ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে তিন বছরের জন্য ৫২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও সিলেট নগরীতে জলাবদ্ধতা নিরসন হয়নি। ইতোমধ্যে ড্রেনেজ ব্যবস্থার অধিকাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তবু অল্প বৃষ্টিতেই নগরীতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী। যাতায়াত ব্যাহত, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট বন্ধ এবং বাসাবাড়ির নিচতলার আসবাবপত্রের ক্ষতি নিয়মিত চিত্র। এত কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার পরও কি কারণে অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন নগরবাসীর মনে।
নগরবাসীর অভিযোগ, সিলেট সিটি করপোরেশনের অপরিকল্পিত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা হয়নি। নিয়মিত ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হয় না। জেলার নদীগুলো খনন করা হয়নি। এজন্য বৃষ্টির পানি নামতে না পেরে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী ও জলাশয় ভরাট, অপরিকল্পিত ড্রেনের উন্নয়নকাজ ও জনগণের অসচেতনতার কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।
তবে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, জলাশয় কমে যাওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পানি ও পয়োনিষ্কাশনের অভাবে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।
গত কয়েক মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বৃষ্টি শুরু হলে সিলেট নগরীর শাহজালাল উপশহর, জিন্দাবাজার, লামাবাজার, রিকাবীবাজার, পাঠানটুলা, মদিনা মার্কেট, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শিবগঞ্জ, সেনপাড়া, সোনাপাড়া, মেন্দিবাগ, তোপখানা, কাজলশাহ, লালদীঘির পাড়, আম্বরখানার বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এসব এলাকার রাস্তার পাশে ড্রেনের উন্নয়নকাজ চলমান। এজন্য বৃষ্টির পানি বের হতে না পারায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলায় বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে পড়ে দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ড্রেনের মুখে ময়লা আটকে পানি চলাচল ব্যাহত হওয়ায় কিছু কিছু স্থানে জলবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে।
জলাবদ্ধতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নগরীর সিএনজিচালক মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম বলেন, ‘পরপর দুই-তিনবার বন্যা হলো। এতে নগরীর সব জায়গায় পানি উঠেছে। আশপাশের এলাকা ডুবে গেছে। এটি হটাৎ করেই হয়েছে। গত তিন বছর ধরে দেখছি, একটু বৃষ্টি হলেই শহরের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে যায়। চলাচল করা যায় না। সিটি করপোরেশনের দায়িত্বহীনতার কারণে এটি হচ্ছে। অনেকদিন ধরে দেখছি, ড্রেনের কাজ চলছে, রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে। কিন্তু কাজ কবে শেষ হবে, কবে ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবো আমরা।’
আম্বরখানা এলাকার বাসিন্দা সালেকুর রহমান আরমান বলেন, ‘নগরীর কিছু কিছু স্থানে ড্রেনের কাজ চলছে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। তার মধ্যে আমরা সচেতন না, যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলি। এমনকি ড্রেনের ঢাকনা তুলে তার মধ্যে হোটেলের উচ্ছিষ্ট, বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা ফেলছি। সিটি করপোরেশনের লোকজন নিয়মিত ময়লা পরিষ্কার করে না। ড্রেনের মধ্যে দেড় থেকে দুই ফুট মাটি, আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। কিন্তু ময়লা-আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় গতানুগতিক পদক্ষেপের বাইরে কোনও উদ্যোগ নেই। কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে নগরীর উন্নয়নে। কিন্তু কি কাজ হচ্ছে, তার কোনও সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। দিন দিন ভোগান্তি বাড়ছে আমাদের।’
মদিনা মার্কেট এলাকার গৃহবধূ গৌতমী রানি বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের দোষ দিয়ে কি লাভ? আমরা নিজেরাই চারপাশ পরিষ্কার রাখি না। যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলি। তা নালায় গিয়ে জমা হয়। একপর্যায়ে সে জায়গা দিয়ে পানি যেতে পারে না। পানি রাস্তা ও বাসাবাড়িতে ঢুকে যায়। এক্ষত্রে আগে আমাদের সচেতন হতে হবে। সেইসঙ্গে নগর কর্তৃপক্ষ নিয়মিত নালা পরিষ্কার করলে এ সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে।’
এদিকে, অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজ, জলাশয় হারিয়ে যাওয়া ও মানুষের অসচেতনতাকে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেন, ‘সিলেট নগরীর আধুনিকায়ন পরিকল্পিতভাবে হচ্ছে না। জলাশয় ভরাট করে নানা উন্নয়নমুখী অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে বৃষ্টির পানি দ্রুত নামতে পারে না। সিলেটে গড় বৃষ্টিপাত অনেক বেশি। হঠাৎ এত বৃষ্টির পানি কীভাবে নামবে, কোথায় নামবে? যদি জলাশয় কিংবা লেক ভরাট হয়ে যায়। এর বাইরে আবার নগরীর বিভিন্ন জায়গায় ড্রেনেজ সংস্কারের কাজ চলছে। ফলে পানি দ্রুত নামতে পারছে না। আবার ড্রেনের সঙ্গে নদীর সংযোগও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। যাতে পানি উপচে শহরে না আসে এবং দ্রুতই পানি সাগরে গিয়ে পড়ে, সে জন্য জলাশয় পুনরুদ্ধার করে নদী খনন ও নদীর পাড় বাঁধাই করতে হবে।’
‘ময়লা-আবর্জনা ফেলা নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা নেই’ উল্লেখ করে ড. জহির বিন আলম বলেন, জলাবদ্ধতা তৈরির জন্য আমরা নিজেরাও দায়ী। ময়লা যেখানে-সেখানে ফেলছি। এমনকি আমি দেখেছি, ড্রেনের ঢাকনা খুলে সেখানে ময়লা ফেলা হয়। এতে ড্রেন দ্রুত ভরাট হয়ে যায়। ড্রেন নিয়মিত পরিষ্কারের পাশাপাশি এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকি প্রয়োজন। এমনকি শাবিতে জলাশয় ভরাট ও পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, ‘ড্রেনেজ ব্যবস্থা, খাল ও নর্দমা দিয়ে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে না পারা জলাবদ্ধতার মূল কারণ। এসব স্থানের প্রবেশ মুখ বন্ধ থাকায় পানি চলাচল করতে পারে না। বন্যার পানির সঙ্গে অনেক পলি মাটি এসে ড্রেন ভরাট হয়ে যায়। অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে ড্রেনগুলো সংকুচিত হয়ে গেছে। আরেকটি বড় কারণ হলো, নাব্যতা কমে নদীর বেড উঁচু হয়ে গেছে। এতে খালের পানি নদীতে নামতে পারছে না।’
‘জলাবদ্ধতা নিরসনে নগর কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে’ উল্লেখ করে কাসমির রেজা বলেন, নদী ও খালে পানি প্রবেশের মুখ খুলে দিতে হবে। ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিষ্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে; যেখানে সেখানে যাতে ময়লা না ফেলে। এছাড়া পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য সুরমা ও কুশিয়ারা নদী খনন করতে হবে।
এ বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘সিলেটে জলাবদ্ধতার অনেক কারণ রয়েছে। এখানে পাহাড় আছে, নদী আছে, টিলা আছে, উঁচু-নিচু জায়গা আছে। আবার এখানে বৃষ্টির পরিমাণও বেশি। উন্নত দেশে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় যেভাবে কাজ হয় সেভাবে আমরা করতে পারি না। বড় ধরনের বন্যার জন্য আমাদের যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা দরকার, তা দিতে পারি না। কারণ আমাদের ড্রেনগুলো রাস্তার পাশ দিয়ে গেছে। ড্রেনের জায়গা বাড়ালে রাস্তা কমে যাবে। এ জন্য বেশি বৃষ্টিপাত হলেই জলাবদ্ধতা দেখা দেবে, এমন চিন্তা করেই ড্রেনের ডিজাইন করি। এছাড়া পানি যে পথ দিয়ে যাবে তা সবসময় পরিষ্কার থাকতে হবে। কিন্তু ড্রেন পরিষ্কার থাকে না। আমাদের গাফিলতি কিংবা অসচেতনতার কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়। মাটি, ময়লা-আবর্জনা জমে যায় ড্রেনে।
‘বিভিন্ন এলাকায় ড্রেনের কাজ চলায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে কিনা’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বৃষ্টি থাকে। এর বাইরেও বছরে ৯ মাস কমবেশি বৃষ্টি থাকে সিলেটে। কোনও জায়গায় কাজ করতে হলে সেখানকার পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন শিফট করতে হয়, দেয়াল ভাঙতে হয়। সব মিলিয়ে কাজ অনেক দীর্ঘ হয়ে যায়। এর বাইরে যারা কাজ করে তারা দিনের বেলা ছাড়া করে না। আমরা কাজের জন্য জায়গা খুঁড়ি, লোকজন সেখানে ময়লা ফেলে। পাশাপাশি মাটি এসে জমা হয়। আবার পরিষ্কার করতে হয়। এতে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। ময়লার কারণে ড্রেনের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। যা নিয়মিত পরিষ্কার না করার কারণেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
‘জলাশয় কমে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে কিনা’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০০০ সালের আগে সিলেটে ২২ শতাংশ জলাশয় ছিল। নগরায়ণের ফলে তা কমে ৮ শতাংশে নেমেছে। নতুন নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে জলাশয় ভরাট করে। এখন পানি কোথায় নামবে? ড্রেন দিয়েই তো নামতে হবে। আমরা ড্রেনও সেভাবে বড় করতে পারি না রাস্তা কমে যাবে বলে। আমি যদি বলি, ৭.৫ মিলিমিটার ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতকে অতিবৃষ্টি বলে, অথচ সিলেটে কখনও কখনও ঘণ্টায় ৬০-৭০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এ পানি নামতে সময় তো লাগবে। আবার জলাশয়ও কমেছে। এখন জলাবদ্ধতা ছাড়া তো কোনও উপায় নেই।
তিনি বলেন, ‘নগরায়ণের ফলে ছোট ছোট টিলা কেটে ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে। ফলে সেখানকার মাটি পলি হয়ে ড্রেনে পড়ছে। পলি মাটি বা নদীতে বন্যায় পলি জমে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে নালা বা ড্রেন দিয়ে যে পরিমাণ পানি নামার দরকার, তা নামতে পারছে না। এসব এলাকা থেকে দ্রুত পানি নিষ্কাশনে পাম্প বসাতে হবে। স্লুইসগেট বসাতে হবে। তাহলে সমস্যা কিছুটা সমাধান সম্ভব। এছাড়া সমস্যা নিরসনে উন্নত দেশের মতো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে নগরায়ণের সঙ্গে পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানাই।’
ড্রেনেজ ব্যবস্থার কাজ কতটুকু শেষ হয়েছে জানতে চাইলে নূর আজিজুর রহমান বলেন, ‘নগরীতে জলাবদ্ধতার যে সমস্যা রয়েছে তা দ্রুত সমাধান করা সম্ভব নয়। এজন্য ধাপে ধাপে কাজ করছে সিসিক। বড় একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ওই প্রকল্পের অধীনে ২০১৯ সালে সিসিকের ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য ৫২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ওই টাকায় মহানগরী এলাকায় ৩২৭ কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নকাজ চলমান। এরই মধ্যে অধিকাংশ এলাকার কাজ প্রায় শেষ। পুরো কাজ শেষ হতে আরেকটু সময় লাগবে। কাজ শেষ হলে নগরবাসী স্বস্তি পাবে।’