‘প্রজেক্টের কাজের ফাঁকে গ্রামে এসে দেখতে পাই, কৃষকরা চাষাবাদের জন্য ক্ষেতে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহার করছেন। এভাবে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে আমাদের পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। সেইসঙ্গে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে স্থানীয়ভাবে কিছু জৈব সার তৈরি করা দরকার। এই মোটিভেশন থেকেই এলাকায় কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন শুরু করি।’
কথাগুলো বললেন যশোরের মণিরামপুর উপজেলার জামজামি গ্রামের মো. সুলতানুজ্জামান তিতু। তিনি কেঁচো সার উৎপাদনের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন। প্রক্রিয়াজাত গোবর এবং কেঁচোর সন্নিবেশের ফলে এই সারের উৎপাদন হয়। এই সার ক্ষেত বা মাছের খামারে প্রয়োগ করে কৃষিজীবীরা অল্প খরচে কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদনে সমর্থ হচ্ছেন।
যাত্রা হলো শুরু যেভাবে
২০২১ সালের মে মাসে মণিরামপুর উপজেলার জামজামি গ্রামে মুক্তেশ্বরী নদীর পাশ ঘেঁষে ৫৬ শতাংশ জমিতে গড়ে তোলা হয় কেঁচো সার উৎপাদনের ক্ষেত্র। আড়াই কেজি কেঁচো ও ছয়টি রিং স্ল্যাব দিয়ে সার উৎপাদন শুরু করেন তিতু। কেঁচো কেনেন ৮০০ টাকা কেজি দরে। প্রতিটি রিং স্ল্যাব কেনেন ৩০০ টাকা দরে। প্রায় পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়।
প্রথম উৎপাদন চক্রে কেঁচো সার পান ৮০ কেজি; কেঁচোর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেলো। এরপর আরও পাঁচটি রিং স্ল্যাব যোগ করে উৎপাদিত সার প্রথমে নিজের নার্সারিতে প্রয়োগ করেন। এর ফল দেখানো হলো স্থানীয় নার্সারি মালিক ও কৃষকদের। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আগে থেকেই কেঁচো সারের গুণাগুণ সম্পর্কে অবহিত, কেউ কেউ দূর থেকে সেগুলো কিনে ব্যবহারও করতেন। তিতুর গাছের চারার সবুজ পাতা দেখে অনেকে সার কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। একজন কৃষক কিছু সার নিয়ে তার শসা ক্ষেতে প্রয়োগ করে সুফল পান।
চাহিদা বাড়ছে সারের
স্থানীয় কয়েক কৃষক ধানক্ষেতে, পানের বরজ ও নার্সারিতে কেঁচো সার প্রয়োগ করে সুফল পান। বিষয়টি অন্যদেরও আকৃষ্ট করে। চাহিদা বাড়তে থাকায় ১১টি রিংয়ের সঙ্গে আরও ১১টি যুক্ত করা হলো। এই ২২টি স্ল্যাবে উৎপাদিত সার দুই দিনেই শেষ হয়ে যায় এখন।
তিতু বলেন, ‘কৃষকদের চাহিদা পূরণ করতে পারি না। আগ্রহী কৃষকদের তাই বলতে বাধ্য হই, আর সার নেই।’
তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে সারের পরিচিতি বেড়েছে। সারের উৎপাদন বৃদ্ধিতে এখানে তৈরি করা হলো চারটি হাউজ; প্রতি সাইকেলে উৎপাদন তিন টন।’
হাউজ ও উৎপাদন চক্র
চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে নতুন আঙিকে যৌথভাবে সার উৎপাদনে যান তিতু। তার সঙ্গী হয়েছেন চাচাতো ভাই ইফতেখার সেলিম অগ্নি। পার্বত্য অঞ্চলে যার কাজু বাদাম, মালটা, চুই ঝাল, সজনে ইত্যাদি বাগান রয়েছে। সেখানে বছরে তার ৪০০-৫০০ টন কেঁচো সার লাগে।
তিতু বলেন, ‘দিন দিন চাহিদা বাড়ায় একরকম বাধ্য হয়ে বেশি মাত্রায় উৎপাদনে আগ্রহী হয়েছি। মে ও জুন মাস নাগাদ আমরা ১২ টন সার বিক্রি করেছি। এখন চাহিদা আরও বেশি। কিন্তু দিতে পারছি না।’
বেশি মাত্রায় উৎপাদনে ইতোমধ্যে চারটি শেডে ২৪টি হাউজ করা হয়েছে। প্রতিটি হাউজ ১২০ ঘন ফুট (প্রস্থ ৪ ফুট, দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট ও এক ফুট গভীরতা)। প্রতি ঘন ফুটে ১৩-১৪ কেজি গোবরের বিপরীতে ১১ কেজি সার উৎপাদন হয়। প্রতি ১০০ কেজি গোবরে এক কেজি পরিমাণ কেঁচো গড়ে ৩৫-৪০ দিনে সারে রূপান্তরিত হয়। কেঁচো সার মূলত কেঁচোর বিষ্ঠা।
তিনি বলেন, ‘গোবর প্রসেস, হারভেস্ট, প্যাকেটজাত ইত্যাদি করতে বছরে কমপক্ষে আটটি চক্রে সার পাওয়া যাবে। আগামী শীতকাল থেকে প্রতি সাইকেলে ৪২ টন করে সার উৎপাদন করা যাবে। সেক্ষেত্রে ৫০ টন গোবর প্রয়োজন পড়বে।’
কেঁচো ও গোবর সংগ্রহ
তিতু-অগ্নির যৌথ প্রতিষ্ঠান দীপ্ত ভার্মি কম্পোস্ট স্টেটে তিন ধরনের কেঁচো ব্যবহার করা হচ্ছে। একেকটি কেঁচো আড়াই থেকে তিন ইঞ্চি লম্বা। এর মধ্যে একটি গোলাপি রঙের, অন্যটি কালো, আরেকটি মোটা ও লালচে। এদের মধ্যে গোলাপি কেঁচো সবচেয়ে ভালো। এগুলোর দামও বেশি, কেজি প্রতি ১২০০ টাকা। অন্যান্য কেঁচোর কেজি প্রায় এক হাজার টাকা।
তিতু বলেন, ‘ডুমুরিয়া, সাতক্ষীরার তালা, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ এবং কেশবপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে কেঁচো সংগ্রহ করা হয়েছে।’
বাড়ি বাড়ি গরু পোষা আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কিছু খামার। মোটামুটি লোকাল কমিউনিটি থেকে গোবর সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে বেশ কিছু গোবর ব্যবসায়ী, কমিউনিটিতে বস্তা রেখে নির্দিষ্ট দাম দিয়ে এবং নিজস্ব গাড়ির মাধ্যমে গোবর সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে প্রতি সাইকেলে ৩৫ থেকে ৩৮ মেট্রিক টন গোবর ব্যবহার করা হয়। সামনের শীতে তা ৫০ মেট্রিক টন করা হবে।
যা বলছেন কৃষকরা
জামজামি গ্রামের কৃষক টিটো গাজী বলেন, ‘আমার ২০ শতক জমিতে ওল কচু চাষ করেছি। তিন দফায় জমিতে ফসফেট, পটাশ ও ইউরিয়া সার দিয়ে খরচ হয় প্রায় ২০ হাজার টাকা। এ বছর কেঁচো সারের সঙ্গে দুই কেজি পটাশ, দুই কেজি ফসফেট দিয়ে খরচ হয় ৮২০ টাকার মতো। ইতোমধ্যে গাছের উচ্চতা এবং পাতার পুরু দেখে স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, এবার উৎপাদন গতবারের দ্বিগুণ হবে।’
ব্রহ্মাডাঙ্গা গ্রামের শামসুর রহমান বলেন, ‘ধানক্ষেতে তিতুর তৈরি কেঁচো সার ব্যবহার করেছি। পাশের ক্ষেতের কৃষক রাসায়নিক সার ব্যবহার করেছেন। দুটো ক্ষেত পাশাপাশি দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, আমার ক্ষেতের পাতা সবুজ, মোটা ও চওড়া। তুলনামূলকভাবে এই সার ব্যবহারে ধানের পাতায় ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়। আশা করছি, ধানের উৎপাদনও ভালো হবে।’
কৃষি কর্মকর্তার ভাষমতে
মণিরামপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আবু হাসান বলেন, ‘আমার দেখা মতে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির এই স্টেটটি সবচেয়ে বড় ও আধুনিক। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এত বড় ফার্ম আর নেই। তিতুর চিন্তাধারা বেশ পরিপক্ব, সুন্দর ও পরিকল্পিত। আমরা আসলে তাদের টেকনিক্যাল কিছু সাপোর্ট দিয়েছি, অর্থনৈতিক কোনও সাপোর্ট দিইনি।’
তিনি বলেন, ‘মাটিতে ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকে। কিন্তু বেশি বেশি রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে তা এখন দুই শতাংশের নিচে নেমে গেছে। মাটির পুষ্টিগুণ বৃদ্ধিতে জৈব সারের বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে কেঁচো সার সেরা। আমরা কৃষকদের এই সার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করছি।’
তিতু বলেন, ‘আমি কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি অভিজ্ঞতা অর্জন করছি। এই সার প্রয়োগে পুকুরের পানিতে অণুজীব (ফাইটোপ্লাংকটন ও জুপ্লাংকটন, যা মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়) তৈরিতে দারুণ ভূমিকা রাখে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স সম্পন্ন করা মো. সুলতানুজ্জামান তিতুর জন্ম ১৯৬৫ সালে। তিনি দীর্ঘদিন বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থায় পরিবেশসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রকল্পভিত্তিক কাজ করেছেন। তার এই স্টেটে বর্তমানে স্থায়ী দুজন এবং পার্টটাইমার হিসেবে আট জন কাজ করছেন।