কুমিল্লা থেকে সাত তরুণ নিখোঁজের পেছনের কারিগরকে চিহ্নিত করেছে র্যাব। শহরের কোবা মসজিদের নিখোঁজ ইমাম শাহ মো. হাবিবুল্লাহ তাদের ঘর থেকে বের করেছে বলে র্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে। এদিকে, নিখোঁজদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই শিক্ষার্থীরা নিয়মিত কোবা মসজিদে নামাজ আদায় করতো এবং ইমামের সঙ্গে তাদের সখ্য ছিল।
বাংলা ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদনে র্যাবের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ইমাম হাবিবুল্লাহর নির্দেশেই ওই তরুণরা বাড়ি ছাড়ে। এর আগে তাদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়। তাদের ব্রেন পুরোপুরি ‘ওয়াশ’ হওয়ার পর ‘জিহাদের জন্য হিজরতে’ পাঠানো হয়। তবে তারা পুরোপুরি জঙ্গিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে কিনা এর আগে কয়েক ধাপে তাদের পরীক্ষা করা হয়। কেবল পুরোপুরি প্রস্তুত করা তরুণদের বাড়ি ছাড়ার জন্য নির্দেশ দিতেন এই হাবিবুল্লাহ। মূলত হাবিবুল্লাহর নির্দেশেই সাত তরুণ বাড়ি ছাড়ে।
নিখোঁজ হওয়া সাত জন—কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষার্থী ইমরান বিন রহমান (১৭), আস সামি (১৮), নিহাল (১৭), ভিক্টোরিয়া কলেজের অনার্সের (৩য় বর্ষ) শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম আলামিন (২৩), কুমিল্লা সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী হাসিবুল ইসলাম (১৮), ভিক্টোরিয়া কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত (১৯) ও কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করা নিলয় (২৫)। এরমধ্যে নিলয়ের বাড়ি কুমিল্লা নয়। ঢাকার বাসিন্দা হলেও কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ নিহালের খালাতো ভাই সে। এই সাত জনের মধ্যে এখন পর্যন্ত তিন জনকে উদ্ধার করেছে র্যাব। তারা হলেন—হাসিবুল ইসলাম, ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত ও নিলয়।
কে এই হাবিবুল্লাহ?
তিনি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের লইপুরা এলাকার মৃত মাওলানা মমতাজ উদ্দিনের ছেলে। চার বছর বয়সে বাড়ির পাশের দয়াপুর এমদাদুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে কয়েক বছর কাটানোর পর তাকে কুমিল্লা শহরের কাসেমুল উলুম মাদ্রাসার হেফজ বিভাগে ভর্তি করান বাবা মমতাজ উদ্দিন। তিনি ওই মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন তখন। ওই মাদ্রাসা থেকে শেষ করেন দাওরায়ে হাদিস। নিয়োগ পান কোবা মসজিদের ইমাম হিসেবে। পরে কুমিল্লার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এলাকার একটি মাদ্রাসায় প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। মাদ্রাসা ও মসজিদ দুটিতেই কর্মরত ছিলেন তিনি।
তার বড় ভাই ওয়ালি উল্লাহ দাবি করেন, ‘আমার ভাইয়ের কখনও এমন লক্ষণ (জঙ্গিবাদ) দেখিনি। সে ছোটবেলা থেকে মাদরাসায় পড়ার কারণে অনেক ধার্মিক ছিল। ধর্ম খুবই মানতো। ওই ছেলেরা (নিখোঁজ শিক্ষার্থীরা) আমার ভাইয়ের কাছে আসতো এটা শুনিনি। মুসল্লি হিসেবে আসতেই পারে। তার দুইটা ছেলেমেয়ে আছে।’
সূত্র জানায়, হাবিবুল্লাহ প্রায় ১০ বছর ধরে মসজিদটির ইমাম ছিলেন। কোবা মসজিদের পাশের ভবনেই থাকতেন নিখোঁজ হাসিবুল ইসলাম (র্যাব উদ্ধার করেছে)। হাসিবুলের সঙ্গে হাবিবুল্লাহর বেশ সখ্য ছিল। তারা মাঝে মাঝে তালিমেও (ধর্মীয় কথাবার্তা) বসতেন।
আরও পড়ুন: আদালত প্রাঙ্গণে সৃষ্টি হয় জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া’
মসজিদে গিয়ে দেখা গেছে, হাবিবুল্লাহর পাশের কক্ষে বসে আছেন তার সহকর্মী আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমার সহকর্মী ছিলেন। সম্পর্ক প্রায় ১২ বছরের। এক মাদ্রাসায় পড়তাম। কোনোদিনও আমার কাছে তিনি কোনও ব্যক্তিগত বিষয়ে বলেনি। সবসময় চুপচাপ। কথা তেমন বলতেন না। শুধু না আসতে পারলে মোবাইলে কল করে নামাজ পড়াতে বলতেন। এছাড়া কিছু বলতেন না। বহু বছর ধরে এমন দেখে আসছি তো, তাই আমার কাছে স্বাভাবিক লাগতো। হাসিবুলকে দেখতাম আসতো এখানে। তবে চিনতাম না। উনি যাওয়ার আগে কোনও কিছুই বলেননি। অসুস্থ ছিলেন তাই ছুটি নিয়েছেন। পরে আর ফেরেননি।’
নিখোঁজদের পরিবার যা বলছে
নিখোঁজ ইমরান বিন রহমানের বাবা মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলে গত ২৩ আগস্ট থেকে নিখোঁজ। নিখোঁজ হওয়ার দেড় থেকে দুই মাস আগে থেকে জুমার নামাজ কোবা মসজিদে পড়তো। বাসার পাশের মসজিদ রেখে কোবা মসজিদে কেন নামাজ পড়তে হবে জিজ্ঞাসা করলে বলতো, কোবা মসজিদের হুজুরের বয়ান তার ভালো লাগে।’
তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমার ছেলে ধার্মিক। ধর্মের নামে উগ্রবাদ-জঙ্গিবাদ আমি মনেপ্রাণে ঘৃণা করি। আমার ছেলের মাঝে এমন লক্ষণ কখনও চোখে পড়েনি। সে নিখোঁজ হওয়ার পরদিন সকালেই আমি কোতোয়ালি মডেল থাকায় ডিজি করি। আমার ছেলে একরাতের জন্যও ঘরের বাইরে ছিল না। আমাদের সন্দেহের বিষয়গুলো র্যাব-গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। সব ধরনের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছি। শুরু থেকেই র্যাব অত্যন্ত গুরুত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। আমাদের মনে সাহস জুগিয়েছে ও আশাবাদী করেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জঙ্গি তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেককেই র্যাব-গোয়েন্দা বাহিনী গ্রেফতার করেছে।’
এই বাবা আরও বলেন, ‘কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ সাত জনের তিন জনকে উদ্ধার করে আমাদের বিশ্বাস ও আস্থা আরও বাড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আমি আশাবাদী, আমার সন্তানও দ্রুত উদ্ধার হবে। এই দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদী জঙ্গিদের মদতদাতাসহ যারা এসব শিশুর মগজ ধোলাই করে ভুল পথে ঠেলে দিচ্ছে তাদের নির্মূল চাই। যেন কোনও বাবা-মা তার সন্তানদের মসজিদে পাঠাতে ভয় না পায়।’
নিখোঁজ নিহাল আবদুল্লাহর বাবা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আগে অশোকতলা এলাকায় ছিলাম। সেখান থেকে কোবা মসজিদ অনেক দূর। তবে সম্প্রতি আমরা রানির বাজারের পাশের এলাকায় চলে এসেছি। এখান থেকে কোবা মসজিদের দূরত্ব খুব বেশি নয়। মনে হচ্ছে, এই মসজিদেই যেতো নিহাল। তাছাড়া নিহালের খালাতো ভাই নিলয় যেহেতু জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যায়, সেহেতু তার ঘনিষ্ঠ নিহাল দূরে থাকার কথা নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ছেলেরা ভুল করতে পারে। ওদের বয়স খুবই কম। তাদের শোধরাবার সুযোগ দেওয়া হোক। ছেলে নিখোঁজের পর আমার ঘর কারবালা হয়ে আছে। আমরা কোনও উপায় দেখছি না। যেহেতু র্যাব কয়েকজনকে উদ্ধার করেছে। তাই আমরা আশ্বস্ত যে আমাদের ছেলেদেরও র্যাব উদ্ধার করবে।’
নিখোঁজ আস সামির বাবা মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘আমার বাসা থেকে কোবা মসজিদের দূরত্ব ১০ থেকে ১৫ মিনিট। আমার ছেলে সেখানে যেতো। অথচ তার বাসা থেকে দুই মিনিট দূরত্বে একটা মসজিদ আছে। এছাড়া পাঁচ মিনিটের দূরত্বে একাধিক মসজিদ আছে। এখন বুঝতে পারছি, সে কেন সেখানে যেতো। তবে রেগুলার না যাওয়ায় আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবিনি। সব জুমার নামাজে সে কোবা মসজিদে যেতো। আমি যদি জানতাম এই হাবিবুল্লাহ আমাদের ছেলেদের মগজধোলাই করছিল, আমি তো সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতাম।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি ছেলেরা ভুল করেছে। তাদের বয়স কম বলেই ভুল করেছে। আমরা তো আর এমন ভুল করতাম না। র্যাব অন্য ছেলেদের মতো আমাদের ছেলেদেরও খুঁজে বের করবে। আমাদের প্রত্যাশা আছে। আমরা চাই ছেলেরা ভুল থেকে সঠিক পথে আসুক। তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে নতুন জীবন গড়ুক।’
নিখোঁজ আল আমিনের মা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘ছেলেটা নিখোঁজ। মুখে ভাত ওঠে না। সাংসারিক জীবনে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় যাচ্ছে। আমার ছেলে এমন লাইনে যেতে পারে বিশ্বাসই করতাম না। এখন মনে হয় সে ভুল করেছে। সে কোবা মসজিদে যেতো। বাসা থেকে অনেক দূরে কোবা মসজিদ। সেখানে কেন যেতো এখন অনুভব করি। ওই মসজিদ থেকে নাকি কেউ একজন বলেছে ৪০ দিনের জন্য তাবলিগে যেতে। আমি নিষেধ করেছিলাম। এরপর সে আর কোনোদিন বলেনি তাবলিগের কথা। কিছু দিন পর সে নিখোঁজ হলো। আর আসেনি। তার দাদা অসুস্থ। আমাকে বলে আল আমিনকে এনে দিতে। আমি কী করে এনে দেবো জানি না।’
কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলেন, ‘আর সইছে না কিছু। ছেলের মুখ দেখি না কতদিন। সরকারের কাছে অনুরোধ, আমাদের ছেলেরা ভুল করতে পারে। তারা কখনও জেনে-শুনে এসব লাইনে যাবে না। তাদের কনভার্ট (মগজধোলাই) করা হয়েছে। যারা করেছে তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হোক। তারা নতুন জীবনে ফিরে আসুক এটাই চাই।’
র্যাব-১১ কুমিল্লার কোম্পানি অধিনায়ক মেজর মো সাকিব হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি সেন্ট্রালি (কেন্দ্রীয়ভাবে) দেখা হচ্ছে। তাই এই বিষয়ে সেন্ট্রাল থেকে বলতে পারবে।’