আনারসের রাজধানীখ্যাত টাঙ্গাইলের মধুপুর গড় অঞ্চল। লাল মাটির এই উপজেলায় উৎপাদিত রসে টইটম্বুর ও সুস্বাদু আনারসের খ্যাতি দেশজুড়ে। এখানের উঁচু-নিচু জমি ছাড়াও বসতবাড়ির আঙিনায় আনারস চাষ হয়। ভালো ফলন হওয়ায় এখানের মাটিকে কেউ কেউ হিরার সঙ্গে তুলনা করেন। ইতোমধ্যে এটি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি চাষিরা।
যেভাবে মধুপুরে এলো এই আনারস
১৯৪২ সালে মধুপুরের ইদিলপুর গ্রামের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী গারো সম্প্রদায়ের নারী উদ্যোক্তা মিজি সাংমা ভারতের মেঘালয়ের গাচ্ছুয়াপাড়া থেকে গরুর গাড়িতে করে ক্যালেন্ডার জাতের ৭৫০টি আনারসের চারা আনেন। প্রথমে বসতবাড়ির আঙিনায় চারা রোপণ করেন। প্রত্যাশার চেয়ে ফলন ভালো হওয়ায় চাষাবাদ বাড়িয়ে দেন। এই নারীর সফলতা দেখে এলাকার অনেকে তার কাছ থেকে চারা নিয়ে চাষ শুরু করেন। ধীরে ধীরে উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ হচ্ছে। খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। এজন্য উপজেলাকে আনারসের রাজধানী বলা হয়। বর্তমানে এখানে ক্যালেন্ডার ও জলডুগি জাতের আনারস চাষ হয়। তবে সম্প্রতি এমডি-২ নামে একটি জাত চাষ করা হচ্ছে। জুলাই-আগস্ট দুই মাস আনারসের মৌসুম ধরা হলেও এখন বছরজুড়ে পাওয়া যায়। দীর্ঘ ৮২ বছর পর ঐতিহ্য বহন করে আসছে এখানের আনারস।
কেন বিখ্যাত?
খ্যাতির মূল কারণ রসে টইটম্বুর ও সুস্বাদু। এর কারণ মাটি ও ক্যালেন্ডার জাত। মধুপুর অঞ্চলের উঁচু ও লাল মাটির জমি আনারস চাষের জন্য উপযোগী। বীজতলা প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে ১৮ মাস সময় লাগে ফল উৎপাদনে। চাষিরা প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে নির্ভরশীল। তবে বর্তমানে জৈব সার ব্যবহার হয়। এ ছাড়া চাষিরা রাসায়নিক সার ব্যবহার করে জৈব পদ্ধতিতে চাষ করেন। ফলে স্বাদ ও পুষ্টিগুণ ভালো থাকে। সব মিলিয়ে রসালো, সুমিষ্ট স্বাদ আর চমৎকার ঘ্রাণের জন্য বিখ্যাত এখানকার আনারস।
সপ্তাহজুড়ে আনারসের হাট
একসময় সপ্তাহে দুদিন মঙ্গল ও শুক্রবার হাট বসলেও বর্তমানে প্রতিদিন বসছে। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক সড়কঘেঁষে জলছত্র এলাকায় আনারসের হাটটি বিখ্যাত। সড়কের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে আনারস সাজিয়ে রাখা হয়। চাষিরা কেউ কেউ ভ্যানে, অটোরিকশায়, কেউ বাইসাইকেলে আবার কেউ ট্রাক বা পিকআপ ভ্যানযোগে আনারস নিয়ে হাটে আসেন। সেখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা আনারস কিনে ট্রাকভর্তি করে গন্তব্যে নিয়ে যান। আকারভেদে ২০ থেকে ৬০ টাকায় পিস বিক্রি হয়। প্রতিদিন হাটে কোটি টাকার বেশি বেচাকেনা চলে। উপজেলা থেকে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হওয়ায় ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, কুষ্টিয়া, বগুড়া, সিলেট, নাটোর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাই এই অঞ্চলের আনারস।
ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারি সহযোগিতা চান চাষিরা
ভরা মৌসুমে বাজার মন্দা থাকায় এবং উৎপাদন খরচ বাড়ায় লোকসান হয় চাষিদের। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ফলটির দাম অর্ধেকে নামায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। বর্তমানে চাহিদা কম থাকা ও ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন চাষিরা। অধিকাংশ চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দিশেহারা। কারণ সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় বাগান থেকে তুলে বাজারে নেওয়ার পর সেগুলো আর বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। এবার সারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে চাষের খরচ অনেক বেড়েছে। কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে গত বছরের চেয়ে অনেক কম দামে। আবাদ ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারি সহযোগিতা চান চাষিরা।
প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাদে হতাশা বেড়েছে চাষিদের
প্রাকৃতিক উপায়ে আনারস চাষে হতাশা বেড়েছে চাষিদের। কারণ স্বাভাবিকভাবে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করলে সময়মতো ফলন বড় হয় না। এ ছাড়া রঙও ঠিকভাবে আসে না। এ কারণে ক্ষেত থেকে তোলার পর ফলটি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হয়। এজন্য চাষিরা মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগের দিকে ঝুঁকছেন। দেশে উৎপাদিত মোট আনারসের সিংহভাগই এখানে উৎপাদিত হলেও অবহেলা, সঠিক পরিকল্পনা ও পরিচর্যার অভাবে এখানকার আনারসের সুনাম হারিয়ে যেতে বসেছে।
মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ
একসময় মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ না করলেও বর্তমানে অধিকাংশ চাষি অতিরিক্ত লাভের আশায় চারা রোপণের পর থেকেই বিভিন্ন ধাপে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করছেন। চারা রোপণের পর ফলন দ্রুত বের করার জন্য এই রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়। এ ছাড়া ফলন বড় করা ও পাকানোর জন্যও রাসায়নিক প্রয়োগ করছেন চাষিরা। এজন্য মৌসুমের আগেই আনারস পরিপক্ব করে বাজারে বিক্রি করেন তারা। এর ফলে আগের স্বাদ ও সুগন্ধ হারিয়ে যাচ্ছে।
৮২ বছর পর জিআই স্বীকৃতি
সরকারের ভৌগোলিক নির্দেশক ইউনিট গত ২৪ সেপ্টেম্বর মধুপুরের আনারসকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি সনদ দেয়। জেলা প্রশাসকের পাঠানো আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ট্রেডমার্কস অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. মুমিন হাসানের সই করা সনদে ৩১ শ্রেণিতে জিআই-৫২ নম্বরে মধুপুরের আনারসকে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৮২ বছর পর আন্তর্জাতিক বাজারে এর অবস্থান শক্তিশালী হলো। এতে বিশ্বে মধুপুরের আনারসের বাজার তৈরি হলো। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় মধুপুরসহ টাঙ্গাইল জেলার মানুষ খুশি হয়েছেন। এটিকে এই অঞ্চলের মানুষের জন্য গর্বের বিষয় বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
বিদেশে রফতানি নিয়ে দুশ্চিন্তা
মৌসুমের আগেই আনারস পরিপক্ব করতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগের কারণে বিদেশে রফতানি করা নিয়ে বিপাকে পড়তে পারেন চাষিরা। কারণ এগুলো রফতানি করা যাবে না। করলেও নষ্ট হওয়ার শঙ্কা থাকবে। সেইসঙ্গে মানের প্রশ্নও উঠবে। এজন্য রাসায়নিক ছাড়া প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদন করতে হবে।
ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন মিজি সাংমার বংশের লোকজন
আনারস চাষের উদ্যোক্তা মিজি সাংমা ১৬৮ বছর বয়সে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মারা যান। তার স্বামীর নাম ভ্রজনাথ মারাক। তিনিও মারা গেছেন। তাদের দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। তবে তারা কেউ জীবিত নেই। তবে তাদের বংশের লোকজন এখনও আনারস চাষের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
মিজি সাংমার নাতি অরবিন্দ্র সাংমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যতদূর জানি, আমার নানি সম্ভবত ১৯৪২ সালে ভারতের মেঘালয়ের গাচ্ছুয়াপাড়া থেকে গরুর গাড়িতে করে আনারসের চারা আনেন। সেগুলো বাড়ির আঙিনায় রোপণ করেন। ফলন ভালো হওয়ায় আরও বেশি জমিতে চাষ করেন। নানির কাছ থেকে চারা নিয়ে এলাকার মানুষও চাষ শুরু করেন। এবং শুধু মধুপুর নয়, সারা দেশে চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আনারস চাষের জন্য মধুপুরের মাটি বিখ্যাত।’
জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমার নানির হাত ধরে মধুপুরে প্রথম আনারস চাষ শুরু হয়েছিল। এখন জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা শুধু আমাদের পরিবারের নয়, পুরো জেলাবাসীর জন্য গর্বের বিষয়। এখন বিদেশে রফতানির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটি দ্রুত পচনশীল ফল। সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। যার কারণে চাষিরা লম্বা সময় নিয়ে এটা সংরক্ষণ করতে পারেন না। সরকার যদি সংরক্ষণের জন্য ব্যবস্থা নিতো, তাহলে চাষিরা উপকৃত হতেন।’
মিজি সাংমার আরেক নাতি অনিমেষ সাংমা বলেন, ‘ক্যালেন্ডার জাতের আনারসের চারা আমার নানি ভারত থেকে মধুপুরে নিয়ে আসেন। ওই সময় প্রাকৃতিক উপায়ে চাষ করেন। পরবর্তীতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে পুরো উপজেলায় চাষাবাদ ছড়িয়ে পড়ে। নানির পেশাটা আমরা এখনও ধরে রেখেছি।’
মানুষের চাহিদা বড়, প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত হয় ছোট
উপজেলার বেরীবাইদ ইউনিয়নের চুনিয়া গ্রামের সাবেক মেম্বার মফিজ উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবার দুই একর জমিতে আনারস চাষ করেছি। এ বছর আমার ৫০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার না করলে ফল বড় হয় না, রঙ ঠিক থাকে না। বাজারে মেডিসিন ছাড়া আনারসের চাহিদা একেবারেই কম। কোনটা প্রাকৃতিক আর কোনটা রাসায়নিক দিয়ে উৎপাদিত মানুষও চেনে না। এজন্য অনেকে আকার ও রঙ ঠিক রাখতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করছেন। ভালো রঙ ও আকারে বড় আনারসের চাহিদা বাজারে বেশি। স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনে না জেনে মানুষ খাচ্ছে। আমরা ঠেকাতে পারছি না।’
তবে জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা খুশি উল্লেখ করে মফিজ উদ্দিন বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য গর্বের। এখন রফতানি করতে পারলে চাষিরা লাভবান হবেন। তবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো।’
উপজেলায় ছয় হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে চাষ
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাকুরা নাম্নী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মধুপুরে এ বছর ছয় হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়েছে। মূলত ক্যালেন্ডার ও জলডুগি জাতের চাষ হয়ে থাকে। এ ছাড়া ফিলিপাইন থেকে আনা এমডি-২ জাতের আনারস চাষ হয়। উপজেলায় এই তিন জাতই এখন চাষ হচ্ছে।’
জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় রফতানির সুযোগ তৈরি হলো জানিয়ে শাকুরা নাম্নী আরও বলেন, ‘এখন সুনিশ্চিতভাবে পরিকল্পনা দরকার। সেক্ষেত্রে আমরা করতে পারি, কীভাবে নিরাপদে উৎপাদন করা যায়। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করতে পারি। ভেজালমুক্ত উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। রফতানির জন্য কিছু নির্দেশনা আছে। অবশ্যই চাষিদের রাসায়নিকমুক্ত চাষ করতে হবে। আমাদের পরামর্শ অনুযায়ী, নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় প্রয়োগ করে যখন আনারস চাষ করবে তখনই এটি রফতানির জন্য বিবেচিত হবে।’
আমরা সার্বক্ষণিক কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে থাকি উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘তারা যেন অতিরিক্ত মাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার না করেন। সঠিক মাত্রা ও সঠিক সময়ে ব্যবহার করতে হবে। আনারসের ৩২ থেকে ৩৬ পাতা না আসা পর্যন্ত রাসায়নিক দেওয়া যাবে না। যখন সেভাবে নির্দেশনা দেওয়া আছে, ঠিক সেভাবেই ব্যবহার করতে হবে। নিরাপদ আনারস চাষের ক্ষেত্রে আমরা চেষ্টা করছি। ভোক্তাদের মাঝেও সচেতনতা আসতে হবে। যেমন অনেক ভোক্তাই আছে, আনারস টকটকে হলুদ না হলে কিনতে চান না।’
জেলায় সাত হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. কবির হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চলতি মৌসুমে জেলায় সাত হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়েছে। এতে প্রায় পৌনে তিন লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন হবে। ন্যায্যমূল্য পেতে উন্নত জাত উৎপাদনের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের জ্যাম, জেলি, জুস ও আচার উৎপাদনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এটি জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় রফতানির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।’