বহদ্দারহাট মোড়ে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।’
বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি ফেরদৌস জাহান বলেন, ‘বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন অক্সিজেন মোড়ে গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়। এ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।’
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, ‘আমাদের সমিতির আওতাভুক্ত বেশ কয়েকটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকার বলেছে ক্ষতিপূরণ দেবে। আমরা এখনও আইনি পক্রিয়া শেষ করে গাড়িগুলো নিজেদের হেফাজতে নিতে পারিনি। এগুলো পাওয়ার পর আমরা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘হরতাল-অবরোধেও আমরা গাড়ি চালাচ্ছি, চালিয়ে যাবো। আমাদের মধ্যে কোনও আতংক নেই।’