নীলফামারী পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে জেলার বিভিন্ন নদী খনন করেছে। সেসব নদী দখল করে ফসল চাষ করছেন অনেকে। এতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীরগুলো।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জেলায় ছোট-বড় ২৫টি নদী রয়েছে। বহমান এসব নদীর দৈর্ঘ্য ৫৫৮ দশমিক ১৬ কিলোমিটার। দখল ও ভরাটের কারণে অস্তিত্ব সংকটে থাকা নদীগুলো উদ্ধারে গত দুই বছরে খনন করা হয় ৩৯৮ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার এলাকা। প্রথম পর্যায়ের ওই খনন কাজে সরকারের ব্যয় হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা।
খননকাজে নদীর জীবন ফেরার পাশপাশি গত দুই বছরে নিরসন হয়েছে এলাকার নিম্নাঞ্চলের জলাবদ্ধতা। এতে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে দেশি প্রজাতির হরেক রকম মাছের উৎপাদন। শুষ্ক মৌসুমে নদী এলাকার কৃষি জমিতে সহজে সেচ দিতে পারেন কৃষকরা। কিন্তু সেই খনন কাজ শেষ হতে না হতেই ফের নদী দখল এবং জলাধার বন্ধ করে চলছে ফসল চাষ। নদীর জলাধারকে নিজস্ব মালিকানার জমি দাবি করে ধান, ভুট্টা, শাক-সবজি চাষ করছেন অনেকে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নদীর প্রবাহ। ফের ভরাট হতে শুরু করেছে নদী।
সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নদীতে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করা হয়েছে। সদরের রামনগর ইউনিয়নের বাহালীপাড়া গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে বুড়িগোড়া নদী। ওই নদীর সন্নাসীরঘাট এলাকায় দুইধারে দেখা যায়, বোরো ধানের আবাদ।
জেলা সদরের কচুকাটা ইউনিয়নে নীলফামারী-জলঢাকা সড়কে বুড়িখোড়া নদীর ওপর দুহুলী নামক স্থানে সেতুর ওপর দাঁড়ালে ওই সেতুর উজান ও ভাটিতে দেখা যায় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ধানের চাষাবাদ। কৃষকরা জানান, জলাধারের বালির ওপর পলিমাটি ও গোবরসার ব্যবহার করে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে।
ওই ইউনিয়নের দুহুলী গ্রামের কৃষক জিকরুল ইসলাম বুড়িখোড়া নদীতে ধানের আবাদ করেছেন ১০ শতক এলাকায়। তিনি বলেন, ‘বাবা-দাদার আমল থেকে জমির কাগজ আমার নামে। পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী খনন করলেও জমি আমার। ওই নদীতে আমার ২০ শতক জমি রয়েছে। এরমধ্যে এবার ১০ শতকে ধান চাষ করেছি। বালুর ওপর বাইরের মাটি আর গোবর সার দিয়ে ধান চাষ করেছি।’
একইভাবে চারালকাটা নদীতে ধানের চাষ করেছেন কচুকাটা ইউনিয়নের বন্দরপাড়া গ্রামের কৃষক রোস্তম আলী ও সহিদুল ইসলাম। তারা জানান, নদীর জমিতে যাদের মালিকানা আছে, সুযোগ মতো তারা ফসল চাষ করেন। পলি পড়া উঁচু স্থানে কৃষকরা গম, ধান, ভুট্টাসহ অন্যান্য ফসলের আবাদ করেছেন।
একই অবস্থা জেলা সদরের টুপামারী ইউনিয়নের রামগঞ্জ এলাকায় বুড়িখোড়া, জেলা শহরের অদূরে গোবিন্দপুর গ্রামে খড়খড়িয়া নদীসহ বিভিন্ন নদীতে।
জেলা সদরের গোবিন্দপুর গ্রামের কৃষক গবিন্দ চন্দ্র রায় বলেন, ‘জমির কাগজ আমার নামে, এ জন্য খড়খড়িয়া নদীতে ধান চাষ করছি।’
এমন চাষাবাদকে ক্ষতির কারণ হিসেবে দেখছেন সচেতন মহল। তাদের মধ্যে জেলা সদরের কচুকাটা ইউনিয়নের রবিউল ইসলাম বলেন, ‘খনন হওয়ার পর এখন নদীতে পানি পাচ্ছি। দেশি মাছ পাচ্ছি। ধান আবাদে নদী ফের ভরাট হলে এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ধান আবাদে দু-একজন কৃষক লাভবান হচ্ছেন। কিন্ত বর্ষায় নদী তীরবর্তী হাজার হাজার পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তলিয়ে যায় বসতভিটাসহ ফসলি জমি। এতে এলাকার বেশিরভাগ মানুষ নদীর উপকার থেকে বঞ্চিত হবেন।’
এ বিষয়ে নীলফামারী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কৃষ্ণ কমল চন্দ্র সরকার বলেন, ‘নদীশাসন আইন অনুযায়ী, নদীর গতিপথ বর্তমানে যেখানে আছে, সেটিই নদীর জায়গা। সেই আইন অনুযায়ী, সেটিকে নদীর জমি হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। নদীর জেগে উঠা চরে চাষাবাদ না করার জন্য আমরা কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে নিরুৎসাহিত করছি।’
তিনি বলেন, ‘জেলায় ছোট-বড় ২৫টি নদী রয়েছে। প্রবাহমান নদীগুলো প্রচুর পরিমাণে পলি বহন করে। ফলে নদীগুলোতে চর পড়ছে। এই চরগুলো দ্রুত অপসারণ করা দরকার। জেলার অভ্যন্তরস্ত ছোট নদী, খাল এবং জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রকল্পের আওতায় চর অপসারণ এবং নতুন নতুন নদী-খাল খনন করতে পারবো।’
জেলার অভ্যন্তরীণ নদী-খাল-জলাশয় পুনঃখনন করণ প্রকল্পের আওতায় নীলফামারী সদর, ডালিয়া ও সৈয়দপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তিনটি বিভাগের অধীনে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার নদী পুনঃখনন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।