‘বরিশাল নগরীতে ইলিশের মোকাম হিসেবে পরিচিত পোর্ট রোডে সাগরের কোনও ইলিশের দেখা মিলছে না। যেটুকু ইলিশ আসছে, সেগুলো স্থানীয় নদীর। এ কারণে আগের মতো পোর্ট রোড খালে ইলিশ শিকারের ট্রলারের দীর্ঘ সেই লাইন দেখা যায় না। আর ট্রলার না আসার কারণে টনে টনে ইলিশও আসছে না পোর্ট রোডে।’ কথাগুলো বলছিলেন ভোলার মেঘনা নদী থেকে ইলিশ শিকার করে নিয়ে আসা জেলে জামাল ও রফিক।
তাদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয় তাহলে সাগরের ইলিশ যাচ্ছে কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল বের করে সাগরে ইলিশ শিকারে থাকা এক জেলেকে কল দিলেন রফিক। লাউড স্পিকারে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন মাছ পাইছো?’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, ‘যা পাইছি তা সাগরে বসেই বিক্রি করছি।’ কাদের কাছে বিক্রি করছো? এর জবাবে উত্তর এলো, ‘ভারতের জেলেদের কাছে। আড়তে ইলিশ ওঠানোর চেয়ে ওগো (ভারতীয় জেলে) কাছে ইলিশ বিক্রি সহজ। আর ওরা দরদাম করে না। মহাজনের সঙ্গে কথা বইলাই বিক্রি করছি। মহাজনও খুশি হইছে। তোরা নদী বাদ দিয়া সাগরে আয়।’ এ প্রান্ত থেকে উত্তর দিলো দেহি।
এভাবে বেশির ভাগ জেলে সাগরে ইলিশ শিকারের পর ভারতের জেলেদের কাছে তা বিক্রি করে দিয়ে আসছেন। এজন্য দেশের মোকামগুলোতে তেমন ইলিশ আসছে না। তা ছাড়া বরিশাল বিভাগজুড়ে বিভিন্ন স্থানে মোকাম হওয়ায় ইলিশ ভাগ হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ায় ভরা মৌসুমেও দেখা দিয়েছে ইলিশের সংকট। মধ্যবিত্ত পরিবারেরও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ইলিশ। এখন এটি ধনাঢ্য পরিবারের খাবার হয়ে দাড়িয়েছে বলে জানালেন পোর্ট রোডের খুচরা ব্যবসায়ী মানিক সিকদার।
পোর্ট রোডের আড়তদার জহির সিকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাগরে মাছ শিকারের ওপর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকে। ভারতে তাকে ৬১ দিনের নিষেধাজ্ঞা (১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত)। ভারতের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশের সাগরে ৩৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলমান থাকায় ওই সুবিধা নিচ্ছে ভারতীয় জেলেরা। তারা বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে অত্যাধুনিক জাল দিয়ে বড় থেকে একেবারে ছোট ইলিশ পর্যন্ত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আর এ অবস্থা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। যার কারণে ইলিশ বড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। বিষয়টি বারবার মৎস্য কর্মকর্তাদের অবহিত করা হলেও তারা এ বিষয়ে তেমন গুরুত্ব না দেওয়ায় সুবিধা নিয়েছে ভারতীয় জেলেরা। এখনও সাগরে জেলেদের কাছ থেকে ইলিশ ক্রয় করছেন ভারতীয় জেলেরা। এ কারণে পোর্ট রোড মোকামে শুধু নদীর ইলিশ আসায় দাম কমছে না।’
আড়তদার জহির সিকদার ইলিশের সংকট কমাতে সাগরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির দাবি জানান। একই সঙ্গে যে সকল জেলেরা সাগরে বসে ইলিশ বিক্রি করছেন, তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নিতে বলেন। এ কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ইলিশ রাখতে বর্তমান সরকার ভারতে ইলিশ রফতানি বন্ধ করলেও তার সামান্যতম সুবিধা কেউ পাচ্ছে না।
মো. জাহাঙ্গীর ও অঞ্জন দাসসহ একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, ‘পরিবেশগত কারণে সাগর ও নদীতে ইলিশ কম ধরা পড়ায় দাম কমছে না। আর পোর্ট রোডে সাগরের কোনও ইলিশ আসছে না। যা আসছে বরিশাল বিভাগের নদীর মাছ। তা-ও আবার কয়েকভাবে ভাগ হয়ে অর্ধশত মোকামে ছড়িয়ে পড়ছে। ওই সকল মোকাম থেকে ইলিশ যাচ্ছে বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের কাছে। এরপর তা এলসি ছাড়াই প্রবেশ করছে ভারতের বাজারে।’ বিভিন্ন মাধ্যমে বিষয়টি তারা জানতে পেরেছেন।
ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, ‘ইলিশের অত্যধিক দামের কারণে খুচরা বাজারে তা বিক্রি হয় কম। হাতেগোনা কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা ইলিশ ক্রয় করেন। এ কারণে ভালো দাম যেখানে পাওয়া যায় সেখানেই মাছ বিক্রি করা হয়।’
এ ব্যাপারে বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অফিসের উপপরিচালক নৃপেন্দ নাথ বিশ্বাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জেলেদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সঙ্গে একই সময় নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। আশা করছি, একই সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা সমন্বয় হবে।’
তিনিও দাবি করেন, পরিবেশগত কারণে ইলিশ কমেছে। তবে বৃষ্টির সময় জেলেদের জালে ভালো ইলিশ ধরা পড়ছে। জোয়ার, ভাটা এবং বৃষ্টি—এ তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে ইলিশের প্রজনন এবং বড় হওয়া। সাগর থেকে ইলিশ ভারতীয়দের কাছে বিক্রি বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বরিশালের পাইকারি বাজারে দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের ইলিশের মণ ৮৫ হাজার টাকা, এক কেজি ৬৫ হাজার টাকা, ৬০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ৬০ হাজার টাকা এবং ৫০০ গ্রাম ৫৩ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। নিষিদ্ধ জাটকাও মিলছে খোলা বাজারে। সেগুলোর কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা দরে।