দীর্ঘ পাঁচ বছরেও চালু করা যায়নি সাতক্ষীরার একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস’। ফলে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। আর্থিক সংকট ও হতাশায় ভুগছেন চাকরি হারানো বিপুলসংখ্যক শ্রমিক। বন্ধ হয়ে যাওয়া মিলটি আবারও চালুর দাবি করেছেন তারা।
সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস্ সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরার একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান এই মিলটি। ১৯৮৩ সালে সাতক্ষীরা শহরের উপকণ্ঠে মাগুরা এলাকায় ৩০ একর জায়গায় স্থাপন করা হয় মিলটি। সেখানে একসময় দেড় হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করতেন। মূল ইউনিট ও নীল কমল ইউনিটের আওতায় ৩৯ হাজারেরও বেশি টাকু ঘুরতো প্রতিনিয়ত। মিলের দুটি ইউনিটের সুতা উৎপাদন ক্ষমতা ছিল দৈনিক ১০ হাজার কেজি।
তবে এর জৌলুস বেশিদিন থাকেনি। ক্রমাগত লোকসানের ফলে ২০০৭ সালে শ্রমিক-কর্মচারীদের বিদায় জানানো হয় গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে। পরে সার্ভিস চার্জ পদ্ধতিতে মিলটি চালু হয়। তাও টেকেনি বেশিদিন। ২০১৭ সালের শেষের দিকে মিলটি ভাড়ায় নেয় নারায়ণগঞ্জের ট্রেড লিংক লি.। লোকসান হতে থাকায় একবছর কয়েক মাস চালানোর পর ২০১৯ সালে আবারও বন্ধ ঘোষণা করা হয় মিলটি। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় মরিচা পড়ে নষ্ট হচ্ছে কয়েক কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। প্রতিষ্ঠানটি দেখভালের জন্য বর্তমানে আট জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত আছেন।
পাঁচ বছর মিলটি বন্ধ থাকায় বেকার জীবন-যাপন করছেন এলাকার চারশ’ শ্রমিক। জেলার একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানটি অবিলম্বে চালু করতে সরকারি পৃষ্টপোষকতার দাবি শ্রমিকদের। শ্রমিক রেজাউল হক রেজা বলেন, ‘আমি এখানে চাকরি করতাম। রুটি-রুজি চলতো এর মাধ্যমে। এখন সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মসংস্থানই হলো আমাদের মূল দাবি। মিলটি চালু হলে আমাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।’
মিলটি চালুর দাবিতে কমিটি গঠন করা হয়েছে সম্প্রতি। পরিকল্পিতভাবে চালু করতে পারলে লাভবান হতে পারবেন কর্তৃপক্ষ, অভিমত শ্রমিক নেতৃবৃন্দের।
এ বিষয়ে ‘সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস্ চালু বাস্তবায়ন কমিটি’র দফতর সমন্বয়কারী শেখ শওকত আলী বলেন, ‘এই মিলের লাভ দিয়ে আমিন টেক্সটাইল মিল এবং মাগুরা টেক্সটাইল মিল গঠিত হয়েছে। কিন্তু বিএনপি সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণে আজ মিলটি দেউলিয়া হয়ে গেছে। সে সময় পাকিস্তানি তুলা আমদানি করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিলটি। আমাদের দাবি, সরকার যেকোনোভাবে মিলটি চালু করুক।’
সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস চালু বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যসচিব মাগফুর রহমান বলেন, ‘সরকার লস দিয়ে মিলটি চালাবে না। পিপিপির মাধ্যমে বিটিএমসি ইতোমধ্যে তিনটি মিল চালু করেছে। ত্রিশ বছরের লিজে সেগুলো তারা চালাচ্ছে। তারা লাভবান হতে পারলে এই মিলটি হবে না কেন।’
সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস চালু বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক শ্রমিকনেতা শেখ হারুন-উর-রশিদ বলেন, ‘সম্প্রতি মিলটি চালুর বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য আশরাফুজ্জামান আশু সংসদে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। মিলটি চালু না হলে একদিকে যেমন কয়েক কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হবে, তেমনি বেকার হয়ে পড়া শ্রমিকরা আর কাজে ফিরতে পারবেন না।’
মিলটির বর্তমান ইনচার্জ শফিউল বাশার বলেন, ‘১৯৮০ সালে ২৯.৪৭ একর জায়গার ওপর এটি গড়ে ওঠে। ১৯৮৩ সালে এটি চালু হয়। দেড় হাজারেরও বেশি শ্রমিক একসময় কর্মরত ছিলেন। ১৯৯২ সালে মূল ইউনিটের বাইরে ‘‘নীলকমল’’ নামে আরও একটি ইউনিট হয়। সুতা উৎপাদন থেকে থানকাপড় পর্যন্ত তৈরি হতো। তবে ক্রমাগত লোকসানের কারণে ২০০৭ সালে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে শ্রমিক-কর্মচারীদের বিদায় করা হয়। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়ে যান মিলটি দেখাশোনার জন্য। পরে সার্ভিস চার্জ পদ্ধতিতে মিলটি পরিচালিত হতো। একসময় সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। পরে ভাড়া পদ্ধতিতে চালানোর চেষ্টা চলে। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকট ও মেশিনারিজ পুরনো হওয়ায় ২০১৯ সাল থেকে আবারও বন্ধ হয়ে যায় মিলটি। আর চালানো সম্ভব হয়নি। আমি যতটুকু জানি, ভবিষ্যতে পিপিপির (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) মাধ্যমে মিলটি চালানোর চিন্তা বিটিএমসির আছে।’
তবে বাস্তবতার নিরিখে মিলটিকে চালানো সম্ভব নয়, বিধায় টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট তৈরি করার চিন্তাও সরকারের মাথায় রয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, ‘মিলটি বেশ আগে থেকে বন্ধ রয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে ক্রমাগত লোকসান দিয়ে টেক্সটাইল মিলকে হয়তো আর চালু করা সম্ভব হবে না। আমরা চিন্তা করছি, এটিকে একটি ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট করা যায় কিনা। যাতে শিক্ষার্থীরা এটি নিয়ে পড়ালেখা করতে পারেন। আমি ডিসি সম্মেলনে এই প্রস্তাব দিয়েছি। বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে এই প্রস্তাব দেওয়ার পরে তা তারা গ্রহণ করেছে। তিন একর জায়গা লাগবে ইনস্টিটিউট করতে। বাকি জায়গা অন্যভাবে ব্যবহারের কথা ভাবছে মন্ত্রণালয়, যাতে ভিন্ন ধরনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়।’