‘৩০০ টাকা খরচ করে ৪৫ টাকার সরকারি ওষুধ পেলাম’
বাংলাদেশ

‘৩০০ টাকা খরচ করে ৪৫ টাকার সরকারি ওষুধ পেলাম’

ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের যেন ভোগান্তির শেষ নেই। হাসপাতালের বারান্দায় ও সিঁড়িতে চিকিৎসা দেওয়া, সরকারি ওষুধ না পাওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠানো, কমিশন বাণিজ্য, অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট, কালো তালিকাভুক্ত ঠিকাদারের নিম্নমানের মেশিন দিয়ে একই রোগের পরীক্ষায় দুই ধরনের রিপোর্ট দেওয়াসহ নানা অনিয়মের চিত্র দেখা গেছে। এসব কারণে সঠিক চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে বিপাকে রয়েছেন রোগীরা। ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে থাকছে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবায় দুর্ভোগের চিত্র। প্রথম পর্বে তুলে ধরা হলো কেন রোগীরা সরকারি ওষুধ পাচ্ছেন না।

‘৩০০ টাকা দিয়ে ভাড়া দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে ত্রিশালের ধলা গ্রামের বাড়ি থেকে ছেলে আলিফ হোসেনকে ডাক্তার দেখাতে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আউটডোরে এসে ১০ টাকায় টিকিট কাটি। আমাশয় ও আলসারের কারণে পেটব্যথা নিয়ে মেডিসিন বিভাগের ডাক্তারকে দেখালে তিনি ব্যবস্থাপত্রে ক্যাপসুল রস্টিল এসআর সকালে ও রাতে একটি করে তিন মাসের, ট্যাবলেট জক্স ৫০০ এমজি সকালে ও রাতে তিন দিনের, ট্যাবলেট প্রোবায়ো সকালে ও রাতে ১৫ দিনের, ট্যাবলেট রেব ২০ এমজি সকালে ও রাতে একটি করে এক মাসের ও ট্যাবলেট রলিট রাতে একটি করে তিন মাসের লিখে দেন। কিন্তু হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা শাখা থেকে শুধু ১০টি ওমিপ্রাজল ক্যাপসুল দিয়ে আমাকে চলে যেতে বলেন কাউন্টারের লোকজন। সেইসঙ্গে বলেন ব্যবস্থাপত্রের ওষুধগুলো বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনে খাবেন। পরে হিসাব মিলিয়ে দেখলাম অটোরিকশায় ৩০০ টাকা ভাড়া দিয়ে হাসপাতালে এসে ৪৫ টাকার সরকারি ওষুধ পেলাম।’

হাসপাতালের আউটডোরের ওষুধ কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে এসব কথা বলেন ত্রিশালের ধলা এলাকার কৃষক আব্দুল বাতেন (৭০)। তিনি বলেন, ‘এত টাকা খরচ করে ৪৫ টাকার ওষুধ পেলাম সরকারি হাসপাতালে। এই অবস্থা হলে আমার মতো গরিব কৃষকরা চিকিৎসা ও ওষুধের জন্য যাবে কোথায়?’

কাউন্টার থেকে ওষুধ নিয়ে যাওয়ার সময় ময়মনসিংহ সদরের দাপুনিয়া গ্রাম থেকে আসা নবী হোসেন (৫৫) বলেন, ‘জমির আইল কাটতে গিয়ে কোদাল দিয়ে বাঁ পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে যায়। এজন্য হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে ডাক্তার দেখানোর পর ব্যবস্থাপত্রে সেফিক্সিম ৪০০ সকালে-রাতে একটি করে সাত দিনের, জোলফিন দিনে তিনবার করে সাত দিনের, সেকলো সকালে-রাতে একটি করে এক মাসের ও সিরাপ নেভিসকন দুই চামচ করে দিনে তিনবার ১৫ দিন খাওয়ার জন্য লিখে দিয়েছেন। হাসপাতালের ওষুধ কাউন্টারে যাওয়ার পর শুধুমাত্র ১০টি ওমিপ্রাজল ক্যাপসুল বিদায় করে দিয়েছেন। বাকি ওষুধ বাইরে থেকে কেনার পরামর্শ দিয়েছেন।’

এতদিন শুনেছি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর পর সব ওষুধ বিনামূল্যে পাওয়া যায় উল্লেখ করে নবী হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দাপুনিয়া থেকে আসা-যাওয়ায় ১০০ টাকা খরচ করে ৪৫ টাকার ওষুধ পেলাম সরকারি হাসপাতাল থেকে। এমন জানলে হাসপাতালেই আসতাম না।’

সদরের খাগডহর এলাকা থেকে আসা রমিজা বেগম (৬০) বলেন, ‘অনেক দিনের আলসার সমস্যায় প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে হাসপাতালের আউটডোরে মেডিসিন বিভাগের ডাক্তার দেখাই। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রের লেখা কোনও ওষুধ হাসপাতালের কাউন্টার থেকে না দিয়ে বাইরের ফার্মেসি থেকে কেনার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক ও নার্স। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে টাকা খরচ করে আইলাম শুধু ডাক্তার দেখে ওষুধ লিখে দিলেন। হাসপাতাল থেকে সরকারি কোনও ওষুধ দেয়নি। এরকম হলে আমরা গরিব ও অসহায় মানুষ কই যামু।’

শুধু হাসপাতালের আউটডোরে নয়, ইনডোরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়া রোগীরা বলেছেন, কিছু ওষুধ হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয়। তবে বেশিরভাগ ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। বিশেষ করে দামি সব ওষুধ।

নেত্রকোনা সদরের বড় কাটুরি গ্রামের কৃষক সুজন মিয়া (৬০) হার্টের ও কিডনি সমস্যা নিয়ে হাসপাতালের সিসিইউ ওয়ার্ডে ভর্তি হন গত ২০ নভেম্বর। সুজন মিয়ার মেয়ের জামাই মামুন হোসেন বলেন, ‘কিছু ওষুধ হাসপাতাল থেকে দিলেও দামি ইনজেকশন বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়েছে। আগে জানতাম হাসপাতালে ভর্তি হলে সব সরকারি ওষুধ পাওয়া যায়। কিন্তু এখন দেখছি সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনে এনে রোগীদের দিতে হয়।’

ফুলপুরের মাহমুদপুরের কৃষক হযরত আলী (৬০) স্ট্রোক করে হার্টের সমস্যা নিয়ে সিসিইউ ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন গত ১৬ নভেম্বর। তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু ওষুধ হাসপাতাল থেকেই পেয়েছি। তবে বেশিরভাগ ওষুধ বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনতে হয়েছে। চিকিৎসক-নার্সরা বলেছেন হাসপাতালে অনেক ওষুধের সরবরাহ নেই, এজন্য দিতে পারছেন না। সেসব ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হচ্ছে আমাদের।’

পারিবারিক জমির বিরোধ নিয়ে প্রতিবেশীদের হাতে মাথায় দায়ের কোপ লেগে গুরুতর আহত হন ত্রিশালের বইলর বাস্করি গ্রামের হাসান আলীর মেয়ে তাসলিমা আক্তার (২৫)। হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের ৩১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হন ২ নভেম্বর। ১৮ নভেম্বর মাথায় অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তাসলিমার ভাই সবুজ মিয়া বলেন, ‘অপারেশন করাতে গিয়ে ওটি চার্জ তিন হাজার, মেশিনের কাটার কেনা বাবদ পাঁচ হাজার টাকা নার্সকে দিতে হয়েছে। অপারেশনের দিন সাড়ে তিন হাজার টাকার ওষুধ বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনে আনতে হয়েছে। এখনও কিছু ইনজেকশন বাইরে থেকে কিনে দিতে হচ্ছে। এসব ওষুধ হাসপাতাল থেকে পাওয়া গেলে গরিব রোগীদের জন্য চিকিৎসা করানো সহজ হতো।’

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের যেন ভোগান্তির শেষ নেই

হাসপাতাল থেকে কত শতাংশ রোগীকে সরকারি ওষুধ দেওয়া হয় জানতে চাইলে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র স্টোর অফিসার ডা. ঝন্টু সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তা ঠিক এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে ১০০টিরও বেশি ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে দিচ্ছে সরকার। আমরা প্রতি মাসে কম বেশি বরাদ্দ পাচ্ছি। কিন্তু রোগীর তুলনায় ওষুধ বরাদ্দ কম থাকায় রোগীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। বরাদ্দ বাড়ানো হলে সব রোগীকে ফ্রিতে ওষুধ দেওয়া যেতো।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোহাম্মদ মাইনউদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এক হাজার শয্যার এই হাসপাতালে প্রতিদিন তিন হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। আউটডোরে প্রতিদিন তিন হাজারের বেশি রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অতিরিক্ত রোগীর কারণেই চাহিদামতো ওষুধ দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে সরকারের সরবরাহকৃত ওষুধ রোগীদের মাঝে বিতরণ করা হয়।’

Source link

Related posts

বস্তা সেলাই করে সংসার চলে ৫০০ শ্রমিকের

News Desk

এবারও চালু হচ্ছে ‘ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন’, ঢাকায় আম আনতে খরচ কত?

News Desk

মাছে রং দিয়ে বিক্রি, ২ ব্যবসায়ীকে জরিমানা

News Desk

Leave a Comment