হাসপাতালের ভেতরেও চুরি-ছিনতাই, রোগী ভাগালেই ২ হাজার টাকা কমিশন
বাংলাদেশ

হাসপাতালের ভেতরেও চুরি-ছিনতাই, রোগী ভাগালেই ২ হাজার টাকা কমিশন

ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের যেন ভোগান্তির শেষ নেই। হাসপাতালের বারান্দায় ও সিঁড়িতে চিকিৎসা দেওয়া, সরকারি ওষুধ না পাওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠানো, অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট ও চিকিৎসকদের কমিশন বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এসব কারণে সঠিক চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে বিপাকে রয়েছেন রোগীরা। এ নিয়ে ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের চতুর্থ পর্বে থাকছে সংঘবদ্ধ দালাল ও চোর-ছিনতাইকারীদের হয়রানির চিত্র। 

সংঘবদ্ধ দালাল ও চোর-ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন এই হাসপাতালে আসা রোগী এবং তাদের স্বজনরা। সরকারি এই হাসপাতাল থেকে ভাগিয়ে এক রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি করালে দুই-তিন হাজার টাকা কমিশন পায় দালালরা। পাশাপাশি হাসপাতালের ওয়ার্ডের ভেতরেই ঘটছে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা। এসব নিয়ে সবসময় আতঙ্কে থাকেন রোগীরা।

রোগী ও তাদের স্বজনরা জানিয়েছেন, দিনরাতে হাসপাতালে দালাল চক্রের সদস্যদের দেখা যায়। দালালরা হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ওয়ার্ড কিংবা জরুরি বিভাগের সামনে থেকে নিয়ে যায় প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখানে গিয়ে রোগীরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। পাশাপাশি চোর-ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা হাসপাতালের আউটডোর এবং ওয়ার্ডে ঢুকে রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইলসহ জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নীরব।

দালালের কাছে প্রতারিত হওয়া রোগীর স্বজন ফুলপুরের সাহাপুরের কামরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ভাবি সাহেলা বেগমের সন্তান প্রসবের জন্য গত ২০ নভেম্বর সন্ধ্যার দিকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাই। জরুরি বিভাগের চিকিৎসককে দেখানোর পর ভর্তি টিকিট নিয়ে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঢোকার সময় দালাল চক্রের তিন সদস্য এগিয়ে এসে বলে রাতে হাসপাতালে ডাক্তার থাকেন না, অপারেশন হয় না। এখন অপারেশন না করালে নবজাতকের ক্ষতি হবে। এমন ভয় দেখিয়ে আমাদের হাসপাতালের সামনের প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে অপারেশন করানোর কথা বলে। আমার বড় ভাই সহজ-সরল মানুষ, কৃষিকাজ করেন। দালালদের কথা শুনে তাদের সঙ্গে চলে যান হাসপাতালের সামনের গলির জননী নার্সিং হোমে। সেখানে ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতে ভাবিকে ভর্তি করার পর রাতেই সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়। পরে ক্লিনিক ও দালালরা নানা কথা বলে আরও ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে রোগীকে রিলিজ করে দেয়। আমার ভাবি এখনও সুস্থ হননি। তিন দিন আগে তাকে ফুলপুরের এক গাইনি চিকিৎসককে দেখালে জানান, দামি ইনজেকশনসহ অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ায় রোগী এখনও সুস্থ হয়নি। প্রতিদিন এভাবে গ্রামের মানুষজন প্রতারিত হচ্ছেন। ভুল চিকিৎসায় শারীরিক সমস্যায় পড়ছেন।’

হাসপাতালের ওয়ার্ডের ভেতরেই ঘটছে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা, এসব নিয়ে সবসময় আতঙ্কে থাকেন রোগীরা

প্রতারণার শিকার ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া গ্রামের অটোরিকশাচালক আব্দুস সালাম বলেন, ‘আমার শ্বশুর আব্দুল করিমের (৬৫) পিত্তথলিতে পাথর এবং পেটব্যথা হওয়ায় ময়মনসিংহ হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করাই। ভর্তির পর চিকিৎসক বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন। চিকিৎসা চলতে থাকে। এর মধ্যে চিকিৎসক বলেন অপারেশন করতে কিছুদিন সময় লাগবে, একটু ধৈর্য ধরেন। পরে হাসপাতালের সামনে চরপাড়া এলাকার রাজীব হোসেন নামে এক দালালের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। ওই দালাল আমার শ্বশুরকে অনেক কিছু বোঝায়। দালাল বলেছিল হাসপাতালে যে ডাক্তার আপনাকে দেখেছেন, তিনি বাইরের ক্লিনিকে অপারেশন করবেন। যেদিন করাতে চান সেদিনই করবেন। সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ডে মাসের পর মাস অপারেশনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। দালালের কথা শুনে আমার শ্বশুর অস্থির হয়ে যান। ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতে অপারেশনের জন্য দালাল আমার শ্বশুরকে হাসপাতালের সামনের চরপাড়া উত্তরা প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে। ওই দিন রাতেই অপারেশন করা হয়। রক্ত ও দামি ওষুধ দেওয়ার কথা বলে আরও পাঁচ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন হাসপাতালের মালিক। তিন দিনের মাথায় শ্বশুরকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।’ 

এখনও শ্বশুরের শরীর পুরোপুরি ভালো হয়নি জানিয়ে আব্দুস সালাম আরও বলেন, ‘পেটে ব্যথা এখনও আছে। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া গ্রামের সহজ-সরল রোগীদের ফুসলিয়ে দালালরা অবৈধভাবে গড়ে ওঠা রেজিস্ট্রেশনবিহীন প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যায়। তারা রোগীদের প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করে কমিশন নিয়ে সটকে পড়ে। তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আর এসব ক্লিনিকে চিকিৎসা নেওয়ার পর নানা শারীরিক সমস্যায় ভোগেন রোগীরা। এগুলো রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়।’

শুধু দালাল নয়, হাসপাতালের আউটডোর এবং ইনডোরে চোর-ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন রোগী ও স্বজনরা। চার চক্রের সদস্যরা বিশেষ করে নারীরা বোরকা পরে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর আউটডোরের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা রোগী ও স্বজনদের ব্যাগ থেকে কৌশলে টাকা, মোবাইল এবং গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। একইভাবে ওয়ার্ডের ভেতরে চক্রের সদস্যরা রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে কৌশলে টাকা, স্বর্ণালঙ্কার এবং মোবাইলসহ জিনিসপত্র নিয়ে যায়।

দালালদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন এই হাসপাতালে আসা রোগীরা

হাসপাতালে আসা এক রোগীর স্বজন ফয়সাল আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত সপ্তাহে আমার ভাবি শেফালী আক্তার পেটের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালের ১০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হন। ওয়ার্ডে জায়গা না পেয়ে বারান্দায় বিছানা পেতে চিকিৎসা নেন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ায় তার ব্যাগ থেকে টাকা ও মোবাইল চুরি করে নিয়ে যায় চোরেরা। পরে শুনেছি আরও কয়েকজনের মোবাইল ও টাকা চুরি হয়েছে। এরকম প্রায়ই দিন হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের টাকা, মোবাইল ও জিনিসপত্র চুরির ঘটনা ঘটছে।’

হাসপাতালের ওয়ার্ড এবং আউটডোর-ইনডোরে চোর চক্রের সদস্যরা সবসময় সক্রিয় বলে জানালেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ শফিকুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘তবে মাঝেমধ্যে চোর ও ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যদের আটক করে থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি পুলিশ এবং আনসার সদস্যরা চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা কমিয়ে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।’

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) চিকিৎসক মাইন উদ্দিন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এক হাজার শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন তিন হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেন। পাশাপাশি আউটডোরে প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজার রোগী চিকিৎসা নেন। রোগীদের সঙ্গে একজন কিংবা দুজন করে স্বজন আসছেন। বিপুল সংখ্যক এই মানুষের ভেতরে দালাল এবং চোর চক্রের সদস্যরা সুযোগ বুঝে চুরি করে থাকে। তবে এসব ঘটনা রোধে আমরা তৎপর আছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে চোর ও দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।’

Source link

Related posts

খুলনা বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় ৪০ জনের মৃত্যু

News Desk

মীরসরাইয়ের ঝরনাগুলো যেন মৃত্যুকূপ, সাত বছরে প্রাণ হারিয়েছেন ২৩ পর্যটক

News Desk

‘৬ ঘণ্টায় কুমিল্লা থেকে পৌঁছাতে পারিনি ঢাকায়’

News Desk

Leave a Comment