কৃষিজমিতে গড়ে উঠছে আবাসন, কমছে জমি ও ফসল উৎপাদন
বাংলাদেশ

কৃষিজমিতে গড়ে উঠছে আবাসন, কমছে জমি ও ফসল উৎপাদন

উত্তরের জেলা দিনাজপুরকে বলা হয় শস্যভান্ডার। জেলার অধিকাংশ জমি দুই এবং তিন ফসলি। রয়েছে চার ফসলি জমিও। অর্থাৎ কৃষি অর্থনীতির বড় অংশজুড়েই প্রভাব রয়েছে। তবে গত কয়েক বছর ধরে কৃষিজমিগুলোকে গিলে খাচ্ছে আবাসন প্রকল্প। ইটভাটা ও কলকারখানার পর আবাসন গড়ে উঠছে যত্রতত্র। এতে করে কমছে জমি ও ফসল উৎপাদন। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে কৃষকদের ওপর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় গত ছয় বছরে আবাদি জমি কমেছে তিন হাজার ২৩২ হেক্টর। এভাবে জমি কমলে হুমকিতে পড়বে ফসল উৎপাদন। জেলা কৃষি কর্মকর্তা বলছেন, আবাসন প্রকল্প থেকে কৃষিজমি রক্ষার ক্ষমতা কৃষি বিভাগের নেই। এটি বন্ধ করতে হলে আইন করে বন্ধ করতে হবে।

কৃষি বনায়ন ও পরিবেশ এবং স্থাপত্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিজমিতে আবাসন করতে হলে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করতে হয়। আর শ্রেণি পরিবর্তনের সময় যৌক্তিকতা এবং পরিবেশের বিষয়গুলো খেয়াল রাখা জরুরি। আবাসন প্রকল্পগুলো পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলছে। জমি ব্যবহারের আইন অনুযায়ী আবাসন স্থাপিত হবে। আইনের ফাঁক দিয়ে যাতে কৃষিজমিতে আবাসন না হয়, সেজন্য সমন্বয়ের প্রয়োজন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দিনাজপুরের রাজারামপুর এলাকায় পাশাপাশি তিনটি আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। কৃষি জমিগুলো প্লট আকারে বিক্রি করে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসন। অথচ দুই বছর আগেও এর একটি জমিতে আবাদ হতো টমেটো। আরেকটি আবাসন প্রকল্পের জমিতে দুই বছর আগে ছিল কলাবাগান, অপরটিতে আবাদ হতো ধান।

শুধু রাজারামপুর এলাকায় নয়, সদর উপজেলার মাতাসাগর, বুনাপাথার, কাটাপাড়া, নয়নপুর, মেডিক্যাল মোড়, সুখসাগর, কসবা, রামনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে আবাসন প্রকল্প। কৃষিজমিতে ফসলের পরিবর্তে উঠছে বড় বড় দালান ও ভবন। জেলার ১৩টি উপজেলায় একই চিত্র। শুধু শহরের আশপাশে কিংবা সড়ক-মহাসড়কের পাশে নয়, গ্রামের হাটবাজারের পাশেও গড়ে উঠছে আবাসন। একসময়ে ইটভাটা ও চালকলসহ বিভিন্ন মিলকারখানা যেভাবে কৃষিজমিগুলোকে গিলে খাচ্ছিল, এখন একইভাবে গিলে খাওয়ার দলে যুক্ত হয়েছে আবাসন প্রকল্প। এতে ফসল উৎপাদন দিন দিন কমলেও যেন দেখার কেউ নেই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর দিনাজপুর কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ছয় বছরে জেলায় কৃষিজমি কমেছে তিন হাজার ২৩২ হেক্টর। হিসাব অনুযায়ী ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে জমির পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৮১ হাজার ৪১ হেক্টর, ওই বছর কৃষিজমি কমেছে ৬০৮ হেক্টর, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে জমির পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৮০ হাজার ৫৩৬ হেক্টর, ওই বছর কমেছে ৫০৫ হেক্টর, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ছিল দুই লাখ ৮০ হাজার ৩০৭ হেক্টর, ওই বছরে কমেছে ২২৯ হেক্টর, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ছিল দুই লাখ ৭৯ হাজার ৫১০ হেক্টর, ওই বছরে কমেছে ৭৯৭ হেক্টর, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ছিল দুই লাখ ৭৯ হাজার ৯০ হেক্টর, ওই বছরে কমেছে ৪২০ হেক্টর এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরে জমির পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৭৮ হাজার ৪১৭ হেক্টর ওই অর্থবছরে কৃষিজমি কমেছে ৬৭৩ হেক্টর। 

আবাসন গড়ে উঠায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। কৃষিশ্রমিক ও বর্গা চাষিরাও ক্ষতির সম্মুখীন। এ ছাড়া কৃষিজমিতে মাটি ভরাট করে উঁচু আবাসন প্লট গড়ে উঠায় পানি নিষ্কাশনের রাস্তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

আবাসন প্রকল্প থেকে কৃষিজমি রক্ষার ক্ষমতা কৃষি বিভাগের নেই

সদর উপজেলার খামারকান্তবাগ এলাকার জিতেন চন্দ্র রায় বলেন, ‘কৃষিজমি কমে যাওয়ায় আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। প্রতি বছর চালের দাম বাড়ছে। আমি বর্গাচাষ করতাম, কিন্তু এখন প্লটের জন্য জমি পাচ্ছি না। ফলে আমরা কষ্টে আছি। এসব প্লট যারা করছেন তারা লাভের জন্য করছেন, কিন্তু লোকসানে আছি আমরা।’

দিনাজপুর পৌরসভার বুনাপাথার এলাকার গণেশ রায় বলেন, ‘প্লট হওয়াতে আমাদের আয়-রোজগার কমেছে। একসময়ে এসব জমিতে হাল চাষ করেছি, চারা রোপণ করেছি। কিন্তু এখন কাজ নাই।’

সদরের গুঞ্জাবাড়ী এলাকার কৃষ্ণা রাণী বলেন, ‘কৃষিজমি আমাদের অনেক প্রয়োজন। প্লট হওয়ায় খাদ্যের সংকটে পড়ছি। ধানের দাম বাড়ছে। কৃষিজমি যদি না থাকে আমাদের খাদ্যের আরও সংকট হবে।’

খামারকান্তবাগ এলাকার রনজিত রায় বলেন, ‘আমি কৃষক। জমি আবাদ করি। এখানে ১৬ বিঘা জমির ওপর আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। যে স্থান দিয়ে আমাদের জমির পানি নিষ্কাশন হয় সেই মুখেই মাটি ভরাট করে আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠায় পানি যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে গত কয়েক বছর ধরে ফন ভালো হচ্ছে না। এখানে প্রায় ১৫০ একর জমিতে একই সমস্যা। এই উৎপাদন কম হওয়ার কারণে সংকট সৃষ্টি হবে।’

রাজারামপুর এলাকায় নিজ জমিতে প্লট করেছেন কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এখানে পুকুর ছিল, তেমন লাভ হতো না। সেজন্য বালু দিয়ে ভরাট করে প্লট করেছি। এভাবে অনেকে প্লট করে লাভবান হচ্ছেন।’ 

কৃষিজমি রক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর দিনাজপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. নুরুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটির পদক্ষেপ কৃষি বিভাগ নেয়নি। এটি দেখার দায়িত্ব প্রশাসনের। তবে আমরা সবসময় বলে থাকি কৃষিজমিগুলো রক্ষা করা দরকার। যথাযথ কর্তৃপক্ষ যেন ব্যবস্থা নেয়। না হলে কৃষিজমি যার যেভাবে প্রয়োজন সেভাবে ব্যবহার করছেন। তবে নীতিমালা মেনে এটি ব্যবহার করা উচিত। আবাদি জমি আমাদের এত বেশি নয় যে এটা যেভাবে খুশি ব্যবহার করা যাবে। পতিত জমি, অনুর্বর জমি, নিচু এলাকা; যেখানে ফসল হয় না সেগুলো ব্যবহার করলে ফসলের ক্ষতি হবে না।’

দিনাজপুরের রাজারামপুর এলাকায় পাশাপাশি তিনটি আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে

কৃষির ওপর প্রভাব ফেলছে আবাসন, পদক্ষেপ নেবে কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কে রক্ষা করবে? কৃষি বিভাগ? কৃষি বিভাগের হাতে ওই ক্ষমতা নেই। আমি গিয়ে বাধা দিতে পারবো না, আমার সেই ক্ষমতা নেই। আমাকে সেই দায়িত্ব দেওয়াও হয়নি। আমরা মানুষকে বুঝিয়ে বলি, এটুকুই আমাদের ক্ষমতা।’

দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বনায়ন ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. সোয়াইবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কৃষিজমিতে আবাসিক প্রকল্প বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। কৃষিজমিতে আবাসিক প্রকল্প করতে হলে শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আবেদন করার নিয়ম আছে। পরিবেশের বিষয় খেয়াল করে আবেদন মঞ্জুর করা হয়। এখন অনেকে ড্রেন বা নালাগুলোর পাশে মাটি ভরাট করে আবাসন করছেন। এতে পানি প্রবাহের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই প্লাবিত হচ্ছে এলাকা। ময়লা-আবর্জনা ড্রেন থেকে বাসাবাড়ি এবং পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। জনদুর্ভোগ বাড়ছে। আবার অনেক স্থানে বনায়ন কেটে বাড়ি করা হচ্ছে। কোনও গাছ কেটে বাড়ি করতে হলে শ্রেণি পরিবর্তন করতে অনুমতি লাগবে। ব্যক্তিগত বাগান হলেও এটি পরিবেশের ওপর গুরুত্ব রাখছে। তখন অনুমতি দেওয়া যাবে যখন শর্ত দেওয়া হয়, যেমন সমপরিমাণ গাছ রোপণ করতে হবে। এর বাইরে কৃষিজমিতে আবাসন করলে অবশ্যই পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।’ 

কৃষিজমিগুলো প্লট আকারে বিক্রি করে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসন

হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক এসএম নাঈম হোসাইন মিথুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জমি ব্যবহারের আইন আছে। সেই আইন অনুযায়ী বাড়ি কিংবা আবাসন স্থাপিত হবে। রেজিস্ট্রেশন অফিসে জমি যখন হস্তান্তর কিংবা বিক্রি হয় তখন কী হিসেবে হস্তান্তর বা বিক্রি হচ্ছে সেটির ওপর অনেকটা নির্ভর করে। জমি ব্যবহারের যে প্ল্যান আছে, সেখানে যদি কোনও বাধা না থাকে তাহলে জমিতে আবাসন করলে সমস্যা নেই। তবে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা কিংবা ভূমি মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা রয়েছে, কৃষিজমিতে বাড়ি নির্মাণে বাধা দেওয়ার।’

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসলে এটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। কৃষি মন্ত্রণালয়ের একার কাজ নয়। কৃষিজমি বাস্তবায়নের নীতিমালা প্রণয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে আমরা কৃষিজমির ব্যবহার, ভূমি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সবকিছু মিলে একসঙ্গে কাজ করছি। দুই ও তিন ফসলি জমিগুলোতে যাতে কোনও অবস্থায় শিল্পায়ন না হয়, রাস্তাঘাট কিংবা অন্য কোনও আবাসন প্রকল্প গড়ে না উঠে, সেটি আমরা নিশ্চিত করতে চাই। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, পরিবেশ ও বন এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের নিয়ে আমাদের একটি বৈঠক করার কথা রয়েছে। এ ব্যাপারে একটা নীতিমালা গঠন হবে এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। যাতে কৃষিজমির ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় এবং সেখানে কোনও আবাসন গড়ে না ওঠে।’

Source link

Related posts

চট্টগ্রামে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ, রেললাইনের পাশে আগুন 

News Desk

জামা,জুতা,ব্যাগ কিনতে টাকা পাবে প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা

News Desk

ঘুরে দাঁড়িয়েছে জৌলুশ হারানো বিএফআইডিসি

News Desk

Leave a Comment