রেহেনা বেগমের মুখে অকৃত্রিম সুখের হাসি। ২০ বছর ধরে বয়ে বেড়ানো যন্ত্রণার অবসান হয়েছে। অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে নরসিংদীর রামপুর গ্রামে ফিরে যাবেন তিনি।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর মগবাজার চৌরাস্তা এলাকার মামস্ ইনস্টিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড ওমেন্স হেলথে কথা হয় রেহেনা বেগমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৪ বছর বয়সে গঙ্গারচর গ্রামের কৃষি মজুর আইয়ুব খানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের দুই বছর পর প্রথম সন্তান জন্মের সময় প্রসবজটিলতা দেখা দিলে সন্তানটি মারা যায়।
২০ বছর আগে রেহেনার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয়েছে অস্ত্রোপচারে। সেই সময় রেহেনা ফিস্টুলায় আক্রান্ত হন। নারীর রোগগ্রস্ততার সবচেয়ে বিধ্বস্তকারী পরিস্থিতি এই ফিস্টুলা। এতে মাসিকের ও প্রস্রাবের পথ এক হয়ে যায়। ফলে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন রেহেনা। প্রস্রাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন, অনবরত ঝরতে থাকে। শরীরে গন্ধ। একপর্যায়ে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় তাঁর। অনাদরে, অবহেলায় কেটেছে বছরের পর বছর। অস্ত্রোপচারের পর এখন তিনি সুস্থ। এই হাসপাতালের খবর পেলেন কার কাছে—এমন প্রশ্নের জবাবে রেহেনা বেগম বলেন, ‘আমাগো এলাকার এক মহিলার কাছে খবর পাই। হ্যায় আমার মতোই গরিব।’
মামস্ ইনস্টিটিউটে অস্ত্রোপচারে রেহেনাকে কোনো টাকা দিতে হয়নি। ওষুধপত্রের জন্যও কোনো খরচ লাগেনি। হাসপাতালে এক মাস থাকার জন্য শয্যাভাড়া লাগেনি। তিন বেলা খেয়েছেন, এ জন্যও কেউ কোনো টাকা নেয়নি। অর্থাৎ একদম বিনা মূল্যে নতুন জীবন পেয়েছেন রেহেনা বেগম। শুধু রেহেনা নন, এই হাসপাতালে সব রোগীই বিনা খরচে চিকিৎসা নিতে পারেন।
হাসপাতালটি শুধু চরম দারিদ্র্যে থাকা নারীদের জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য। নারীদের চিকিৎসাসেবায় পথপ্রদর্শক হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেছেন অধ্যাপক সায়েবা আখ্তার। প্রসবকালে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বন্ধে কনডম দিয়ে তৈরি প্রযুক্তি ‘সায়েবা মেথড’ দেশে–বিদেশে বহু নারীর জীবন রক্ষা করেছে। এই প্রযুক্তির উদ্ভাবক তিনি। চিকিৎসায় বিশেষ অবদান রাখায় ২০২০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদক দেয়।
বিন্দু বিন্দু অনুদানে গড়ে ওঠা
মগবাজার চৌরাস্তার কাছে নিউ ইস্কাটনে একটি বহুতল ভবনের তলায় ছোট এই হাসপাতাল। অসংখ্য বিজ্ঞাপন ও সাইনবোর্ডের ভিড়ে মামস্ ইনস্টিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড ওমেন্স হেলথ নামটি খুব একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু বাংলাদেশে স্ত্রীরোগের বিশেষায়িত চিকিৎসার খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা এর নাম–ঠিকানা জানেন।
মহৎ এই উদ্যোগ কীভাবে শুরু হলো, তা জানতে কথা হয় অধ্যাপক সায়েবা আখ্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলে স্ত্রীরোগ বিভাগে কাজের সময় আমি সিদ্ধান্ত নিই, সরকারি চাকরি ছাড়ার পর সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত নারীদের চিকিৎসায় কিছু করব।’ ২০০৬ সালে ঢাকা মেডিকেল থেকে অবসর নেওয়ার কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) স্ত্রীরোগ বিভাগে যোগ দেন। তিন বছর চাকরি করার পর ২০০৯ সালে বিএসএমএমইউ থেকে অবসর নেন। পরের বছর ২০১০ সালে মামস্ ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরু।
হাসপাতাল গড়তে অনেক টাকার প্রয়োজন। শুরুতে অধ্যাপক সায়েবা আখ্তার নিজের পেনশনের পুরো টাকা হাসপাতাল গড়ে তোলার কাজে লাগান। এ উদ্যোগে চিকিৎসক স্বামী ও ভাইদের কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছেন। অধ্যাপক সায়েবা আখ্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাকাত ফান্ড আছে। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব যে জাকাত দেন, তাতে হাসপাতালের তিন–চার মাসের খরচ চলে যায়। এ ছাড়া সমাজের নানা ধরনের ব্যক্তি কিছু কিছু অর্থসহায়তা দেন।’
আইএলডিসি নামের একটি প্রতিষ্ঠান গত বছর ২৫ জন রোগীর সব খরচ বহন করেছিল। প্রতিষ্ঠানটি এ বছরও ৫০ জন রোগীর যাবতীয় খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রয়াত বিচারপতি আমিরুল ইমলাম অপারেশন থিয়েটারের জন্য একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ওটি লাইট কিনে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি নিয়মিত আর্থিক সহায়তা করতেন। একটি সিরামিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হাসপাতালের মেঝেতে টাইলস লাগিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন সময় রোগীদের রক্তের প্রয়োজন হয়, সেই রক্ত সরবরাহ করে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানে যেসব চিকিৎসক প্রশিক্ষণ নিতে আসেন, তাঁদের অনেকেও নানা ধরনের সহায়তা করেন। এমনই একজন চিকিৎসক হাসপাতালের চিকিৎসক–নার্সদের পোশাক দিয়েছিলেন, একজন দিয়েছিলেন স্যান্ডেল। অধ্যাপক সায়েবা আখ্তার বলেন, ‘এভাবে বিন্দু বিন্দু সহায়তায় চলছে এই হাসপাতাল।’ তিনি নিজে দিনের একটি সময় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় ব্যয় করেন। সেখান থেকে উপার্জিত অর্থের কিছুটা প্রয়োজনে এখানেও ব্যয় করেন।
প্রলম্বিত প্রসবজনিত ফিস্টুলা, অস্ত্রোপচারজনিত ফিস্টুলা, প্রল্যাপসসহ ১৩ ধরনের স্ত্রীরোগের অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসা হয় এই হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স এবং কর্মকর্তা–কর্মচারী ২৫ জন। দুজন ছাড়া বাকি চিকিৎসক এখান থেকে কোনো পারিশ্রমিক নেন না। হাসপাতালের প্রধান সার্জন অধ্যাপক সায়েবা আখ্তার নিজে। অবেদনবিদ হিসেবে তাঁকে সহায়তা করেন তাঁর ভাই। চিকিৎসক স্বামীও প্রয়োজনের সময় সহায়তা করেন।