গুলিস্তানে গণপরিবহনে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য সিটি করপোরেশন ও বাস মালিকদের কথার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই চাঁদাবাজির সুযোগ নেয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিকার
এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। চোখ ধাঁধাঁনো ফ্লাইওভার রাজধানী ঢাকার যোগাযোগে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এমন প্রচারণার মধ্যে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি না পিছিয়ে পড়ছি রাজধানী ঢাকার রাস্তায় নামলে বোঝা যায়। ১০ বছর আগে মতিঝিল থেকে গুলশান যেতে সময় লাগতো সর্বোচ্চ ৪০ মিনিট। এখন দেড় ঘণ্টার কম সময়ে পৌঁছা যায় না। গুলিস্তান থেকে এয়ারপোর্ট যেতে সময় লাগতো এক ঘণ্টা। এখন দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। রাজধানীর যান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকটি ফ্লাইওভার। অথচ গুলিস্তান টু যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারে নিত্য যানজট। আবার টোল পরিশোধ করে নেমেই পড়তে হয় মহাগ্যাঞ্জামে। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে গুলিস্তানে নেমে যানজটে পড়তেই হয়। পরিবহণ শ্রমিক, মালিক, স্থানীয় নেতাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর নিয়মিত চাঁদাবাজির জন্য ফ্লাইওভারের মুখে যানজট হয়। ফ্লাইওভারের মুখেই গাড়ি পার্কিং। বিভিন্ন রুটের গাড়ি গুলিস্তান ফ্লাইওভারের সম্মুখভাগে রাস্তা বন্ধ করে সারিবদ্ধভাবে রেখে দেয়া হয়। এ যেন রাস্তার ওপর বাস টার্মিনাল। সময় বাঁচানোর জন্য বা দ্রুত কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য ফ্লাইওভারে টোল দিয়ে যেতে চাইলেও যানজটে পড়তেই হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, বাস টার্মিনাল ও সড়কগুলোতে যাত্রীবাহী বাস দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না। যারা টার্মিনালের বাইরের রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে রাখে এবং যাত্রী উঠানামা করায় তাদের বলা হয়েছে যেন এটা না করে।
রাজধানী ঢাকাকে বিশ্বের অন্যতম বসবাসের অযোগ্য শহর বলা হলেও দেশের নীতি নির্ধারক ও দায়িত্ববান ব্যক্তিদের এ ব্যাপারে কোনো দায়িত্বশীল ভূমিকা নেই। বরং তারা এটা ভেবেই খুশি যে, বসবাসের অযোগ্য নগরের তারা যোগ্য নাগরিক। যে কয়টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ঢাকা শহরকে বসবাসের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে তারমধ্যে অন্যতম একটি বিষয় অপরিকল্পিত যোগাযোগ ব্যবস্থা।
সকালে কর্মস্থলে যেতে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা যানজটে আটকা পড়তে হবে এটা যেন স্বাভাবিক ব্যাপার আর এর ব্যতিক্রমটা অস্বাভাবিক মনে হয় নগরবাসীর কাছে। যানজটের প্রধান যে কারণগুলোকে বিশেষজ্ঞগণ চিহ্নিত করেছেন তার মধ্যে অপরিকল্পিত গাড়ি পার্কিং বা যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা। যার ফলশ্রুতিতে নগরীর অপ্রতুল সড়ক ব্যবস্থা আরো সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ছে। রাস্তাগুলো হারাচ্ছে তার প্রস্থতা।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর তিনটি বাস টার্মিনাল (মহাখালী, গাবতলী ও সায়েদাবাদ) সংলগ্ন এলাকায় যানজটের মূল উৎস এই টার্মিনাল। প্রতিটি টার্মিনালে রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়। এছাড়া ফ্লাইওভারের নিচে যাত্রী উঠানো-নামানো ও অন্য বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ওপরের দিকেও সৃষ্টি হয় যানজট। বিশেষ করে টার্মিনালগুলোর অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ার মতো। দিনভর বাইরেই পার্কিং করা থাকছে গাড়িগুলো। টার্মিনালের ভেতরটা ফাঁকা থাকলেও বাসগুলো থাকে টার্মিনাল সংলগ্ন রাস্তায়। রাস্তার দুই পাশে রাত-দিন থাকে বাসগুলোর দীর্ঘ লাইন।
বিশেষজ্ঞ ও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অদক্ষ চালক, সড়ক ও ফুটপাথ দখল হয়ে যাওয়া, নির্দিষ্ট স্থানে বাসস্ট্যান্ড না থাকাসহ অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা কেটে নির্মাণকাজ করার ফলে নগরীতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।
জানা গেছে, মহাখালী বাস টার্মিনালটিতে আড়াইশ’র মতো বাস রাখা যায়। কিন্তু মালিক সমিতির দাবি ২০ রুটে প্রায় এক হাজার বাস চলাচল করছে। ধারণক্ষমতা না থাকায় টার্মিনালের সামনে শহীদ তাজউদ্দিন সড়ক ও আশপাশের রাস্তায় পার্কিং করা হচ্ছে শত শত বাস। এতে রাস্তার দুই পাশে সড়কের একাংশ দখল হয়ে যাচ্ছে। যানবাহনের দীর্ঘলাইনের পাশাপাশি চরম দুর্ভোগে পড়ছে এ সড়কে চলাচলকারী পথচারী ও যাত্রীরা। দেখা যায়, টার্মিনালের বাইরেও অবাধে ওঠানামা করছেন দূরপাল্লার যাত্রীরা। অন্যদিকে টার্মিনালে প্রবেশমুখী বাসের সংখ্যা অধিক থাকায় একাধিক লাইনের মাধ্যমে প্রবেশ করে বাসচালকরা।
একাধিক বাসচালক জানান, টার্মিনালে প্রবেশের জন্য দীর্ঘলাইন ধরে থাকতে হয়। দুইশ’ থেকে তিনশ’ কিলোমিটার জার্নি করে কোনো চালকই টার্মিনালে প্রবেশের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে চায় না। আবার টার্মিনালে প্রবেশের আগে দুটি অয়েল পাম্প রয়েছে।
মহাখালী বাস টার্মিনালের ইজারাদার গাজী মেজবাউল হক মেজবাউল হোসেন সাচ্চু বলেন, বাস মালিক সংগঠনের নেতারা এসময় কোনো সহযোগিতা করছেন না। এ বিষয়ে আমি মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন, সিটি করপোরেশন, পুলিশ সবাইকে জানিয়েছি। তবে আমি এ ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। শুধু মহাখালী বাস টার্মিনালই নয় সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ও গাবতলী বাস টার্মিনালের চিত্রও একই।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, একটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা ইজারা দিয়েছি। আসলে মহাখালীতে জায়গা নেই। আমরা এখন বাস্তবধর্মী কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। বাস টার্মিনালের পেছনে কিছু জায়গা করে দিয়ে তাদের বাসগুলোর রাখার একটা ব্যবস্থা করে দেব। এটা হয়ে গেলে বাইরে গাড়ি থাকবে না। বাংলাদেশের কমন একটা চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, যেখানে পারে গাড়ি পার্কিং করে রাখে। ঢাকা উত্তর সিটির পক্ষ থেকে আমরা মোবাইল কোর্ট ও বিভিন্ন আয়োজনের চেষ্টা করছি। তবে আমরা এ ব্যাপারে সক্রিয় আছি। মোবাইল কোর্ট সক্রিয় আছে।
এদিকে, যানজট এড়িয়ে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছাতে নির্মাণ করা হয় যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। কিন্তু এই ফ্লাইওভার নির্মাণের পর জনগণের ভোগান্তি কমার কথা থাকলেও কমেনি কোনো অংশেই। বরং দিন দিন বাড়ছে জনদুর্ভোগ। ভোগান্তিতে পড়ছেন গণপরিবহন যাত্রীরা। ১১ কিলোমিটারের এ ফ্লাইওভারের এই যানজটের কারণে গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় রাজধানীর সব এলাকায়। নিচে ফ্লাইওভারের বিশাল বিশাল পিলারের কারণে সরু রাস্তায় চলতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। অপরদিকে ওপরে টোল আদায়ের জন্য সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।
ফ্লাইওভারে এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে যেতে ৫ মিনিটের পথ মাঝে মাঝে সময় লাগে ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা। তবে সকাল বেলা অফিস সময়ে এবং বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় অবর্ণনীয় কষ্ট সইতে হয় রাজধানীবাসীকে। কোনো কোনো সময় বিকেলের যানজট শেষ হয় মধ্যরাতে।
গতকাল রোববার মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় বলাকা, জোনাকী পরিবহনের বেশ কয়েকটি বাস রাস্তা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়াও কয়েকটি বাসের যাত্রী উঠানামা করানোর জন্য রাস্তায়ই দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। সিলেট, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এলাকার বেশকিছু বাস দাঁড় করিয়ে ইচ্ছেমতো যাত্রী উঠাচ্ছে। এতেকরে অন্য বাস চলতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের।
মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের গুলিস্তান এলাকায় সড়কে অবৈধ গাড়ি পার্কিং, সড়ক ও ফুটপাথ দখল করে হকারদের দোকান, গুলিস্তান মতিউর পার্কের দক্ষিণ পাশের ফুটপাথ দখল করে বাসের কাউন্টার স্থাপন, এই অংশে ফ্লাইওভারে উঠার রাস্তায় লোকাল বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী নেয়া, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা, যেখানে-সেখানে গাড়ি ঘুরানো, সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট মোড়ে ট্রাফিক সিগনাল না মানার কারণে লেগেই আছে যানজট।
মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে নির্বিঘ্নে যানবাহন চলাচলের কথা থাকলেও মাঝে মাঝে দেখা দেয় দীর্ঘ যানজট। টোল আদায়েও দেখা যায় বেশি সময় নেয়া হয়। সেকারণেও ফ্লাইওভারের ওপরে লেগে যায় বাস, ট্রাক ও অন্যান্য পরিবহনের দীর্ঘ লাইন।
মজিবুর নামের এক যাত্রী জানান, যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করি। মাঝে মাঝে এমন যানজট সৃষ্টি হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায় বাসে বসে থেকে। শনিরআখড়া থেকে গুলিস্তান আসার পথে ফ্লাইওভারের মাথায় দাঁড়িয়ে বাসগুলো যাত্রী উঠায়। এই রুটের ফ্লাইওভারের বাইরের রাস্তা ভাঙা থাকার কারণে থেমে থেমে চলতে হয় যাত্রী পরিবহন। তাই এখানে যানজটের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ফ্লাইওভারের যানজটের কারণে প্রতিদিন আধঘণ্টা দেরি হয়।
গতকাল বিকালে বিষয়টি জানতে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হয়। এ সময় তিনি ইনকিলাবকে বলেন, এ ব্যাপারে আজ কথা বলতে পারব না। বিষয়টি নিয়ে পরে কথা বলব।
তথ্য সূত্র : daily-inqilab