‘চুলা জ্বালবার পারি না। ঘরের সউগ (সব) তলে আছে। ছাওয়ার ঘরক (বাচ্চাদের) নিয়া খুব কষ্টে দিন পার করবার নাগছি। আর কতদিন এমন করি পানিত থাকবো, কী খাবো?’
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দি জীবনের দুর্ভোগের কথা এভাবেই বলছিলেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চর ভগবতীপুর গ্রামের জোহরা খাতুন।
একই ইউনিয়নের পোড়ার চরের বাসিন্দা মঞ্জিলা-শাহজালাল দম্পতি। জমানো টাকা দিয়ে টিন কিনে নতুন ঘর তুলেছিলেন। বানের পানি ঢুকে তার ঘর এখন যেন চৌবাচ্চা। কোমর পানিতে বাঁশের খুঁটি দিয়ে বিছানা দ্বিগুণ উঁচু করেও যেন রেহাই মিলছে না। শিশু সন্তান নিয়ে ওই ঘরেই এক সপ্তাহ ধরে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন। বাঁশের মাচানে চুলা তুলে সেখানেই রান্না করেন। উপকরণের অভাবে তিন বেলা রান্না করা সম্ভব হয় না। এক কিস্তি ত্রাণ সহায়তা পেলেও শিশু সন্তান নিয়ে ঘোলা পানির অসহনীয় বন্দিজীবনে তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এদিকে প্লাবিত এলাকায় কাজও জুটছে না।
মঞ্জিলা বলেন, ‘আমাগো দিন-রাইত কষ্ট আর ভয়ে কাটতাছে। পেট ভইরা খাইতেও পারি না। বাচ্চাটারে ঠিকমতো খাওয়াইতে পারি না। বাচ্চাটারে নিয়া লাগাতার ভয়ে থাহি।’
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভোগান্তি আর খাদ্যের স্বল্পতার কথা জানিয়ে শাহজালাল বলেন, ‘এক বেলা রান্দি সেটাই খাই। পানির মধ্যে কামাই কারবার (কাজ) নাই। কেমন করি চলি!’
শুধু সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়ন নয়, জেলার ৯ উপজেলার দেড় লক্ষাধিক দুর্গত মানুষ বিপদে আছেন। নদ-নদী অববাহিকার দিনমজুর ও কৃষক শ্রেণির এসব মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সরকারি-বেসরকারি সহায়তার দিকেই চেয়ে থাকেন। জুটলে পেট পুরে খেতে পারেন, নয়তো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অনাহার আর অর্ধাহারে দিন কাটে। প্রতিবছর বন্যাকবলিত হওয়ার পরও তারা সমতলে স্থানান্তরিত হতে পারেন না, সে সাধ্য তাদের নেই। বন্যা আর নদী ভাঙনকে তাই নিত্য ভোগান্তি মেনে তারা চর থেকে চরে অভিবাসিত হন।
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বিপৎসীমার ওপরে থাকা ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি সামান্য ওঠানামা করলেও, এখনও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে সপ্তাহব্যাপী স্থায়ী হওয়া বন্যায় দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে বানভাসিদের। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে চরা ও নিম্নাঞ্চলের প্লাবিত হয়ে পড়া ঘর-বাড়ি ও নৌকায় অবস্থান করা মানুষ। বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শুকনো খাবারের সংকটে পড়েছেন তারা। শৌচাগার সমস্যাও তীব্র। বন্যাকবলিত এলাকায় তীব্র হয়ে উঠছে শিশু ও গোখাদ্য সংকট।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, বুধবার (২২ জুন) সকাল ৬টায় ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ব্রহ্মপুত্রের পানি সামান্য কমলেও একই সময়ে নুনখাওয়া পয়েন্ট এই নদের পানি বিপৎসীমার ১৯ ওপর দিয়ে এবং চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা আমির হোসেন জানান, বন্যার পানিতে ঘর-বাড়ি তলিয়ে থাকায় তারা নিজেরা যেমন কষ্টে আছেন, তেমনি গো খাদ্যের সংকট তৈরি হওয়ায় গরু-ছাগলের খাবারও জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
একই ইউনিয়নের হানিফ ও আনছারসহ কয়েকজন বানভাসি জানান, তাদের বাড়িতে কোমর সমান পানি। গবাদিপশু নিয়ে পাশের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু নিজেদের ও গবাদিপশুর খাদ্য জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এলাকায় কিছু পরিবারে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হলেও, পশুখাদ্য নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে মানুষের সঙ্গে খাদ্য সংকটে পড়েছে বন্যাকবলিত এলাকার গবাদি পশু।
এদিকে সরকারি- বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাধ্যমতো বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে বিতরণ কার্যক্রমের ধীরগতিতে দুর্গত অনেক পরিবার ত্রাণ সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ করছেন।
দুর্গত এলাকার জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, তারা যে বরাদ্দ পেয়েছেন তা এলাকার দুর্গত মানুষের চাহিদার তুলনায় অনেক কম। তবে বরাদ্দ পাওয়া ত্রাণ তারা সংকটে থাকা দুর্গতদের মধ্যে বিতরণ করছেন।
উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া বলেন, ‘আমার এলাকায় বানভাসি পরিবার পাঁচ হাজার। সাত মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ পেয়েছি, যা ৪০০ পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। আরও খাদ্য সহায়তা দরকার। বানভাসিরা এখন কর্মহীন, ঘরে খাবার নেই। সবােইকে চালসহ আলু ও শুকনো খাবার দেওয়া প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার এলাকায় কোনও শিশুকাদ্য ও গোখাদ্য বিতরণ করা হয়নি। মানুষ নিজের পেটের খাবারের সঙ্গে গবাদিপশুর খাবার নিয়েও বিড়ম্বনায় পড়েছে। শুকনো জায়গা না থাকলে ঘাসই বা পাবে কোথায়!’
জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা জানায়, বুধবার পর্যন্ত বন্যা দুর্গতদের জন্য ৪শ’ মেট্রিকটন চাল, সাড়ে ১৮ লাখ টাকা ও এক হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগ বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া শিশু খাদ্যের জন্য ১৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা এবং গোখাদ্যের জন্য ১৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।