ত্বকী হত্যার ১১ বছর পর ‘আশার আলো’ দেখছেন আইনজীবী ও স্বজনরা
বাংলাদেশ

ত্বকী হত্যার ১১ বছর পর ‘আশার আলো’ দেখছেন আইনজীবী ও স্বজনরা

নারায়ণগঞ্জের মেধাবী শিক্ষার্থী তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার পায়নি পরিবার। প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের দাপটে মামলাটির তদন্তকাজ থমকে যায়। তবে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে একে একে ত্বকী হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-১১। এতে অচিরেই মামলাটি ‘আলোর মুখ’ দেখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন নিহতের স্বজনসহ সংশ্লিষ্টরা।

সেই সঙ্গে সাবেক এমপি শামীম ওসমান ও তার ছেলে অয়ন ওসমানসহ জড়িতদের মামলায় অন্তর্ভুক্ত করার জোর দাবি জানিয়েছেন নিহতের বাবা রফিউর রাব্বি। প্রতিমাসের মতো আজ ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় ত্বকী হত্যার বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ জানাবে নিহত ত্বকীর স্বজন ও নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের নেতৃবৃন্দরা।

জানা যায়, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকালে সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী নিখোঁজ হন। এর দুই দিন পর ৮ মার্চ সকালে শীতলক্ষ্যা নদীর খালের পাড় থেকে পুলিশ ত্বকীর লাশ উদ্ধার করে। ওই রাতেই ত্বকীর বাবা বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় আসামি অজ্ঞাত উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন এবং ১৮ মার্চ জেলা পুলিশ সুপারের কাছে ত্বকী হত্যার জন্য এমপি শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, যুবলীগ নেতা জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া পারভেজ, জেলা ছাত্রলীগ সহসভাপতি রাজীব দাস, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান, সালেহ রহমান সীমান্ত ও রিফাত বিন ওসমানের নাম উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অবগতিপত্র দেন।

তবে ২৪ মার্চ শামীম ওসমান সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ত্বকী নিখোঁজ ও লাশ উদ্ধারের সময়ে তিনি ও তার ছেলে অয়ন দেশের বাইরে ছিলেন।

ওই সময় অভিযুক্ত রিফাত বিন ওসমানকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তবে নিহতের বাবা রফিউর রাব্বির আবেদনে হাইকোর্টের নির্দেশে ওই বছরের ২০ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে র‌্যাবের কাছে মামলা হস্তান্তর করা হয়। র‌্যাব পরে ইউসুফ হোসেন লিটন, সুলতান শওকত ভ্রমর, তায়েব উদ্দীন জ্যাকি ও সালেহ রহমান সীমান্ত নামের চার জনকে গ্রেফতার করে। এ চার জনের মধ্যে ইউসুফ হোসেন লিটন ও শওকত হোসেন ভ্রমর আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এরা সবাই এখন জামিনে আছেন।

ওই বছরের ৭ আগস্ট র‌্যাব কর্মকর্তা আরিফ হোসেন, এম এম রানাসহ র‌্যাবের কয়েকজন শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে আজমেরী ওসমানের মালিকানাধীন ‘উইনার ফ্যাশন’-এ অভিযান চালিয়ে রক্তমাখা জিন্সপ্যান্ট, পিস্তলের বাট ও ইয়াবা সেবনের সরঞ্জামাদিসহ বিপুল পরিমাণ সামগ্রী উদ্ধার করেন। অভিযানের সময়ে অফিসের দেয়াল, সোফা, আলমারিসহ আসবাবপত্রে অসংখ্য বুলেটের দাগ পাওয়া যায়।

আজমেরী ওসমান সাবেক এমপি শামীম ওসমানের ভাতিজা ও প্রয়াত এমপি নাসিম ওসমানের ছেলে।

২০১৪ সালের ৬ মার্চ তৎকালীন র‌্যাবের সহকারী মহাপরিচালক (এডিজি) জিয়াউল আহসান ঢাকাতে সংবাদ সম্মেলনে করে জানান, তদন্তে সন্দেহভাজন হিসেবে ওসমান পরিবারের সদস্য আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ত্বকী হত্যায় অংশ নেওয়া বাকি ১০ জন হলেন রাজীব, কালাম শিকদার, মামুন, অপু, কাজল, শিপন, জামশেদ হোসেন, ইউসুফ হোসেন ওরফে লিটন, সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর ও তায়েবউদ্দিন ওরফে জ্যাকি। কে, কখন, কীভাবে ত্বকীকে অপহরণ করে হত্যা করেছে র‌্যাব তার বর্ণনা দিয়েছিলেন। এরপর নাটকীয়ভাবে থমকে যায় মামলার তদন্তকাজ।

তবে সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ত্বকী হত্যা মামলায় আজমেরী ওসমানের গাড়িচালক মো. জামশেদসহ ছয় ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এর মধ্যে আজমেরী ওসমানের সহযোগী কাজল হাওলাদার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্য দুই আসামি শাফায়েত হোসেন ও মামুন মিয়াকে দুই দফায় ৯ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গাড়িচালক জামশেদকে পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে রয়েছেন। ইয়ার মোহাম্মদ ও আব্দুল্লাহ আল মামুন কারাগারে আছেন।

এদিকে ত্বকী হত্যার পর থেকে বিচারের দাবিতে প্রত্যেক মাসের ৮ তারিখ আলোকশিখা প্রজ্জ্বালন কর্মসূচি পালন করে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ ও নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের নেতৃবৃন্দরা। এ নিয়ে ১৩৯ মাস ধরে এই প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন তারা।

প্রতিমাসের ৮ তারিখ আলোকশিখা প্রজ্জ্বালন

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি ও সংগঠনের উপদেষ্টা ভবানী শংকর রায় বলেন, ‘আজমেরী ওসমানের টর্চারসেলে ত্বকীকে কারা হত্যা করেছে এটা সবাই জানে। বিচারের দাবিতে এখনও আমরা প্রতিবাদ করে আসছি। আশা করছি, অচিরেই ত্বকী হত্যার বিচারকাজ শুরু হবে।’

নিহত ত্বকীর বাবা ও সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, ‘ত্বকী হত্যা মামলার শুরুতে র‌্যাব বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে জানিয়েছিল, ওসমান পরিবারের নেতৃত্বে টর্চারসেলে ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে। তবে তৎকালীন সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে ওসমান পরিবারকে দেখে রাখার কথা বলেন। এরপর থেকে হত্যা মামলার তদন্ত রহস্যজনকভাবে থমকে যায়।’

শামীম ওসমানের সঙ্গে বিরোধ ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজমেরী ওসমানের সঙ্গে আমার বা ত্বকীর কোনও সম্পর্ক বা বিরোধ ছিল না। শামীম ওসমানের সঙ্গে আমার বিরোধ ছিল। তার দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট, খুনের বিরুদ্ধে আমরা কথা বলেছি। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র আইভীকে সমর্থন দিয়েছিলাম। নির্বাচনে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে শামীম ওসমান পরাজিত হয়। বাসভাড়া কমানোর দাবিতে আন্দোলন করেছিলাম। এসব কারণে ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছিল। যার ফলে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, তার সহযোগী শাহ নিজামের নামগুলো আসতে হবে।’

ত্বকীর মামলার আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ বাবু বলেন, ‘শুরুতে র‌্যাব তদন্ত শুরু করলে মামলার পুরো বিষয়টি থমকে যায়। এর ফলে ২০১৮, ২০২০, ২০২১, ২০২৩ সালে আদালতে দরখাস্ত দিয়েছিলাম যে, ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে যাদের নাম এসেছে তাদের দ্রুত গ্রেফতার এবং অভিযোগপত্র দাখিলে তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবকে নির্দেশ দেওয়ার জন্য। তখন আদালত তাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দিষ্ট কোনও সময় দেওয়া হয়নি। তবে সম্প্রতি র‌্যাব অভিযান চালিয়ে ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে। ফলে এই মামলায় কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।’

ত্বকী হত্যা মামলার তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা বলেন, ‘আমরা ৬ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। এদের মধ্যে একজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। আমরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলার চার্জশিট দিতে সক্ষম হবো।’

Source link

Related posts

জমেছে রাজশাহীর আমের হাট, কেজি ৭০ টাকা

News Desk

বাংলাদেশকে নিয়ে অমিত শাহের মন্তব্যের কড়া জবাব পররাষ্ট্রমন্ত্রী

News Desk

সুস্বাদু হাঁড়িভাঙ্গা আমের বাজারজাত শুরু হবে ২০ জুন

News Desk

Leave a Comment