যে মেলায় জীবনসঙ্গী খোঁজেন তরুণ-তরুণীরা
বাংলাদেশ

যে মেলায় জীবনসঙ্গী খোঁজেন তরুণ-তরুণীরা

কপালে টিপ, ঠোঁটে লিপস্টিক, চুলের বেণিতে ফুলের মালা। নানা অলংকারে সেজে মেলায় এসেছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তরুণীরা। সাজগোজ করে এসেছেন তরুণরাও। বন্ধুবান্ধব মিলে মাঠজুড়ে খুঁজে ফিরছেন নিজেদের জীবনসঙ্গীকে।

এমন চিত্র দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ বাজারে ‘জীবনসঙ্গী মেলায়’। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীদের জীবনসঙ্গী খোঁজার এই মেলা হয়ে আসছে প্রায় ২০০ বছর ধরে। মেলায় আগত তরুণ-তরুণীদের পছন্দ হলে তারা পরিবারকে নিজেদের পছন্দের কথা জানান। এরপর পরিবারের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তাদের বিয়ে দেন। তবে আয়োজকরা জানিয়েছেন, এই মেলা একসময়ে ‘বউ মেলা’ নামে পরিচিত ছিল।

এ উপলক্ষ্যে গোলাপগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের মাঠে বসে এক বিশাল মেলা। যেখানে বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় নানা দ্রব্য নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। শুধু কী তাই, শিশুদের জন্য রয়েছে খেলনাসামগ্রী এবং খাবারের দোকান।

এদিন সকাল থেকে বিদ্যালয়ে দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারীসহ আশপাশের জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন আসতে শুরু করেন। দুপুরের পর থেকেই জমজমাট হয়ে ওঠে পুরো মাঠ, সমাগম হয় হাজারো মানুষের। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী এই মেলায় কয়েক হাজার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জড়ো হন।

আয়োজকরা জানান, প্রতিবছর দুর্গাপূজার দশমীর পরদিন কোনও ধরনের প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই হাজার হাজার মানুষ মেলায় উপস্থিত হন। মেলায় আশপাশের জেলার বিভিন্ন গ্রামের বউ, শাশুড়ি, ননদ, জা ও ঝিরা একত্রিত হন। মেলা থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তরুণ-তরুণীরা জীবনসঙ্গী বেছে নেন। পরে পরিবারিকভাবে দুই পরিবারের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে তাদের বিয়ে হয়।

বীরগঞ্জের গোলাপগঞ্জে উপজেলা আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির আয়োজনে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের এই মিলনমেলাটির আয়োজন হয়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই মেলায় এসে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তরুণ-তরুণীরা তাদের পছন্দের মানুষকে খুঁজে হাত ধরে টেনে বাড়িতে নিয়ে যেতেন। এরপর বাড়িতে ওই তরুণ-তরুণীর বিয়ে হতো। তবে এখন বিষয়টি ইভটিজিংয়ের পর্যায়ে পড়ে। তাই সেই পুরনো প্রথা ভেঙে এখন নিয়ম করা হয়েছে, পছন্দ হলে দুই পরিবারের সদস্যদের জানাতে হবে। এরপর দুই পরিবারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন করা হয়। যারা এই মেলায় নিজেরা জীবনসঙ্গী পছন্দ করতো, পরবর্তী বছর মেলায় তাদের নাম-পরিচয় তুলে ধরা হতো। এখনও এই মেলায় অনেকে পরিবারের সম্মতিতে পাত্র-পাত্রীকে নিয়ে এসে বিয়ে দিয়ে থাকেন।

প্রায় দুইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী ব্যতিক্রমী এই মেলায় এসে জীবনসঙ্গী খুঁজতে পেরে খুশি তরুণ-তরুণী ও তাদের পরিবার।

ঠাকুরগাঁও থেকে আসা মেরী বলেন, ‘আমরা আদিবাসী সাঁওতাল। মেলাটা আমাদের প্রতিবছরই হয়, প্রতিবছরই আমরা আসি। অনেক দূরদূরান্ত থেকে আসি। আসলে ছেলে ও মেয়েদের দেখা সাক্ষাৎ হয়। এখানে বিয়ে হয় না, এখানে মেয়েদের ও ছেলেদের দেখা হলে ভালো লাগলে প্রস্তাবের মাধ্যমে বিয়ে হয়। পরে আমাদের সমাজের মাধ্যমে বিয়ে হয়।’

দশমীর পরদিন হয় এই মেলা

চিরিরবন্দর এলাকার শিউলি হেমরম বলেন, ‘এখানে এসে আমাদের আত্মীয়ের মেয়ের বিয়ে ঠিক হলো। ছেলের বাড়ি ফুলবাড়ী, আর মেয়ের বাড়ি বীরগঞ্জে। ছেলের নাম বীরেন মার্ডি আর মেয়ের নাম সুমিতা। এখানে এসে পছন্দ হয়েছে। তারপর বাড়ির লোকজনকে জানানো হয়েছে। এখন এখান থেকেই দুই পরিবার তাদের বিয়ে দেওয়ার জন্য কথাবার্তা চালাচ্ছে।’

জেলার কাহারোল উপজেলার কামোর গ্রাম থেকে আসা রমেশ চন্দ্র রায় বলেন, ‘গোলাপগঞ্জ মিলনমেলার কথা অনেকবার শুনেছি। এবারই পরিবারসহ প্রথম আসলাম। এসে খুব ভালো লাগলো। আমার মেয়ে আছে, স্ত্রী আছে। যদি কোনও ছেলে পছন্দ হয়। জামাই তো করতেই হবে।’

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা থেকে মেলায় ঘুরতে এসেছেন ১৯ বছর বয়সী তরুণী মনিকা হাসদা। তিনি বলেন, ‘আমরা পুরো পরিবার মেলায় এসেছি। মেলার বিষয়ে অনেকের মুখে অনেক কথা শুনেছি। কিন্তু আজকে বাস্তবে দেখা হলো। খুব ভালো লাগলো।’

দিনাজপুর সদর উপজেলার শেখপুরা ইউনিয়নের পারগাঁও গ্রাম থেকে ঘুরতে এসেছেন তরুণী ভাদুরি টুডু। তিনি বলেন, ‘এখানে অনেকরকমের মানুষ আসে। অনেক বছর ধরে এখানে আসা হয়। এখানে আসলে অনেক আত্মীয়স্বজনেরও দেখা পাওয়া যায়। তাই এখানে প্রতিবছর আসি।’

পরিবার ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে আসেন অনেকে

বীরগঞ্জ আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির কোষাধ্যক্ষ জুলি মুর্মু বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবছরই এই মেলার আয়োজন করা হয়। প্রতিবছর দুর্গাপূজার দশমীর পরদিন এই মেলার আয়োজন করা হয়। তবে আগে এই মেলাটিকে বাসিয়া মেলা বা বউ মেলা বলা হতো। এই মেলাটি উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মেলা। উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা থেকেই আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষজন এখানে আসেন।’

বীরগঞ্জ আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির সাধারণ সম্পাদক কমলা কান্ত হাসদা বলেন, ‘প্রায় ২০০ বছর ধরে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আমরা বাবা-দাদার কাছ থেকে এই মেলার বিষয়ে শুনে এসেছি। প্রতিবছর আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন এই মেলার অপেক্ষায় থাকেন। এই মেলা একপ্রকারের মিলনমেলা। সেই সঙ্গে এখন এই মেলা জীবনসঙ্গী খোঁজার মেলা হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। মেলায় শুধু বাংলাদেশেরই নয়, ভারত থেকেও লোকজন আসেন। এখানে যেকোনও প্রান্তের তরুণ-তরুণী নিজেদের পছন্দে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন।’

Source link

Related posts

চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউন, তবে চলছে সবই

News Desk

হাটে ছাগল আছে ক্রেতা নেই

News Desk

সরকারকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে বিএনপি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

News Desk

Leave a Comment