২০০৩ সালের ৫ নভেম্বর রাতে যশোরের অভয়নগর উপজেলার শ্রমিকনেতা ইব্রাহীম হোসেন সরদার (৫২) এক বন্ধুর সঙ্গে উপজেলার নওয়াপাড়া বাজার থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। নওয়াপাড়া রেলস্টেশনের সামনে রেললাইন অতিক্রম করার পর তাকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
ইব্রাহীম সরদারকে যখন হত্যা করা তখন তিনি উপজেলার রাজঘাটে অবস্থিত রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ (জেজেআই) শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। তাকে হত্যার ২১ বছর এক মাস ২২ দিন পর তার বড় ছেলে আওয়ামী লীগ নেতা জিয়াউদ্দিন পলাশকে (৪৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বাড়ির পাশের একটি চায়ের দোকান থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। রাতে উপজেলার নওয়াপাড়া বুড়িরঘাট এলাকায় আয়কর অফিসের পেছনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়। এলাকার লোকজন উদ্ধার করে রাত সোয়া ১০টার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বাবার মতো জিয়াউদ্দিন পলাশও যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ (জেজেআই) শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সম্পাদক ছিলেন। ২০২০ সালের ২ জুলাই পাটকলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় পাটকলটির অন্য শ্রমিকের মতো তিনিও বেকার হয়ে পড়েন। জিয়াউদ্দিন নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া বাবার মতোই তিনি ওই ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ছিলেন।
পলাশকে হত্যার পর এলাকার লোকজন রইচ সিকদার (৩৫) নামে এক বিএনপি নেতাকে ধরে পিটুনি দিয়েছেন। পরে তাকে পুলিশে দেওয়া হয়েছে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রইচ সিকদার নওয়াপাড়া গ্রামের সিদ্দিক সরদারের ছেলে। তিনি নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির প্রচার সম্পাদক। এ ছাড়া নওয়াপাড়া পৌর যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।
রবিবার দুপুরে জিয়াউদ্দিন পলাশের নওয়াপাড়া গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একতলা ভবনের সামনে শতাধিক নারী-পুরুষের জটলা। ঘরের সামনে বসে কথা বলেই যাচ্ছেন জিয়াউদ্দিন পলাশের ছোট ভাই আব্দুল মান্নান ওরফে লেলিন (৪০)। মাঝেমধ্যে বলে উঠছেন, ‘আমরা সহজ-সরল জীবন যাপন করি। আমরা মানুষের কোনও ক্ষতি করি না। চাঁদার জন্য আমার ভাইকে মেরে ফেলা হয়েছে।’
ছেলের জন্য বিলাপ করে কাঁদছিলেন মা ফরিদা বেগম (৬৫)। ছেলের শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তাকে ঘিরে আছেন কয়েকজন নারী। তারা নানাভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
পলাশের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে স্ত্রী শারমিন নাহার (৩৫) বাকরুদ্ধ। জানা গেছে, তাদের দুই ছেলে তাসিন সরদার (১০) ও তাইফ সরদার (৯ মাস)। সবাই ডুকরে কাঁদছিলেন।
পরিবারের সদস্য, একজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং পুলিশ জানায়, গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে জিয়াউদ্দিন বাড়ির কাছে নওয়াপাড়া গ্রামের তেঁতুলতলা মসজিদের পাশে একটি চায়ের দোকানে বসে চা পান করছিলেন। এ সময় বিএনপি নেতা রইচ সিকদারের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জন চায়ের দোকান থেকে জিয়াউদ্দিনকে ধরে নিয়ে যায়। সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে দুই ব্যক্তি জিয়াউদ্দিনের বাড়িতে যান। তাদের একজন নিজেকে জিহাদ এবং অপরজন সাগর নামে পরিচয় দেন। শারমিন নাহারের সঙ্গে তাদের একজনের মোবাইল থেকে জিয়াউদ্দিনকে কথা বলিয়ে দেন। তখন জিয়াউদ্দিন স্ত্রীকে বলেছেন, ‘মার্ডার হওয়ার অবস্থায় আছি। ওই দুই ব্যক্তিকে ২০ হাজার টাকা দাও।’ তারা টাকা নিয়ে চলে যাওয়ার পর জিয়াউদ্দিন পলাশকে নওয়াপাড়া বুড়িরঘাট এলাকায় আয়কর অফিসের পেছনে ভৈরব নদের তীরে বালুর স্তূপের ওপর নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে এবং পিটিয়ে ফেলে রেখে যায়। এলাকার লোকজন তাকে খুঁজে পেয়ে সেখান থেকে উদ্ধার করে রাত সোয়া ১০টার দিকে অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। এ সময় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন রইচ সিকদারকে ধরে পিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছেন। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে তাকে অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে শনিবার রাতেই খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এমাদুল করিম বলেন, ‘জিয়াউদ্দিন পলাশকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত একজনকে আটক করা হয়েছে। যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
ওসি আরও বলেন, ‘কী কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে, তা এখন পর্যন্ত উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে মামলা প্রক্রিয়াধীন।’
আরও পড়ুন: চায়ের দোকান থেকে ধরে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা