৫০ হাজার টন আলু মজুত, তবু সংকটের অজুহাতে ৭৫ টাকা কেজি
বাংলাদেশ

৫০ হাজার টন আলু মজুত, তবু সংকটের অজুহাতে ৭৫ টাকা কেজি

মুন্সীগঞ্জের ৫৪টি হিমাগারে এখনও ৫০ হাজার মেট্রিক টন আলু মজুত আছে। তবু কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। হিমাগার থেকেই ৫৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন তারা। যা খুচরা বাজারে ভোক্তাদের কিনতে হয় ৭৫ টাকায়। এতে বাজারে গিয়ে আলু কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতারা।

ক্রেতারা বলছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কারসাজির মাধ্যমে বেশি দামে আলু বিক্রি করছেন। হিমাগারগুলোতে পর্যাপ্ত আলু মজুত রেখে কম কম বাজারে ছেড়ে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তাদের লাগাম টেনে ধরতে জেলা প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। দাম নিয়ন্ত্রণে খুচরা বাজার মনিটরিংয়ের আগে হিমাগারগুলোতে অভিযান চালাতে হবে। গত বছর এই সময়ের চেয়ে এখন কেজিতে ৩০ টাকা বেশি দিয়ে ৭৫ টাকায় আলু কিনে খেতে হচ্ছে তাদের। 

আলু কিনতে হিমশিম

৭৫ টাকায় আলু কিনতে হিমশিম খেতে হয় বলে জানালেন মুন্সীগঞ্জ বাজারে আলু কিনতে আসা উত্তর ইসলামপুরের মো. জয়নাল আবেদীন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন আগেও ৬৫ টাকায় কিনেছি। সপ্তাহের ব্যবধানে ৭৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। যদি এক কেজি আলু কিনতে হয় ৭৫ টাকায়, তাহলে অন্য সবজি কিনবো কী দিয়ে। আমাদের বাজার করে খেতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। এই কথা কাকে বলবো।’ 

একই কষ্টের কথা জানিয়ে বাগমামুদালী পাড়ার সেন্টু সরকার বলেন, ‘প্রতিদিনের খাবারে সবজি হলো আলু। বিশেষ করে আমাদের বিক্রমপুরের মানুষের আলু ছাড়া চলে না। এবার বাজারে যে দাম, আগে কখনও দেখিনি। ৭৫ টাকায় কিনতে হয়। প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি, তারা যেন কঠোরভাবে হিমাগারগুলো তদারকি করে। কারণ হিমাগারগুলোতে আলু মজুত রেখে সংকট দেখিয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।’

হিমাগারে রসিদ ছাড়াই আলু বিক্রি

মুন্সীগঞ্জ বাজারের আলু ব্যবসায়ী মো. স্বপন মিয়াজি বলেন, ‘খুচরায় ৭৫ টাকায় আলু বিক্রি করছি। ৬৫ টাকায় কিনতে হয় আমাদের। এর সঙ্গে পরিবহন খরচ আছে। প্রতিদিন এক-দুই টাকা করে দাম বেড়েই চলছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা আমাদের বলছেন, হিমাগারে আলু নেই। সেজন্য দাম বেশি। এখন বাজারে নতুন আলু এলেও দাম কমেনি। হিমাগারে আলু কিনতে গেলে পাইকাররা রসিদ দেন না। কারণ বেশি টাকা নেন তারা।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মিরকাদিমের রিকাবিবাজার পাইকারি আলু বাজারের অভি বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী মাসুদ রানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছর হিমাগারে আলুর মজুত কম হওয়ায় দাম বেশি। কয়েকটি হিমাগার ঘুরে ১২ বস্তা আলু পেয়েছি। যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। ৫৭ টাকায় হিমাগার থেকে কিনতে হয়েছে। আবার হিমাগার থেকে পাইকাররা রশিদ দেননি। কারণ এতে তাদের দুর্নীতি ধরা পড়ে যাবে। আমরা ৬৫ টাকা করে বিক্রি করছি। খুচরা ব্যবসায়ীরা বাজারে ৭৫ টাকায় বিক্রি করেন।’

সংকটের অজুহাত মজুতকারীদের 

মুক্তারপুর রিয়ারভিউ কোল্ড স্টোরেজের আলু ব্যবসায়ী আব্দুল আজিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন আলুর মজুত কম। চাহিদার ওপর নির্ভর করে দাম বাড়ে এবং কমে। এখন প্রত্যেকটি হিমাগারে মজুত প্রায় শেষের দিকে। এজন্য দাম বেশি। মুন্সীগঞ্জের আলু প্রায় সব জেলায় যাচ্ছে। নতুন আলু বাজারে এলেও দাম কমেনি।’

মৌসুমের শেষে এসে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অজুহাত দেখালেন পশ্চিম মুক্তারপুরের দেওয়ান কোল্ড স্টোরেজে আলু মজুত রাখা পাইকারি ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিন ব্যাপারী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মূলত আলুর দাম বেড়েছে এবারের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে। দুবার আলু রোপণ করতে হয়েছিল। প্রথমে যে বীজ রোপণ করা হয়েছিল, সেগুলো পচে গিয়েছিল। দ্বিতীয়বার রোপণের সময় পুরোনো বীজ রোপণ করেন কৃষকরা। এতে ফলন কম হয়েছিল। ফলে গত বছরের চেয়ে এবার হিমাগারে মজুত কম। এজন্য শেষ সময়ে এসে দাম বেড়েছে।’ 

একই কোল্ড স্টোরেজে আলু মজুত রাখা ইব্রাহিম দেওয়ান বলেন, ‘দাম বাড়ার কারণ চাহিদার তুলনায় জোগান কম। হিমাগার থেকে আমরা ৫৬-৫৭ টাকায় বিক্রি করছি। এই দামের পাকা রশিদ দিচ্ছি আমরা।’

প্রায় একই অজুহাত দেখালেন মুক্তারপুরের বিক্রমপুর মাল্টিপারপাস কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক আব্দুল রশিদ। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর আলুর দাম বাড়ছে। এটি এখন নিত্য-সবজির মতো। এ বছর ফলন কম হওয়ায় দাম বেশি। প্রতি বছর আমাদের হিমাগারে এক লাখ ২০ হাজার বস্তা আলু মজুত রাখা হয়। এবার সেখানে ৬০ হাজার বস্তা মজুত ছিল। বর্তমানে আমাদের হিমাগারে মজুত প্রায় শেষের দিকে।’

কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না ভোক্তা অধিদফতর

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর মুন্সীগঞ্জ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আসিফ আল আজাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হিমাগার থেকে রসিদ না দিয়ে আলু বিক্রি করা কৃষি বিপণন আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী অপরাধ। আমরা বাজার ও হিমাগারগুলোতে অভিযান চালাচ্ছি। ব্যবসায়ীরা যদি আমাদের সুনির্দিষ্টভাবে বলতেন, কোন হিমাগার থেকে রসিদ দেওয়া হচ্ছে না তখন ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হতো। আমরা যখন অভিযানে যাই তখন ব্যবসায়ীরা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন না কিংবা কোনও ব্যবসায়ীর নামও বলতে চান না। যদি অন্তত তারা জানাতেন তাহলে আমরা কার্যকর ব্যবস্থা নিতাম। তারপরও নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। হিমাগারগুলো মনিটরিং করছি। আশা করছি, কয়েক দিনের মধ্যে দাম কমে আসবে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেওয়া তথ্যমতে, মুন্সীগঞ্জের ৫৪টি হিমাগারে আলু মজুত রাখা হয়েছে। এখনও হিমাগারে ৫০ হাজার মেট্রিক টন মজুত আছে। তবু কারসাজি করে বেশি দামে বিক্রি করা হয়।

কৃষি বিপণন কর্মকর্তাও বলছেন সংকটের কথা

কৃষি বিভাগের কাছে এমন তথ্য থাকা সত্ত্বেও কোল্ড স্টোরেজের মজুতকারীদের মতো একই কথা বলছে জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তার কার্যালয়।

এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আলু উৎপাদন কম হয়েছে বলে জানালেন জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. সামির হোসাইন সিয়াম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‌‘এ বছর দাম বাড়ার একটি কারণ হলো ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আলু দুবার রোপণ করতে হয়েছিল। এজন্য খরচ কিছুটা বেড়েছে। আবার ফলনও কম হয়েছে। আরেকটি কারণ হিমাগারে মজুত কম। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দাম বেশি।’

হিমাগার থেকেই ৫৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন মজুতকারীরা

মজুতকারীরা দাম বেশি নিলেও রসিদ দিচ্ছেন না জানিয়ে এই কৃষি বিপণন কর্মকর্তা বলেন, ‘হিমাগার থেকে ব্যবসায়ীরা আড়তগুলোতে আলু পাঠান ঠিকই কিন্তু রসিদ দিচ্ছেন না। এজন্য তদারকি করতে সমস্যা হয়ে যায়। তারা কিনে এক দামে আর আমাদের বলে আরেক দাম। দুই পক্ষের মধ্যেই কারসাজি আছে।’

কৃষি অধিদফতর বলছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন

কৃষি বিপণন কর্মকর্তা ও মজুতকারীরা উৎপাদন কমের কথা বললেও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে। অধিদফতরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) শান্তনা রাণী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ বছর ৩৭ হাজার হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০০ হেক্টর বেশি জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। তা থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে বেশি।’ 

মুন্সীগঞ্জের ৫৪টি হিমাগারে আলু মজুত রাখা হয়েছে জানিয়ে শান্তনা রাণী বলেন, ‘এখনও হিমাগারে প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন আলু মজুত আছে। যে পরিমাণ মজুত আছে, তাতে সংকট হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কী কারণে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বেশি দামে বিক্রি করছেন, তা আমার জানা নেই।’

শান্তনা রাণী আরও বলেন, ‘কৃষকরা আলু রোপণের কাজ শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে আগাম আলু বাজারে এসেছে। উত্তরবঙ্গের আলু বাজারে আসতে আরও দুই সপ্তাহ লাগবে। তখন দাম এমনিতেই কমে যাবে।’ 

Source link

Related posts

নামসর্বস্ব খামার দেখিয়ে পৌনে ১৫ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ

News Desk

নিউইয়র্কে প্রবাসীদের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

News Desk

৭০ বছরেও স্বীকৃতি পাননি চাঁদপুরের ৪০ ভাষা সংগ্রামী

News Desk

Leave a Comment