বান্দরবান সদর হাসপাতালের জেনারেটর না চললেও প্রতিমাসে বিল দেখানো হয়েছে। এই বিলের টাকা ভাগভাটোয়ারা করেন হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা। সরেজমিন অনুসন্ধান করে এ তথ্য জানা গেছে।
হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, ২০২০ সাল থেকে লোডশেডিং থাকলে রবি ও বৃহস্পতিবার অপারেশনের সময় জেনারেটর চালু করা হয়। তবে বিদ্যুৎ থাকলে জেনারেটর চালানো হয় না। তারপরও নিয়মিত বিল বানিয়ে প্রতিমাসে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে সরকারি অর্থ। এই অর্থ ভাগবাটোয়ারা করছেন হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা। গত দুই বছর ধরে এভাবে চলে আসছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানানন, অক্টোবর থেকে জেলায় শীতের মৌসুম শুরু হয়। এ সময় দিনের বেলায় জেনারেটর চালানোর প্রয়োজন হয় না। কারণ শীত মৌসুমে বিদ্যুৎ যায় না। এছাড়া বান্দরবানে লোড শেডিংও কম। গুরুতর রোগী না থাকলে অপারেশন থিয়েটার (ওটি) চলে না। আবার বিদ্যুৎ থাকলে ওটি চললেও জেনারেটরের প্রয়োজন পড়ে না। এরপরও বড় ধরনের জেনারেটর বিল দেখানো হয়। এমন দুর্নীতি করে হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করছেন।
২০২১ সালের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের জেনারেটর বিলের কাগজ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অক্টোবরে ১১৫ লিটার, নভেম্বরে ১৪৬ লিটার ও ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪৬ লিটার ডিজেল খরচের বিল দেখানো হয়। বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী তিন মাসে ডিজেলের বিল হয়েছে ৩২ হাজার ৫৬০ টাকা।
এছাড়া ২০ নভেম্বর জেনারেটরে ১০ লিটার মবিল এবং নতুন মবিল ফিল্টার দেওয়ার বিল করা হলেও, তার সত্যতা মেলেনি। বিলের হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়, দুই-একদিন ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই জেনারেটর চালু রাখা হয়েছে। অথচ অনুসন্ধানে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি।
গত ২৯ নভেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকা তসলিমা আক্তার জানান, তিনি হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন একদিনও জেনারেটর চালু করতে দেখেননি। এই সময়ে বিদ্যুৎ যায়নি।
অথচ নভেম্বরের ৩০ থেকে ডিসেম্বরের ৯ তারিখ পর্যন্ত ১৯ ঘণ্টা জেনারেটর চালু রাখার বিল করা হয়েছে। এর বিপরীতে তেল খরচ দেখানো হয়েছে ৯৫ লিটার। তবে বিলের মধ্যে জেনারেটর চলার সময় দেখানো হয়েছে, প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে। বিকালে বা রাতে জেনারেটর চালানো হয়নি। অথচ এই সময়ে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে কারও অপারেশনের কথা উল্লেখ নেই।
বান্দরবান বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের দেওয়া জেনারেটর বিলের সময় কখনও লোডশেডিং ছিল না। বিশেষ কারণ ছাড়া কখনও বান্দরবানে লোডশেডিং হয় না। বিদ্যুৎ থাকার পরও হাসপাতালে জেনারেটরে বিল আসা নিয়ে বিস্মিত বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।
হাসপাতালের প্রধান অফিস সহকারী শুভাষ দাশ জানান, হাসপাতালের জেনারেটরটি অটোমেটিক। বিদ্যুৎ চলে গেলে অটোমেটিক চালু হয়ে যায়। কর্মচারী না থাকায় রাতে জেনারেটর চালানো সম্ভব হয় না। লোডশেডিংয়ের সঙ্গে জেনারেটর চালানোর সম্পর্ক নেই। জেনারেটর চালানোর একটা আলাদা নিয়ম আছে। আমরা সেটা ফলো করি। তবে কোন ধরনের নিয়ম আছে তা বলেননি শুভাষ দাশ।
হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, জেনারেটর যদি অটোমেটিক চালু হয়, তাহলে প্রতিদিন শুধু সকালে কেন চালু হয়? রাতের বেলায় চালু হয় না কেন? রাতে কি তাহলে লোডশেডিং হয় না? বিষয়টি তদন্ত করলে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতরা ধরা পড়বে।
হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, জেনারেটর কক্ষ তালাবদ্ধ। চাবি না থাকায় খুলতে পারেননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কার কাছে চাবি তাও জানে না কর্তৃপক্ষ। জানালা দিয়ে ছবি তোলার সময় দেখা যায়, জেনারেটরসহ পুরো কক্ষ মাকড়সার জালে ঘেরা। জেনারেটরের ওপরে এবং ইঞ্জিনের পাইপে দেখা যায় ধুলাবালি। ২০ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বেশ কয়েকবার হাসপাতালে জেনারেটর চালু থাকতে দেখা যায়নি।
বান্দরবান বিদ্যুৎ বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সাদেকুর রহমান বলেন, গত তিন মাসে বান্দরবানে লোডশেডিং একদমই হয়নি। শীত মৌসুমে লোডশেডিং হয় না সবাই জানি। বছরের অন্যান্য মাসেও এখানে লোডশেডিং কম হয়। তবে কোনও কারণে দুই-একদিন বিদ্যুৎ বন্ধ করা হলেও তা পূর্ব ঘোষণার মাধ্যমে জানানো হয়।
এ বিষয়ে বান্দরবানের সিভিল সার্জন ডা. নিহার রঞ্জন নন্দী বলেন, কয়েকদিন হলো আমি এখানে যোগদান করেছি। হাসপাতালের জেনারেটর বিল নিয়ে অনিয়ম হচ্ছে কিনা তা অবশ্যই খতিয়ে দেখবো। কোনও ধরনের অনিয়মের সুযোগ দেবো না। এই অনিয়মটি আগের সিভিল সার্জনের সময়ে হয়েছে। আমি যোগদানের পর থেকে সবকিছু নতুনভাবে তদারকি করছি। এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেবো।