যশোরের অভয়নগরে এক যুবককে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাতে ওই ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। মঙ্গলবার সারাদিন যশোর ও নওয়াপাড়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ভিডিওটি।
২৪ সেকেন্ডের ওই ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, একটি অফিস কক্ষের ভেতরে টেবিল-চেয়ারের পাশের স্থানে এক যুবককে মেঝেতে ফেলে দুই যুবক তার দুটো পা ধরে রেখেছেন। সাদা ফুলহাতা গেঞ্জি পরা আরেকজন কাঠের তৈরি মোটা লাঠি দিয়ে সজোরে পেটাচ্ছেন। সেখানে লাল হাফ শার্ট পরা এক ব্যক্তিকে উত্তেজিত হয়ে নির্দেশ দিতেও দেখা গেছে। তাকে বলতে শোনা গেছে, ‘এই শক্ত করে ধরো। আর কোনও জায়গায় হবে না, শক্ত করে ধরো। পা যেন ছাড়ে না… হাতে যেন লাগে না। এই দুই জন ধরোদিনি… মারপিট চলাকালে তিনি বলছেন- কষ্ট করে অ্যাডিশনাল এসপি স্যার আসছেন…’। অপরদিকে, নির্যাতনের শিকার যুবক আকুতি-মিনতি করে বলছেন, ‘স্যার- ভুল হয়ে গেছে; আর হবে না।’
লাল শার্ট পরা ব্যক্তিটি হলেন শোয়েব খান। তিনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নওয়াপাড়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুর রহমান লিটুর আত্মীয় ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। আর সাদা শার্ট পরা ব্যক্তি হলেন সোহাগ। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী।
নির্যাতনের শিকার ওই তরুণের নাম ওবায়দুল ইসলাম (২২)। তিনি অভয়নগর উপজেলার কোটা গ্রামের আব্বাস মোল্লার ছেলে এবং নওয়াপাড়া গ্রুপে স্কেলম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গম ‘চুরির অপরাধে’ তিনি নির্যাতনের শিকার হন।
ভুক্তভোগী ওবায়দুল জানান, নওয়াপাড়া গ্রুপের দুই জন মালিক। তাদের একজনের দূর সম্পর্কের শ্যালক শোয়েব খান কারণে-অকারণে তাদের ওপর নির্যাতন চালান। শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি তাদের মানসিক নির্যাতন এমনকি অর্থনৈতিকভাবেও শোষণ করা হয়। যেসব কর্মচারী প্রতিবাদ করেন, তাদের চাকরিচ্যুতির পাশাপাশি বেতন ও পাওনা না মিটিয়ে বের করে দেওয়া হয়।
ওবায়দুলের দাবি, ‘ঘটনাটি ২০২০ সালের ১ মার্চ সন্ধ্যার। তিনি ফরিদপুরে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কথিত একটি চুরির ঘটনাকে পুঁজি করে তাকে সেখান থেকে নওয়াপাড়ায় এনে অফিসের মধ্যে বসিয়ে রাখা হয়। সেখানে রাকিবুল ইসলাম রকি (২৬) ও বায়েজিদ শেখ (২২) নামে আরও দুই কর্মচারী ছিলেন। সন্ধ্যার পর অফিসের ভেতরে স্টাফদের খাওয়ার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১০০টির বেশি কাঠের তৈরি কোদালের লাঠি ছিল। রাকিবুল ইসলাম রকি ও বায়েজিদ শেখকে আমার দুই হাত ও দুই পা ধরতে নির্দেশ দেন শোয়েব খান। তারা ধরলে সোহাগ নিতম্বে মোটা লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করেন। পরে রাকিবুল ইসলাম রকি ও বায়েজিদ শেখকে একইভাবে পর্যায়ক্রমে পেটানো হয়। আমাকেও তাদের হাত-পা ধরতে বাধ্য করা হয়। নির্যাতনের পর ওই কক্ষের মধ্যে ফেলে রাখা হয়। পরদিন ২ মার্চ সকালে ডেকে এনে পুলিশে দেওয়া হয়। এরপর পুলিশ ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় নিয়ে গম চুরির অভিযোগে মামলা দেয়। আড়াই মাস হাজতবাসের পর জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরি।’
মারধরের শিকার হন রাকিবুল ইসলাম রকিও। তিনি বলেন, ‘শোয়েব খান একই অফিসের কর্মী ও তার অনুগত সোহাগ, ইমরান, অনুপ ও ইমদাদের সহায়তায় আমাদের এভাবে অমানবিকভাবে পেটান। ফরিদপুরে গম চুরির কথিত একটি মামলায় আমাদের দায়ী করে সম্পূর্ণ বিনা কারণে এভাবে অমানবিকভাবে পেটানো হয়। ঘটনার পরপরই আমাদের চাকরিচ্যুতিও করা হয়।’
নির্যাতনের শিকার অভয়নগর উপজেলার আমডাঙ্গা গ্রামের মো. আলাউদ্দিনের ছেলে নসিমনচালক মো. আমিন উদ্দিন (২৪) জানান, তিনি নওয়াপাড়া গ্রুপের মালামাল নসিমনে আনা নেওয়া করতেন। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি নসিমনে করে ইট নিয়ে যান। সেখানকার লোকজন ১০ থেকে ১৫টি ইট নেয়। এ ঘটনায় চুরির অভিযোগ এনে তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নওয়াপাড়া গ্রুপের অফিসে আটকে রাখে। রাতে শোয়েব খান কোদালের লাঠি দিয়ে তাকে মারেন।
এ ব্যাপারে জানতে শোয়েব খানের দুইটি মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। এদিকে, নওয়াপাড়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুর রহমান লিটু বর্তমানে দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং বিভাগের প্রধান মিজানুর রহমান জনি বলেন, ‘ঘটনাটি দুই আড়াই বছর আগের। গম চুরির ঘটনায় মালামাল উদ্ধারের জন্য তাকে অফিসের পাশে অতি উৎসাহী কেউ মারধর করে। কিন্তু এখন একটি মহল সেখান থেকে ফায়দা তুলতে পুরনো ভিডিও ভাইরাল করেছে। গেলো রাতে তারা ফোনে আমাদের হুমকিও দিয়েছে। অজ্ঞাত ওই ব্যক্তির বিষয়ে আজ মঙ্গলবার দুপুরে আমরা অভয়নগর থানায় একটি জিডি করেছি।’
যশোর জেলা পুলিশের মুখপাত্র ইন্সপেক্টর রূপন কুমার সরকার বলেন, ‘যুবককে নির্যাতনের ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি ডাউনলোড করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে ডিবির এক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্তের পর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’