অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ঈদুল আজহার ধর্মীয় এই উৎসবের আমেজ দেখা গেছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের শরাণার্থী শিবিরগুলোতে। সোমবার (১৭ জুন) সকাল ৮টার দিকে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গা শিবিরে ঈদের নামাজ আদায়ের পর কান্নায় ভেঙে পড়েন ইমাম ও মুসল্লিরা। মোনাজাতে অংশ নেওয়া মুসলিমরা নির্যাতনের বিচার চেয়ে ও নিজ দেশ মিয়ানমারে মর্যাদার সঙ্গে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। এ সময় তাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের প্রতি ধন্যবাদ জানান তারা।
বিভিন্ন শিবিরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সকাল থেকেই সেজেগুজে নতুন জামাকাপড় পরে ক্যাম্পের রাস্তায় হইহুল্লোড় আর আনন্দে মেতে ওঠে রোহিঙ্গা শিশু-কিশোররা। সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল। এদিন বড়রাও নতুন জামা পরে নামাজে অংশ নেন।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ‘এবারসহ বাংলাদেশে ৭টি কোরবানির ঈদ পার করছি। আমরা মিয়ানমারে থাকা অবস্থায় ২-৩টি বড় গরু কোরবানি দিতাম। কিন্তু এখানে আসার পর সেই সুযোগ হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাত বছর হতে চলেছে। তবু আমাদের কোনও কূলকিনারা হচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের ঈদের আনন্দ বলতে কিছু নেই। আমরা খোলা কারাগারে কষ্টের জীবন যাপন করছি। এরপরও আমাদের আশা, অন্তত আগামী বছর নিজ দেশে ঈদ উদযাপন করতে পারবো।’
রোহিঙ্গাদের মতে, কক্সবাজারের ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১ হাজার ৩৮০টি মসজিদ ও ৯৭০টি নুরানি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (মক্তব) রয়েছে। এসব মসজিদ ও নুরানি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আজ ঈদের নামাজ আদায় করেছেন শরণার্থী রোহিঙ্গারা।
টেকনাফের লেদা শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘অন্য বছরের তুলনায় এবার ক্যাম্পে ঈদের আমেজ বেশি দেখা গেছে। তা ছাড়া এবার ৮০টি কোরবানির পশু জবাই হয়েছে। যা অন্য বছরের তুলনায় বেশি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঈদের নামাজ শেষে মোনাজাতে বিশেষ করে মর্যাদার সঙ্গে নিজ ভূমিতে অধিকার নিয়ে যেন ফিরে যেতে পারি সেই প্রার্থনাও করা হয়েছে। এ ছাড়া ফিলিস্তিনি এবং বর্তমান মিয়ানমারের সংঘাতে নিহত মানুষদের জন্যও দোয়া করা হয়েছে।’
বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা নুর কামাল বলেন, ‘আসলে রোহিঙ্গাদের ঈদের আনন্দ কখনও অনুভব হয় না। কেননা, নিজ ভূমিতে আমাদের বাপ-দাদাসহ অনেকে পড়ে আছেন। কিন্তু আজকে সাত বছর হতে চলেছে তাদের কবর জিয়ারত করতে পারছি না। এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে! তবে ক্যাম্পে শিশু-কিশোররা ঈদের খুশি মেতে উঠলেও বড়দের কোনও আনন্দ নেই বললে চলে।’
শরণার্থী জীবনে টাকাপয়সা নেই, চলাফেরার সুযোগ নেই মন্তব্য করে রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আমিন বলেন, ‘আমরা দেশে যেভাবে ঈদ করতাম এখানে সেভাবে ঈদ করতে পারিনি। কেননা, সবকিছুর পরও এটা আমাদের দেশ না। এজন্য আমাদের কোনও আনন্দ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ২০১৭ সালে আগস্টে এ সময়ে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালায় সে দেশের সেনারা। এই মাস আসার পর থেকে যেন মনে হয় কালো দিন এসেছে।’
৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আমির জাফর জানান, ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা ঈদ উদযাপনে মেতে উঠেছেন। তবে কেউ যাতে ক্যাম্পের বাইরে না যায় সেজন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি ক্যাম্পে যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেদিকে নজরদারি রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট কোরবানির ঈদের মাত্র কয়েক দিন আগে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) রাখাইনের ৩০টি নিরাপত্তাচৌকিতে একযোগে হামলা চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নিপীড়নমূলক অভিযান শুরু করে। এর ফলে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। বর্তমানে পুরনোসহ উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন।