অভাব-অনটনের সংসারের হাল ধরতে প্রায় আট বছর আগে গরু পালন শুরু করেন কলেজ পড়ুয়া হামিদা আক্তার। এখন তার খামারে তিনটি ষাঁড় রয়েছে। এরমধ্যে ‘মানিক’ নামের ফ্রিজিয়ান জাতের ষাঁড়টির ওজন ৪৫ মণ। ১৫ লাখে এবারের কোরবানির ঈদে ষাঁড়টি বিক্রির পরিকল্পনা রয়েছে হামিদার। তবে আশানুরূপ ক্রেতা না মেলায় কিছুটা হতাশ তিনি। উদ্যোক্তা হামিদা টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি ইউনিয়নের ভেঙ্গুলিয়া গ্রামের আব্দুল হামিদ ও রিনা বেগম দম্পতির মেয়ে।
জানা যায়, হামিদা আক্তার তিন বোনের মধ্যে বড়। বাবা বৃদ্ধ থাকায় নবম শ্রেণি থেকেই হামিদাকে সংসারের হাল ধরতে হয়। উদ্যোক্তা হতে শিক্ষাজীবনেই প্রায় আট বছর আগে বাড়ির একটি গাভী নিয়ে খামার করার স্বপ্ন দেখেন হামিদা। খামারের পাশাপাশি বাড়িতেই একটি মনিহারির দোকানে ফ্লেক্সিলোড, বিকাশ ও দর্জির কাজ করছেন তিনি। লেখাপড়ার ব্যয় বহনসহ সংসারের হাল ধরেছেন তিনি। হামিদা আক্তার করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অনার্স (ইতিহাস) শেষ বর্ষের ছাত্রী। ছোট বোনকে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন এবং আরেক বোনকে লেখাপড়া করাচ্ছেন নার্সিংয়ে।
নিজ উপার্জনের বড় অংশই ব্যয় করেছেন মানিকের পেছনে। গত কোরবানির ঈদে রাজধানীর গাবতলী পশুর হাটে ষাঁড়টি বিক্রির জন্য তোলা হলেও ক্রেতা না পাওয়ায় ফেরত আনা হয়। ওই সময় এই ষাঁড়টি গাবতলী হাটে আনা-নেওয়া, হাটে চারদিন রাখার খরচ বাবদ হামিদাকে গুনতে হয় প্রায় ৯০ হাজার টাকা। এবারের কোরবানির ঈদ ঘনিয়ে এলেও এত বড় ষাঁড়ের আশানুরূপ ক্রেতা মিলছে না। ফলে এই নারী উদ্যোক্তা পড়েছেন চরম দুশ্চিন্তায়। তিনি ষাঁড়টির দাম হাঁকছেন ১৫ লাখ টাকা। জেলার সবচেয়ে বড় এই ষাঁড়টি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে প্রতিদিন মানুষ আসছেন হামিদার বাড়িতে।
হামিদা বলেন, ‘বাবা-মা দুজনেরই অনেক বয়স হয়েছে। বাবা এখন কোনও উপার্জন করতে পারছেন না। একপর্যায়ে মনিহারির দোকান, দর্জির কাজ ও গরু পালন শুরু করি। পড়াশোনা তো আছেই। মনিহারির দোকান ও দর্জির কাজ করে যা উপার্জন হয় তা দিয়ে সংসারের হাল ধরেছি। পাশাপাশি তিনটি গরুর পেছনে খরচ করেছি। প্রায় পাঁচ বছর আগে খামারেই মানিকের জন্ম হয়। ষাঁড়টি শান্ত প্রকৃতির হওয়ায় তার নাম রেখেছিলাম ‘মানিক’। এখন মানিকের ওজন ৪৫ মণ। তার নিয়মিত খাবারের তালিকায় রয়েছে খড়, ভুসি, কাঁচাঘাস, মাল্টা, পেয়ারা, কলা, মিষ্টি কুমড়া ও মিষ্টি আলু। রোগ জীবাণুর হাত থেকে বাঁচতে প্রতিদিন ষাঁড়টিকে সাবান আর শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করানো হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত কোরবানির ঈদে মানিককে বিক্রি করতে গাবতলীর হাটে নেওয়া হয়। তবে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসি। এবারের কোরবানির ঈদে ষাঁড়টি কিনতে এখনও কোনও ক্রেতা আসেনি। বড় ষাঁড় হওয়ায় বিক্রি করতে সমস্যা হচ্ছে। এজন্য অনেক দুশ্চিন্তায় রয়েছি। বাড়ি থেকেই ষাঁড়টি বিক্রি করার চেষ্টা করছি। বাড়িতে এসে যদি কোনও ক্রেতা কেনেন, সেক্ষেত্রে আমরা নিজ খরচে মানিককে ক্রেতার বাড়িতে পৌঁছে দেবো। দেশে বড় ষাঁড়গুলো বিক্রি না হলে আমাদের মতো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আর তৈরি হবে না। ধীরে ধীরে উদ্যোক্তারা ঝিমিয়ে পড়বে।’
হামিদার মা রিনা বেগম বলেন, ‘হামিদার বাবা বৃদ্ধ হয়ে গেছে। স্কুলজীবন থেকেই হামিদা সংসারের হাল ধরেছে। স্কুলজীবন থেকেই সে খুব সংগ্রামী। ছোট এক বোনের বিয়ে হয়েছে, তবু হামিদা বিয়ে করেনি। বড় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন তার। এই স্বপ্ন নিয়েই হামিদা এগিয়ে যাচ্ছে। আট বছরে হামিদা তিনটি ষাঁড় বিক্রি করেছে। এবারের ষাঁড়টি ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারলে হামিদা আরও বড় করে খামার তৈরি করতে পারবে।’
দেলদুয়ার উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. বাহাউদ্দিন সারোয়ার রিজভী বলেন, ‘এ উপজেলায় হামিদার ষাঁড়টিই সবচেয়ে বড়। আমাদের অনলাইন হাটে তার ষাঁড়টির ছবি, ওজন ও দাম উল্লেখ করে বিক্রির জন্য প্রচারণা হচ্ছে। এছাড়াও আমাদের কাছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বড় ষাঁড় কেনার জন্য গ্রাহক যোগাযোগ করেন। আমরা সেসব ক্রেতাকেও হামিদার ষাঁড়টির বিষয়ে জানাচ্ছি।’