পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি, ধসে পড়লে নড়েচড়ে প্রশাসন
বাংলাদেশ

পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি, ধসে পড়লে নড়েচড়ে প্রশাসন

পাহাড়ি ঢল আর টানা বৃষ্টিতে প্রতি বছর সিলেটে পাহাড় ও টিলা ধসের ঘটনা ঘটে। এবার বন্যার সময়েও জেলার কয়েকটি স্থানে পাহাড় ও টিলা ধসের ঘটনা ঘটেছিল। এরপরও ঝুঁকি নিয়ে টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে বসতি গড়ে বসবাস করছে প্রায় আড়াই শতাধিক পরিবার। এসব পরিবারের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার।

সম্প্রতি সিলেটে বন্যা হলেও পাহাড়ে বসবাসকারীরা বসতি ছেড়ে যাননি। তাদেরকে ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ে বসবাস করতে দেখা গেছে। পাহাড় কিংবা টিলা কেটে মানুষ বসতি গড়লেও পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসন থেকে কোনও ধরনের সতর্কতা কিংবা উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়নি। এবার বন্যার সময়েও প্রশাসনের কোনও তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। এমনকি ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের পুনর্বাসন কিংবা নিরাপদে সরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটলেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আনোয়ার সাদাত বলেন, ‌‘যারা ঝুঁকিপূর্ণভাবে টিলা কিংবা পাহাড়ের নিচে বসতি গড়ে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন তাদের আগে সচেতন হতে হবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সিলেটে মাইকিং ও সচেতনমূলক প্রচারপত্র বিলি করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে আইনগত বিষয়গুলো দেখার জন্য পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

গত ৬ জুন জৈন্তাপুর উপজেলায় টিলা ধসে ঘুমন্ত অবস্থায় এক পরিবারের চার জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ সময় আহত হয়েছেন ছয় জন। ওই দিন ভোর ৫টায় উপজেলার চিতনাগুল ইউনিয়নের পূর্ব সাতজনি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

মৃতরা হলেন—জুবের আহমদ (৩৫), তার স্ত্রী সুমি বেগম (৩০), তাদের পাঁচ বছরের ছেলে সাফি আহমদ এবং ওই পরিবারের সদস্য মাওলানা রফিক আহমদের স্ত্রী সামিরা বেগম (৫৮)।

ওই দিন দুপুরে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট ইমরুল হাসান ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার এবং আহতদের পাঁচ হাজার করে এক লাখ ২০ হাজার টাকা জরুরি সহায়তা পৌঁছে দেন তিনি।

একই দিন ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ঘিলাছড়া ইউনিয়নে টিলা ধসে ছয়টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এ ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। বিষয়টি নিশ্চিত করেন ঘিলাছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লেইস চৌধুরী।

তিনি বলেন, ‘টিলা ধসে ইউনিয়নের উত্তর আশিঘর ও ইসপুরের ছয়টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।’

টিলায় বসবাসকারীরা জানিয়েছেন, কম টাকায় জায়গা কিনে তারা ঘরবাড়ি করেছেন। টিলার নিচে বসবাস ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও সেখানে আছেন বছরের পর বছর। কারণ তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। তবে সরকার যদি স্থায়ীভাবে অন্যত্র বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে তারা সেখানে চলে যাবেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট সদর উপজেলার আখালিয়া, ব্রহ্মণশাসন, দুসকি, টিলারগাঁও, খাদিমনগর, খাদিমপাড়া, বালুচর, টুকেরবাজার, পাঠানটুলা গুয়াবাড়ি জাহাঙ্গীরনগর, জৈন্তাপুর, ফেঞ্চুগঞ্জ, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, আখালিয়া বড়গুল এলাকার মুক্তিযোদ্ধা টিলাসহ পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে ঘর বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে কয়েকশ পরিবার। এর মধ্যে কেউ ঘর ভাড়া নিয়েছে, আবার কেউ নামমাত্র টাকা দিয়ে দখলদারদের কাছ থেকে জায়গা কিনেছে। তাদের মধ্যে নিম্নআয়ের লোকজনই বেশি।

আখালিয়া বড়গুল এলাকার মুক্তিযোদ্ধা টিলায় বসবাসকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. পাশা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এই টিলায় আমরা অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা বসবাস করে আসছি। অনেক কষ্ট করে ঘরবাড়ি বানিয়ে পরিবার নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে থাকছি। আমাদের যাওয়ার কোনও জায়গা নেই।’

জৈন্তাপুর উপজেলার বাসিন্দা সাব্বির আহমদ বলেন, ‘পাহাড় কিংবা টিলার নিচের জায়গাগুলোর দাম কম। সে জন্য মানুষ ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। প্রশাসন সতর্ক থাকলে কেউ এমন সাহস দেখাতো না। প্রতি বছর বৃষ্টি হলেই পাহাড় ও টিলা ধসের আতঙ্ক দেখা দেয়। তখন নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আখতার বলেন, ‘টিলা আর পাহাড় দখলদাররা ধ্বংস করে ফেলেছে পরিবেশ। যার জন্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিবেশ ও প্রকৃতি। টিলা ও পাহাড়ের যথাযথ হিসাব কারও কাছে নেই। এগুলোর সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। এসবের খবর রাখা যাদের দায়িত্ব, তারাই দায় এড়িয়ে যায়। মানুষকে নিরাপদে রাখার জন্য ‘বেলা’ এর আগে আদালতে একটি রিট করেছিল। সিলেটের ছয় উপজেলাসহ সিটি করপোরেশন এলাকায় ২০১১ সালের একটি রিটে এক হাজার ২৫টি টিলা ছিল বলে উল্লেখ করা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘রিটের পর দেখা যায়, সিলেটের অধিকাংশ জায়গায় টিলা নেই। বর্তমানে সিলেটে কতটি টিলা আছে, তা ডাটা করে রাখার দাবি জানাই। অন্যথায় কয়েকদিন পর সিলেটে কয়টি টিলা ছিল আর কয়টি নেই, সে হিসাব মিলবে না। টিলাকে সাধারণত বলা হয় মাটির পেরেক। ক্ষতির প্রভাব ফেলার আগেই মাটির অবস্থান বোঝার জন্য ধ্বংস হওয়া টিলাগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা খুবই জরুরি।’

সিলেট পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক ইমরান হোসেন বলেন, ‘টিলা কিংবা পাহাড় কাটার অপরাধে পরিবেশ অধিদফতর সবসময় অভিযান অব্যাহত রাখার পাশাপাশি জরিমানা ও মামলা করে যাচ্ছে। এমনকি তথ্য অফিসের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ টিলা কিংবা পাহাড়ের নিচে যাতে কেউ বসবাস না করে, সে কাজও চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। পরিবেশ অধিদফতরের যতটুকু সক্ষমতা রয়েছে; সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে।’

এদিকে, ঝুঁকি জেনেও বাধ্য হয়ে টিলার পাদদেশে ঘর বানিয়ে বসবাস করেন বলে জানালেন দরিদ্র শ্রেণির মানুষজন। তাদের ভাষ্য, আমরা গরিব মানুষ। কোথায় যাবো? জানি বেশি বৃষ্টি কিংবা ভূমিকম্পে টিলা ধসের আশঙ্কা আছে। কিন্তু আমাদের তো যাওয়ার জায়গা নেই। এজন্য মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছি।

সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই আল হাদী জানান, তারা জরিপ করে দেখেছেন সিলেট বিভাগে টিলার পাদদেশে প্রায় ১০ হাজার লোক ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। পরিবেশ অধিদফতর ও প্রশাসনকে আরও বেশি কঠোর হতে হবে। সেইসঙ্গে যারা ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন, তাদেরও সচেতন হতে হবে। না হলে প্রাণহানির শঙ্কা থাকবে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের টিলার পাশের একটি দেয়াল ধসে এক পরিবারের তিন জন, জৈন্তাপুরে পাহাড় ধসে দুই শিশু, ২০০২ সালে শাহী ঈদগাহ এলাকায় চার জন, গোলাপগঞ্জে ২০০৫ সালে টিলা ধসে এক পরিবারের তিন জন, ২০০৯ সালে জেরিন চা বাগানে পাহাড় ধসে তিন জন, একই বছরের ১০ অক্টোবর গোলাপগঞ্জের কানিশাইলে মাটি চাপায় এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এছাড়া ২০১৭ সালের ১০ জুন নগরীর হাওলাদার পাড়ায় টিলা ধসে তিন জন আহত হন। এরপরও কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্টরা।

Source link

Related posts

প্রাণসহ ৬৬ প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রফতানি ট্রফি’

News Desk

আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচলে নিষেধাজ্ঞার সময় বাড়ল

News Desk

ফেরিঘাটে ভিড় সংক্রমণের হার আবারও বাড়িয়ে দিতে পারে

News Desk

Leave a Comment