বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কালমেঘা ইউনিয়নের ছোট পাথরঘাটা গ্রামের সেলিম খানের দোতলা বসতঘরের সামনে একটি গোয়ালঘর। ঘরটি নির্মাণ করা হয়েছিল রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ট্যাংকের অর্থাৎ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য। সাত বছর আগে তৈরি করা ঘরটি এখন গোয়ালঘর। সেখানে গরু লালন-পালন করছে সেলিম খানের পরিবার। এই বাড়ির একটু দূরেই মো. বেলালের বসতঘর। তার বাড়িতেও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছিল রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ট্যাংক। এখন সেটি হাঁস-মুরগির খামার।
গোটা উপজেলার যেসব বাড়িতে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ট্যাংক বসানো হয়েছিল তার প্রায় সবগুলোর চিত্র একই। বেশিরভাগ স্থানে ট্যাংক-ঘরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বিশুদ্ধ পানির প্রকল্পে গোয়ালঘর কেন জানতে চাইলে সেলিম খান জানান, ঘরটি নির্মাণের দুই বছরের মধ্যে ভেঙে গিয়েছিল। এরপর থেকে পানি সংরক্ষণ করা যায়নি। পরে মেরামত করে গরু লালন-পালন করছেন তিনি।
একই কথা জানিয়েছেন আবদুল খালেক গাজী। তিনি বলেন, ‘রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ট্যাংক-ঘরটি কোনও রকমে বানিয়েছিলেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। নির্মাণের বছর খানেকের মধ্যে ভেঙে যায় ঘরের পিলার। তারপর থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যায়নি। এরপর ঘরটি জোড়াতালি দিয়ে হাঁস-মুরগি পালন করছি।’
উপজেলার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও প্রাকৃতিক কারণে জেলার উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট দীর্ঘদিনের। খাওয়ার পানি আনতে গ্রাম থেকে দূরে গিয়ে প্রতিদিন দুবারে চার-পাঁচ ঘণ্টা ব্যয় করতে হয় নারীদের। সংকট নিরসনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ইন্টিগ্রেটেড এগ্রিকালচারাল প্রোডাকটিভিটি প্রকল্পের অধীনে উপকূলীয় অঞ্চলে নির্মাণ করা হয়েছিল ঘরের ট্যাংকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের পদ্ধতি; যা রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং নামে পরিচিত। প্রকল্প শেষ হওয়ার সাত বছরের মধ্যে সুপেয় পানির সংকট দূরীকরণের জায়গায় প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের ঘরগুলো পরিণত হয়েছে গোয়ালঘর, হাঁস-মুরগির খামার আর রান্নাঘরে। ফলে আবারও খাওয়ার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রীষ্মের দাবদাহ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সংকট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৪ সালে বরগুনায় সুপেয় পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের পদ্ধতি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্রকল্প হাতে নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। যা মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। প্রকল্পের অধীনে ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে চার কোটি টাকা ব্যয়ে ৩২৬টি ওয়াটার হার্ভেস্টিং ট্যাংক স্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু শেষের দিকে এসে অনেকগুলো ট্যাংক বসানো হয়নি।
প্রকল্পের বরাদ্দ অনুযায়ী, ঘরের দৈর্ঘ্য ২০ ফুট ৬ ইঞ্চি ও প্রস্থ ১৫ ফুট ৬ ইঞ্চি হওয়ার কথা থাকলে বাস্তবে হয়েছে দৈর্ঘ্য ১৮ ফুট ৬ ইঞ্চি ও প্রস্থ ১৩ ফুট ৬ ইঞ্চি। পিলার তৈরিতে যে ইট ও রড ব্যবহার করা হয়েছে, তা নিম্নমানের ছিল। ফলে কয়েক মাসের মধ্যে পিলারে ফাটল ধরে যায়। পিলার বসানোর পর সিমেন্ট দিয়ে ফাটল ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। এভাবে এক মৌসুম চলার পর পরের মৌসুম পর্যন্ত টেকেনি অধিকাংশ ঘর।
সুবিধাভোগীদের অভিযোগ, প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কে কে এন্টারপ্রাইজ ও ব্রাদার্স ট্রেডিং নামমাত্র ট্যাংকের ঘরগুলোর কাজ করে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি টাকা। আবার এসব ট্যাংক যাদের বাড়িতে বসানো হয়েছিল, তাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কাজ করেছিল নিম্নমানের।
পাথরঘাটার খাদিজা আক্তার, খুশি বেগম, মিনোয়ারা বেগম ও মরিয়মসহ একাধিক সুবিধাভোগী জানিয়েছেন, নিম্নমানের ইট-সিমেন্ট দিয়ে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ট্যাংক স্থাপনের ঘরগুলো তৈরি করা হয়েছিল। সরকারি তালিকায় নাম না থাকলেও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে আঁতাত করে ইচ্ছেমতো সুবিধাভোগী নির্বাচন করেছিলেন। যারা ট্যাংক পেয়েছেন তাদের প্রতিজনকে ১০-২০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। আবার তালিকায় নাম থাকলেও যারা টাকা দিতে পারেননি তাদের ট্যাংক চলে গেছে প্রভাবশালীদের ঘরে। যাদের বাড়িতে টিউবওয়েল অথবা পুকুর আছে তাদের ট্যাংক দেওয়া যাবে না, প্রকল্পে উল্লেখ থাকলেও এমন একাধিক বাড়িতে দেওয়া হয়েছিল ট্যাংক। ফলে সুপেয় পানির জন্য ট্যাংক দেওয়া হলেও তার বেশিরভাগই ব্যবহার হয়েছে অর্থশালীদের বিভিন্ন কাজে। এর মধ্যে ছোট পাথরঘাটা গ্রামের আবদুল খালেক গাজীর বাড়িতে বসানো ট্যাংকটি ঘরের ছাদে নিজস্ব কাজে ব্যবহার করছেন।
পাথরঘাটা উপজেলার বাসিন্দা জয়নাল হোসেন বলেন, ‘উপজেলার অধিকাংশ জায়গায় গভীর নলকূপ বসানো যায় না। যেসব স্থানে নলকূপ বসানো যায়, সেখান থেকে ওঠে লবণাক্ত পানি। দীর্ঘদিন ধরে এই অবস্থায় কখনও পুকুরের পানি ফুটিয়ে কখনও বৃষ্টির পানির সংরক্ষণ করে খাবারের পানির চাহিদা মিটিয়ে আসছি আমরা।। অথচ সুপেয় পানির জন্য সরকার উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের খামখেয়ালিপনার জন্য এখন কোনও কাজে আসছে না। ফলে উপজেলাজুড়ে খাওয়ার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রীষ্মের দাবদাহ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সংকট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা আমাদের।’
একই উপজেলার বাসিন্দা জসিম খান বলেন, ‘রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ট্যাংক বসানোর সময় কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের তৎকালীন বরগুনার সহকারী প্রকৌশলী জগন্নাথ বিশ্বাসের যোগসাজশে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ১০-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়েছিল। এই টাকা ভাগ–বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন মাঠপর্যায়ের সিএফ থেকে শুরু করে বিএডিসির নির্বাহী প্রকৌশলীরা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিন্মমানের কাজ করলেও টাকার জন্য সবকিছু ধামাচাপা দিয়েছিলেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ফলে পানির সংকট দূর হয়নি।’
দূরে থেকে খাওয়ার পানি আনতে গিয়ে প্রতিদিন দুবারে চার-পাঁচ ঘণ্টা ব্যয় করতে হয় জানিয়ে ছোট পাথরঘাটা গ্রামের ছমিরণ বেগম (৬২) বলেন, ‘যখন থেকে বুঝতে শিখছি তখন থেকেই দেখছি পরিবারের নারীরা মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়ে পানি নিয়ে আসছেন। এখনও আমাদের পানির জন্য মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়। গৃহস্থালির কাজ পুকুর ও ডোবা-নালার পানি দিয়ে সারতে পারলেও খাবার পানির জন্য এখনও ছুটতে হয় আমাদের। কত কিছুর পরিবর্তন হলো, কিন্তু আমাদের পানির কষ্ট গেলো না।’
সরকারি তালিকায় নাম না থাকলেও ইচ্ছেমতো সুবিধাভোগী নির্বাচনের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান উপজেলার কালমেঘা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদ আকন। তিনি বলেন, ‘আমার চেয়ারম্যান কার্যকাল এখন শেষের দিকে। এই কাজ কবে হয়েছিল, তা আমার মনে নেই।’
তবে ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম নাছির বলেন, ‘পাথরঘাটা উপজেলায় যেসব রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ট্যাংক দেওয়া হয়েছিল তার সবগুলো এখন অন্য কাজে ব্যবহার হয়। আমি ইউনিয়নের নতুন চেয়ারম্যান। এই প্রকল্প কীভাবে কারা দিয়েছিল কিছুই জানি না। আমি বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়ে দেখবো।’
প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের বরগুনার তৎকালীন সহকারী প্রকৌশলী জগন্নাথ বিশ্বাস বলেন, ‘অনেক আগের কাজ। কিছুই মনে নেই। আমি এখন পিরোজপুরে কর্মরত আছি। কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত আছি।’ বলে ফোন কেটে দেন। এরপর একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের বরগুনা কার্যালয়ের বর্তমান সহকারী প্রকৌশলী মো. মোছাদ্দেক হোসেন বলেন, ‘প্রকল্পটি যখন শুরু হয়েছিল, তখন যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন। আমি এখানে নতুন এসেছি। আমার কাছে কোনও তথ্য নেই।’
প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নের কাগজপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পের কোনও কাগজপত্র বরগুনা কার্যালয়ে নেই। পটুয়াখালীতে কাগজপত্র থাকতে পারে।’