বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রেক্ষাপটে ১৮ ফেব্রুয়ারি বেশ গুরুত্ব বহন করে। ১৯৬৯ সালের এই দিনে বাংলাদেশের একজন বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ হন। তিনি হলেন ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা। শহীদ হওয়ার ৫৬ বছর পেরিয়ে গেছে। শামসুজ্জোহা একজন বাঙালি শিক্ষাবিদ ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে তিনি হাত উঁচিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বলেছিলেন, ‘প্লিজ, ডোন্ট ফায়ার। আমার ছাত্ররা এখনই চলে যাবে।’ ছাত্রদের জীবন বাঁচাতে শিক্ষকের প্রাণ উৎসর্গের ঘটনা ইতিহাসে বিরল। অথচ এত বছরেও মেলেনি স্বীকৃতি। ড. জোহা দিবসকে জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণার দাবি ছাত্র ও শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের। সেটি আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
পড়াশোনা ও কর্মজীবন
১৯৬১ সালে ড. শামসুজ্জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন এবং পরের বছরেই উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে লন্ডনের বিখ্যাত ইমপেরিয়াল কলেজে যান। ১৯৬৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৬ সালে রিডার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা করলে ছাত্র-শিক্ষকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষই অনুধাবন করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বাধীনতার বীজ বপন করলেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে আত্মদানকারী প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা, যার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের দাবানল সারা দেশে বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল।
প্লিজ, ডোন্ট ফায়ার – পাকিস্তান সেনাদের বলেছিলেন ড. জোহা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে। এ সময় ড. শামসুজ্জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম হলের প্রাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১৯৬৬-১৯৬৮, তত দিনে বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করলে ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলায় গণ-আন্দোলন শুরু হয়। এমন একটি আবহে ড. জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হলে তাদের হত্যার প্রতিবাদ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। একই দাবিতে ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে এবং ধর্মঘট পালিত হয়। ওই দিন ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল বের করলে ড. জোহা ছাত্রদের বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনেন এবং আহত ছাত্রদের হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই দিন রাতে শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সভায় ড. জোহা বলেছিলেন, ‘শুধু ছাত্ররা নয়, আমরা সবাই মিলে এই দানবীয় শক্তিকে রুখে দাঁড়াব, মরতে যদি হয় আমরা সবাই মরব।’
১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা মিছিল নিয়ে শহরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন পুলিশ, ইপিআর, সেনাবাহিনী ও ছাত্ররা মুখোমুখি অবস্থানে। ড. জোহা একদিকে ছাত্রদের শান্ত করছিলেন, অন্যদিকে সেনা কর্মকর্তাদের বোঝাচ্ছিলেন আর বারবার বলছিলেন, ‘প্লিজ, ডোন্ট ফায়ার। আমার ছাত্ররা এখনই ক্যাম্পাসে ফিরে যাবে।’ একপর্যায়ে ছাত্রদের বোঝাতে সক্ষম হন, ছাত্ররা ক্যাম্পাসে ফিরতে শুরু করেন। পরিস্থিতি যখন শান্ত, ঠিক তখনই গুলির শব্দ। ড. জোহাকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয় এবং বেয়নেট চার্জ করে ক্ষতবিক্ষত করা হয়। দীর্ঘ সময় পর রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়, ততক্ষণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়, যার ফলে ড. দত্ত অনেক চেষ্টা করেও ড. জোহাকে বাঁচাতে পারেননি।
ড. জোহা কি আর জন্মাবেন?
ড. শামসুজ্জোহা শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও অনেক সুনাম কুড়িয়েছিলেন। ছাত্রছাত্রীদের অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। ছাত্র-অন্তপ্রাণ শিক্ষক ড. জোহা সর্বদাই ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল, অত্যন্ত মিশুক ও অমায়িক। ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো এবং অভিভাবকসুলভ। এই মহান শহীদ বুদ্ধিজীবী ১৯৩৪ সালের ১ মে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং শিক্ষাজীবনের সব ক্ষেত্রেই সফলতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালে প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিকুলেশন ও ১৯৫০ সালে প্রথম শ্রেণিতে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরবর্তী সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। উনসত্তরের এই সাহসিক আত্মত্যাগ তার সংগ্রামী বিবেক এবং শিক্ষকসুলভ দায়িত্ববোধেরই পরিচয় দেয়।
আজ পর্যন্ত মেলেনি জাতীয় দিবসের স্বীকৃতি
তার মৃত্যুর পর থেকে দিনটিকে ড. জোহা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিবসটি পালনের জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। দীর্ঘ পাঁচ দশকের বিভিন্ন সময় নানা কর্মসূচি, মানববন্ধন করে দিবসটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণার জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কিন্তু আজ পর্যন্ত মেলেনি জাতীয় দিবসের স্বীকৃতি।
গণস্বাক্ষর কর্মসূচি
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি শহীদ ড. জোহা দিবসকে জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণার দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি পালন করেছে রাবি কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোট। এ সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শহীদ জোহার আত্মত্যাগের গুরুত্ব অনেক। তাৎপর্যের দিক থেকে দিবসটি সমগ্র দেশজুড়ে পালিত হওয়ার কথা। তবে দীর্ঘদিনের দাবির পরও সেটা এখনও হয়নি। অবিলম্বে দিবসটি জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণার দাবি করছি।’
গণস্বাক্ষর কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে অবিলম্বে দিবসটি জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণার জোর দাবি জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মাঈন উদ্দীন ও অধ্যাপক ফরিদ খান, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মতিয়ার রহমান, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতেখারুল আলম মাসুদ, বঙ্গবন্ধু হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জামিরুল ইসলাম, নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক রহমান রাজু, ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম সারওয়ার, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অমিত কুমার দত্ত, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক আরিফুল ইসলাম, রিকশাচালক আনছার আলীসহ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা।
কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি রায়হান ইসলাম বলেন, ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টিতে শহীদ জোহার অবদান অনেক। দিবসটি জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণার করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৬ বছর পরও সেটা হয়নি। যা মহান এই শিক্ষকের আত্মত্যাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ইতিহাসের অমর্যাদা। অবিলম্বে দিবসটি জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণার দাবি জানাই। এই গণস্বাক্ষর ও গণবিবৃতি কর্মসূচি চলবে।’
দিবসের আয়োজন
১৮ ফেব্রুয়ারি শহীদ ড. জোহার স্মরণে তার সমাধি ও স্মৃতিফলকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, স্মারক বক্তৃতা, রচনা প্রতিযোগিতা, প্রামণ্যচিত্র প্রদর্শনী ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে রাবি প্রশাসন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, ‘ড. শামসুজ্জোহা দেশের প্রত্যেকটি মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার নাম। তিনি কি আর জন্মাবেন? ১৯৬৯-এ তার আত্মত্যাগ গণ-আন্দোলনকে বেগবান করেছিল। আজকের শিশুরা বেড়ে উঠছে স্বাধীন দেশের হাওয়া আর জলে, এই শিশুরা হয়তো জানতে পারবে না ড. শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগের তাৎপর্য। কিন্তু জোহা দিবসকে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করলে এই ইতিহাসটি বছরের পর বছর নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে।’
ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতিকে চির অম্লান করে রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেটের সামনে ড. জোহার গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থানটিতে নির্মাণ করা হয়েছে জোহা স্মৃতি ফলক এবং মূল গেট দিয়ে প্রবেশ করলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রশাসন ভবনের সামনে অবস্থিত শহীদ জোহার কবর। শহীদ শামসুজ্জোহা হলের সামনে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ শামসুজ্জোহা স্মৃতি ভাস্কর্য ‘স্ফুলিঙ্গ’।