যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে কক্সবাজারের হিমছড়ি ঝরনা এবং ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে এখানে দিন দিন কমছে পর্যটকের আগমন। পাহাড়ে ওঠার সুবিধার্থে নির্মিত সিঁড়ি, রেলিং ও চলাচলের রাস্তাটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এগুলো। গত ১২ বছরেও সংস্কার হয়নি। এসব কারণে হিমছড়ি ঝরনা ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে।
পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কক্সবাজার শহর থেকে দক্ষিণ দিকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে আট কিলোমিটার গেলে দেখা যায় হিমছড়ি ঝরনা। এর পাশের পাকা সিঁড়ি বেয়ে হিমছড়ি পাহাড়চূড়ায় উঠলে চোখে পড়ে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র। পাহাড়, সমুদ্র ও ঝরনা মিলে এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সমুদ্র তীরবর্তী পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনার পানি দেখতে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে সবসময়। অথচ পর্যটনকেন্দ্রটি এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ি, রেলিং ও চলাচলের রাস্তাটি ভেঙে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। গত ১২ বছরেও এগুলোর সংস্কার হয়নি। পাশাপাশি পাহাড়ের ওপরে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার স্তূপে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এসব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পর্যটকরা।
পর্যটনকেন্দ্র সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। একদিকে পাহাড়, অপরদিকে বালুময় সৈকতের বুক চিরে নির্মিত হয়েছে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক। এই সড়ক দিয়েই শহর থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দক্ষিণে গেলেই দেখা যায় হিমছড়ি ঝরনা ও ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র।
পর্যটকরা বলছেন, ঝরনার উত্তর পাশের পাহাড়ে উঠতে বন বিভাগ নির্মাণ করেছে দীর্ঘ একটি সিঁড়ি। ৩৫ টাকায় টিকিট কেটে সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ে উঠে সৌন্দর্যের পাশাপাশি সমুদ্রের মনোরম দৃশ্য দেখেন পর্যটকরা। অথচ সিঁড়িটি এখন মৃত্যুফাঁদ। দুই পাশের রেলিং ও একমাত্র চলাচলের রাস্তাটি ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। সঙ্গে রয়েছে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। এতে দূষিত হচ্ছে পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রতিদিন ইজারাদারের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করলেও ভেঙে যাওয়া সিঁড়ি, রেলিং ও রাস্তা মেরামতের কোনও উদ্যোগ নেননি সংশ্লিষ্টরা। সিঁড়ি ও রাস্তা দ্রুত মেরামত না করলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা আছে।
হিমছড়ি ঝরনা ও ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে হিমছড়িসহ আশপাশের অনেক পর্যটনকেন্দ্র ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তী সময়ে হিমছড়িকে সংস্কার করা হলেও পুরোনো সিঁড়ি আবারও নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। সর্বশেষ ২০১২ সালের দিকে এগুলো সংস্কার করা হয়েছিল। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক এখানে ভ্রমণে আসেন। ভাঙা রাস্তা দিয়ে পর্যটকরা ওঠানামা করেন। তাই এগুলো দ্রুত সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছেন পর্যটকরা।
দুর্ঘটনার শঙ্কার কথা জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা পর্যটক দম্পতি পারভেজ আলম ও মিলি আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কক্সবাজার ভ্রমণের অংশ হিসেবে হিমছড়িতে এসেছি। আসার পর মনে হলো হিমছড়ি ঝরনা ও ইকোট্যুরিজমের সিঁড়ি দিয়ে পাহাড়ে উঠবো। কিন্তু উঠতে গিয়ে বাধে বিপত্তি। পুরো সিঁড়ি ভাঙা। সেইসঙ্গে ভেঙে গেছে রেলিংও। এতে যেকোনো সময় প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে পর্যটকদের।’
আরেক পর্যটক আরেফিন শুভ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হিমছড়ি ঝরনা ও ইকোট্যুরিজম ঘুরে দেখার জন্য ২০ টাকা ফি নির্ধারণ করেছে সরকার। অথচ নেওয়া হয় ৩৫ টাকা। এরপরও মনে হলো টাকা দিয়ে জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলছি। কারণ দীর্ঘ সিঁড়িটি ভাঙা। আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে পাহাড়ের ওপরে এসে দেখার কিছু নেই। শুধুমাত্র ওপর থেকে সমুদ্র দেখা যায়। এত ঝুঁকি নিয়ে এসে একেবারেই হতাশ হলাম।’
পর্যটক শফিউল করিম বলেন, ‘অনেক আগ্রহ নিয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠলাম। কিন্তু ওঠার সময় দেখি রাস্তাটি ভাঙাচোরা। এতে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার শঙ্কা বেশি। এগুলো দ্রুত সংস্কার করা জরুরি।’
হার্টের রোগী কিংবা বৃদ্ধদের পাহাড়ে না উঠার পরামর্শ দিয়ে রাজশাহী থেকে আসা পর্যটক পাভেল চৌধুরী বলেন, ‘পাহাড়ের ওপরে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। পাহাড়ের ওপরে থাকা দোকানি ও পর্যটকরা যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলছেন। এতে হুমকিতে পড়ছে পরিবেশ। বিশেষ করে এসব ময়লা-আবর্জনা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ফলে পর্যটকরা ভবিষ্যতে হিমছড়ি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হিমছড়ি ঝরনা ও ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের ম্যানেজার জাফর আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভেঙে যাওয়া সিঁড়ির রেলিংয়ে লোহার বদলে কাঠ দেওয়া হয়েছে। ময়লা-আবর্জনাও প্রতিদিন পরিষ্কার করা হয়। পর্যটকদের চলাচলের একমাত্র রাস্তা ও রেলিং সংস্কারের বিষয়টি বন বিভাগকে জানানো হয়েছে। তবে গত ১০-১২ বছর ধরে এগুলো সংস্কার না হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’
হিমছড়ি ঝরনা ও ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের সিঁড়ি ও রাস্তা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছে বন বিভাগ। কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। খুব দ্রুত মেরামতের পাশাপাশি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের আরও কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। আশা করছি, সমস্যাগুরো দ্রুত সমাধান হবে।’