মীরসরাইয়ে টানা পাঁচ দিনের বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ৬০ হাজার পরিবার। বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গেছে ১৫ হেক্টর জমির আমনের বীজতলা ও ১০ হেক্টর জমির সবজি। ভারী বর্ষণের ফলে ভেসে গেছে মাছ। নষ্ট হয়েছে গ্রামীণ সড়ক। গত তিন দিন ধরে ৬০ হাজার পরিবার পানিবন্দি থাকলেও এখনও সরকারি ত্রাণ সহায়তা পায়নি পরিবারগুলো।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ দিনের টানা বৃষ্টিতে উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অধিকাংশ গ্রামের বাড়িঘর ডুবে আছে। অনেক জায়গায় আমনের বীজতলা পানিতে ডুবে গেছে। নষ্ট হয়েছে সবজি ক্ষেত। স্রোতে ভেঙে গেছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার গ্রামীণ সড়ক। ভেসে গেছে লক্ষাধিক টাকার মাছ।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে মাছ চাষিদের কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হবে। পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় উপজেলার করেরহাট ইউনিয়ন, হিঙ্গুলী ইউনিয়ন, বারইয়ারহাট পৌরসভা, মীরসরাই পৌরসভা, জোরারগঞ্জ ইউনিয়ন, ওয়াহেদপুর ইউনিয়ন, ইছাখালী ইউনিয়ন, কাটাছরা ইউনিয়ন, দুর্গাপুর ইউনিয়ন, মিঠানালা ইউনিয়ন, খৈয়াছড়া ইউনিয়ন, ওসমানপুর ইউনিয়ন, সরকারতালুক গ্রাম, খিলমুরারী গ্রামে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, বারইয়ারহাট-খাগড়াছড়ি সড়ক, জোরারগঞ্জ-মুহুরী প্রজেক্ট সড়কসহ বিভিন্ন সড়কে। নদী ও খাল দখল হওয়ার কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে এই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
ইছাখালী খালের ভাটি অঞ্চলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে একটি চাইনিজ শিল্প প্রতিষ্ঠান (ওয়াং জিন হং) বাঁধ দেওয়ায় চুনিমিঝিরটেক, নতুন গ্রাম, হাফিজ গ্রাম, জমাদার গ্রাম ও সাহেবদী নগর গ্রামে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। মঙ্গলবার এর প্রতিকার চেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের ফেনাপুনি এলাকার বাসিন্দা শিহাব উদ্দিন শিবলু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাঁচ দিনের বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে আমাদের এলাকায় অনেক জায়গায় পানি উঠেছে। এতে এখানকার সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন। রাস্তায় হাঁটুপানি উঠে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না।’
মাছ চাষিরা জানিয়েছেন, বৃষ্টিতে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন মাছ চাষিরা। বঙ্গোপসাগর উপকূলের সাত হাজারের বেশি মৎস্য ঘেরের পাড় উপচে একজনের প্রকল্পের মাছ চলে যাচ্ছে অন্যজনের প্রকল্পে। সাগর পার্শ্ববর্তী প্রকল্পের মাছ চলে যাচ্ছে সাগরে। এতে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হবে এখানকার চাষিদের।
স্থানীয় মৎস্য চাষি মো. কামরুল হোসেন বলেন, ‘মুহুরী প্রকল্প এলাকায় প্রায় সাত হাজার একর ঘেরে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ হয়। গত কয়েকদিন কয়েকশ একর ঘের পানিতে ডুবে গেছে। নিচু এলাকাগুলোর ঘেরের পাড় ভেঙে মাছ সাগরে ভেসে গেছে। কোনও কোনও চাষি জাল দিয়ে মাছ আটকানোর চেষ্টা করেছেন। এতে লাভের লাভ কিছুই হবে না। কমবেশি সব মাছ চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।’
মৎস্য চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুক্রবার পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। মঙ্গলবার রাত থেকে টানা বৃষ্টিতে অধিকাংশ মাছের ঘের ডুবে গেছে। এতে শত কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়বে এখানকার মাছ চাষিরা।’
স্থানীয় কৃষকরা জানান, গত কয়েকদিনের বৃষ্টির কারণে চাষিরা জমিতে কাজ করতে যেতে পারছেন না। ধারদেনা করে চলছে সংসার। জুলাই মাস থেকে বেচাকেনাও অনেক কমে গেছে। টানা বৃষ্টিতে চারদিকের চাষাবাদের অবস্থা আরও খারাপ।
দুর্ভোগের কথা জানিয়ে ওয়াহেদপুর এলাকার কৃষক আলা উদ্দিন বলেন, ‘আমি ছয় শতক জমিতে আমনের বীজতলা তৈরি করেছিলাম। পাহাড়ি ঢলে সব তলিয়ে গেছে। আবার নতুন করে বীজতলা তৈরি করতে গেলে রোপণের সময় পার হয়ে যাবে। কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
টানা বৃষ্টিতে তরমুজের অনেক ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষি ইকবাল হোসেন বলেন, ‘এখন ফলন বিক্রির উপযুক্ত সময়। কিন্তু বৃষ্টিতে তুলতে সমস্যা হচ্ছে। দামও কমে যাচ্ছে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্র রায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চলতি মৌসুমে টানা বৃষ্টিতে কৃষকের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। প্রায় ১৫ হেক্টর আমনের বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে ১০ হেক্টর জমির সবজি। ৪০০ হেক্টর রোপা আউশ, ২৫০ হেক্টর আমন বীজতলা, দুই হাজার ৫০০ হেক্টর রোপা আমন, ৪৫ হেক্টর সবজি ক্ষেত পানিতে ডুবে আছে। বৃষ্টি না কমলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।’
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা নাসিম আল মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বৃষ্টি বন্ধ হলে চাষিরা বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচবেন। যদি বৃষ্টি বন্ধ না হয়, তাহলে মাছ উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হবে।’
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) উপজেলা প্রকৌশলী রনি সাহা বলেন, ‘ভারী বর্ষণে উপজেলার অনেক গ্রামীণ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃষ্টি বন্ধ হলে ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহফুজা জেরিন বলেন, ‘টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে প্রায় ৬০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ত্রাণ সহায়তার জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করা হয়েছে। বরাদ্ধ আসলে দুর্গতদের মাঝে বিতরণ হবে।’