ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের প্রায় এক সপ্তাহ পর সোমবার (১২ আগস্ট) সকাল থেকে পুরোদমে দায়িত্ব পালনে মাঠে নেমেছে পুলিশ। নানা দাবিতে কর্মবিরতি পালন করা রাষ্ট্রীয় বাহিনীটির মাঠপর্যায়ের সদস্যদের অভিযোগ, কিছু উচ্চাভিলাষী পুলিশ কর্মকর্তার রাজনৈতিক দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্য ও লেজুড়বৃত্তির কারণে পুলিশ বাহিনী বারবার জনগণের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ‘লাঠিয়াল বাহিনী’ হিসেবে মাঠে কাজ করতে বাধ্য হয়। এই চর্চা থেকে বের হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টির দাবি করেছেন পুলিশ সদস্যরা।
পুলিশ সদস্যরা বলছেন, ‘প্রতিপক্ষ নয়, আমরা দেশ ও জনগণের আস্থার প্রতীক হতে চাই।’ কুড়িগ্রাম জেলা পুলিশের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এমন অভিমত পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল পর্যায়ের একজন পরিদর্শক বলেন, ‘সদ্য শেষ হওয়া আন্দোলনে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জনরোষ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। আমরা পুলিশের সংস্কার চাই। একটা প্রমোশনের জন্য, কিছু টাকার জন্য যারা মানুষ হত্যার নির্দেশ দিতে পারে, আমরা তেমন নেতৃত্বের সঙ্গে কাজ করতে চাই না। এমন নির্যাতিত চাকরি আমরা করতে চাই না।’
বিগত সরকারের আমলে পুলিশিংয়ের তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এই পরিদর্শক বলেন, ‘পুলিশের কাজ হচ্ছে ম্যানেজ করা। কোনও সহিংসতা যেন না ঘটে, কোনও গ্যাঞ্জাম যেন না হয় সেগুলো ম্যানেজ করা পুলিশের দায়িত্ব। এই পুলিশকে কি কোনোভাবে ম্যানেজের জায়গায় রাখছে? বাড়ি থেকে ফোন করে বলে, তুই পুলিশে চাকরি করিস নাকি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে জয়েন করেছিস!’
‘গত ১৫ বছরে আমরা কোনও জামায়াত-বিএনপি নেতার সঙ্গে কথা বলতে পারি নাই। কেউ একটা সালাম দিলে নিতে পারি নাই। একটা চায়ের দোকানে বসে চা খেতে পারি নাই। এই সামাজিক বন্ধন থেকে আমাদের ছিন্ন করলো কে?’ প্রশ্ন রাখেন তিনি।
আগামী দিনের প্রত্যাশা সম্পর্কে জানতে চাইলে এই পুলিশ পরিদর্শক বলেন, ‘দেশ আমাদের সবার। আমরা চাই পুলিশের কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ হোক। আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাই। আমাদেরও জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। খারাপ কাজের জন্য যেমন জবাব দেবো, ভালো কাজ করলেও স্বীকৃতি চাই।’
থানাপর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী আরেক পুলিশ পরিদর্শক বলেন, ‘প্রত্যেক সরকারই তাদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে পুলিশকে ব্যবহার করছে। এই অবস্থা থেকে পুলিশ বাহিনী পরিত্রাণ চায়। পুলিশ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে চায়। প্রতিপক্ষ নয়, আমরা দেশ ও জনগণের আস্থার প্রতীক হতে চাই।’
কয়েকজন উপসহকারী পরিদর্শক (এসআই) ও সহকারী উপসহকারী পরিদর্শক (এএসআই) পর্যায়ের পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে একই ধরনের ক্ষোভ ও অভিমত পাওয়া গেছে। তারা চান, পুলিশ বাহিনী তার প্রবিধান (পিআরবি) অনুযায়ী কাজ করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার করে পুলিশের জন্য স্বাধীন কর্মপরিবেশ তৈরি করবে।’
জেলা পুলিশের নেতৃত্বপর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজনীতি নয়, আমরা চাকরি করতে চাই। পুলিশ অফিসাররা যখন রাজনৈতিক বক্তব্য দেন তখন লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। আমাদের সদস্যরা যে দাবিগুলো তুলেছেন তা যৌক্তিক। আমরা সেগুলোর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করি।’
পুলিশ সুপার (এসপি) আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘সাম্প্রতিক আন্দোলনে কুড়িগ্রাম পুলিশ অত্যন্ত ধৈর্য ও কৌশলের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। আমাদের সদস্যদের বিভিন্ন দাবির বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। আশা করছি, কর্তৃপক্ষ সেগুলো বাস্তবায়ন করবেন এবং পুলিশ বাহিনী সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে সততা, নিষ্ঠা ও পেশাদারত্বের সঙ্গে পরিচালিত হবে।’ সোমবার থেকে জেলার ১১টি থানাসহ ট্রাফিক বিভাগে পুলিশ সদস্যরা পুরোদমে কাজে যোগ দিয়েছেন বলে জানান এসপি।