ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে বরগুনায় অন্তত ১৬ হাজার ৪০৮টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত তিন হাজার ৩৭৪টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং ১৩ হাজার ৩৪টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি জলোচ্ছ্বাসে বন্যাদুর্গত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুই লাখ ৩১ হাজার ৭০০ মানুষ। সোমবার (২৭ মে) সন্ধ্যা ৭টার দিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রিমালের আঘাতের পর জেলার প্রধান তিন নদ-নদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ ফুট উচ্চতার জোয়ার প্রবাহিত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে পায়রা ও বিষখালী নদী তীরবর্তী উপকূলীয় এলাকার অন্তত ৩০০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ১২ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছয় হাজার হেক্টর কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডুবে গেছে চার ১৫৭ হেক্টর মাছের ঘের ও উন্মুক্ত জলাশয়। পানিবন্দি আছে কয়েক হাজার মানুষ। দুর্ভোগে পড়েছে তারা। এছাড়া জেলার দুটি ফেরিঘাট ডুবে গেছে। তবে কারও মৃত্যু হয়নি। গাছপালা ভেঙে ও ঘরবাড়িতে চাপা পড়ে ৩৭ জন আহত হয়েছেন। কেউ নিখোঁজ হয়নি। সোমবার রাত ১০টা পর্যন্ত শহর এবং উপকূলীয় এলাকায় দমকা হাওয়াসহ মাঝারি ও ভারী বৃষ্টি অব্যাহত আছে।
পায়রা ও বিষখালী নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রবিবার সন্ধ্যার পর থেকে ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি বাড়তে থাকে। স্বাভাবিক জোয়ারের তুলনায় পানি বেড়ে যায়। রাতে নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়িতে পানি ঢুকতে শুরু করে। সকালে প্লাবিত হয় সড়ক ও মাছের ঘের। ডুবে যায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
জেলা প্রশাসন জানায়, রিমালের তাণ্ডবে পায়রা ও বিষখালী নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোর ওপর দিয়ে ৯ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস বয়ে গেছে। প্লাবিত হয়েছে ৩০০টি গ্রাম। বিভিন্ন উপজেলায় তিন হাজারের বেশি গাছপালা উপড়ে পড়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে ১৬ হাজার ৪০৮টি বাড়িঘর। বন্যাদুর্গত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুই লাখ ৩১ হাজার ৭০০ মানুষ। অধিকাংশ উপজেলা বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। গাছপালা পড়ে ৩৭ জন আহত হলেও নিহতের খবর পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে অধিংকাংশ স্থানে খুঁটি ও গাছপালা ভেঙে পড়ায় পুরো জেলায় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। ফলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ করতে হচ্ছে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, জেলায় এখন পর্যন্ত ১৬ হাজার ৪০৮টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কমবেশি দুই লাখ ৩১ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তথ্য সংগ্রহের কাজ এখনও চলমান আছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। আমরা এখনও উপকূলীয় এলাকাগুলোর তথ্য সংগ্রহ করছি।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বরগুনা কার্যালয়ের কর্মকর্তা মোহাম্মদ রাকিব বলেন, ‘বরগুনা সদরের ডালভাঙ্গা, লতাবাড়িয়া, মোল্লারহোরা, মাঝখালী, আয়লা, পাতাকাটা, আমতলী উপজেলা, আরপাঙ্গাশিয়া, তেঁতুলবাড়িয়া এবং পাথরঘাটার কাকচিড়া, রুহিতা, জিনতলা, চরলাঠীমারা, কাঁঠালতলী, চরদুয়ানি পদ্মা এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে এসব এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ দ্রুত মেরামত করা হবে।’
নদীতে ৯ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছিল উল্লেখ করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বরগুনা কার্যালয়ের পানি পরিমাপক খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘রবিবার রাতে সর্বোচ্চ ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছিল। পরে নদীতে ভাটা শুরু হলে পানি নেমে যায়। এখনও বেশিরভাগ এলাকার মানুষজন পানিবন্দি আছেন।’
উপকূলের বাসিন্দাদের রবিবার রাত নির্ঘুম কেটেছে জানিয়ে সদর উপজেলার ৭ নম্বর ঢলুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা শাহিন মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সারারাত রাস্তা ও বাঁধ রক্ষার চেষ্টা চালিয়েছি। তারপরও শেষ রক্ষা হলো না। বাঁধ ও রাস্তা ভেঙে বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। হাবুডুবু খাওয়ার মতো অবস্থায় আছি।’
বরগুনার ২ নম্বর গৌরীচন্ন এলাকার বাসিন্দা রিপন মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এত পানি সিডরের সময়েও দেখিনি। এমন ভয়াবহ অবস্থা তখন দেখা যায়নি। আমার বাড়ি শহরের পাশেই। ঘরে পানি ঢুকে সব নষ্ট হয়ে গেছে। এখনও পানির স্রোত বইছে। উপকূলের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেখানের ঘরবাড়ি সব ডুবে গেছে।’
বরগুনা সদর থানার ওসি একেএম মিজানুর রহমান বলেন, ‘থানার ভেতরে হাঁটুসমান পানি। শহরের রাস্তাঘাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে। বিভিন্ন এলাকায় গাছ উপড়ে পড়েছে। মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’