রাজশাহীতে বইছে তাপদাহ, হাসপাতালে বাড়ছে রোগী
বাংলাদেশ

রাজশাহীতে বইছে তাপদাহ, হাসপাতালে বাড়ছে রোগী

তীব্র রোদ-গরমে নাভিশ্বাস উঠেছে জনজীবনে। রাজশাহী অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মাঝারি ও তীব্র তাপদাহ। যার প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যে। জ্বর, সর্দি, কাশি, ডায়রিয়াসহ নানা রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। ডাক্তারের চেম্বারে ও হাসপাতালে দীর্ঘ হচ্ছে রোগীর সিরিয়াল।

বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের বারান্দায় ‘তিল’ পরিমাণ ঠাঁই নাই। ওয়ার্ডগুলোতে রোগী ঠাসা। একই চিত্র হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে। বহির্বিভাগেও শিশু ও মেডিসিন চিকিৎসকদের চেম্বারের সামনে রোগীদের দীর্ঘ সিরিয়াল দেখা গেছে। মৃতের সংখ্যায় যোগ হচ্ছে হিট স্ট্রোকের রোগী। হাসপাতালের ইনডোর, আউটডোর ও জরুরি বিভাগে রোগীর চাপ যেমন বাড়ছে, তেমনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকেও রোগী বাড়ছে।

রামেক হাসপাতালের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গত ১৬ এপ্রিল হাসপাতালের আউটডোরে ১৯, ইনডোরে ৩৮ জন ও জরুরি বিভাগে ৭৮ জন ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। যা বুধবার (১৭ এপ্রিল) আরও বেড়েছে। ১৭ এপ্রিল ১২ বছরের কম বয়সী শুধু শিশু ডায়রিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছে ২৪ জন। ১২ বছরের বেশি শিশু ভর্তি হয়েছে ১৪ জন। যা গত ১৮ এপ্রিল ১২ বছরের কম বয়সী শিশু রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ জনে। ১২ বছরের বেশি বয়সী ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশু ভর্তি রয়েছে ১৫ জন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অব্যাহত তাপ প্রবাহের কারণে হাসপাতালে চাপ বেড়েছে।

হাসপাতালের বহির্বিভাগে শিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আফরোজা বেগম। তিনি বলেন, তার বাচ্চার বয়স দেড় বছর। গত কয়েকদিন থেকে সর্দি কাশি জ্বরে ভুগছে। এলাকার ফার্মেসি থেকে ওষুধ খাইয়েছেন। কিন্ত সুস্থতা আসেনি। তাই সরকারি হাসপাতালে এসেছেন। কিন্তু এখানে এসে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

জরুরি বিভাগে শিশুকে ভর্তি করেছেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাসিন্দা নুরবানু বেগম। তিনি বলেন, দুই দিন আগে হঠাৎ বাচ্চা পাতলা পায়খানা করে। এরপর শুধু পানি নামছে। বাধ্য হয়ে ওই দিন রাতেই হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। এখন অনেকটাই সুস্থ আছে।

চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে, ডায়রিয়া পানিবাহিত রোগ। দূষিত পানি পান করার মাধ্যমে এ রোগ হয়। সাধারণত দিনে তিন বা এর চেয়ে বেশি বার পাতলা পায়খানা হতে শুরু করলে তার ডায়রিয়া হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। গরম এলেই ডায়রিয়ার সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করে। বিশেষ করে শিশু-কিশোররা এই রোগে বেশি ভুক্তভোগী হয়।

অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন জীবনযাপন, যেখানে-সেখানে ও পানির উৎসের কাছে মলত্যাগ, সঠিক উপায়ে হাত না ধোয়া, অপরিচ্ছন্ন উপায়ে খাদ্য সংরক্ষণ এবং ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে এবং দোকান, রেস্তোরাঁ বা বাসায় পচন ধরা ফ্রিজের খাবার গ্রহণ ডায়রিয়ার অন্যতম কারণ। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা।

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহাম্মদ বলেন, আবহওয়াজনিত কারণে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা রাখা হয়েছে।

রাজশাহী সিভিল সার্জন ডা. আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক বলেন, উপজেলা পর্যায়েও ডায়রিয়া রোগী আসছে। তবে মহামারি আকার ধারণ করেনি। আসলে মানুষ অস্বাস্থ্যকর খাবার বেশি খাচ্ছে। রাস্তার ধারের অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার প্রতি মানুষের সচেতনতা না বাড়লে ডায়রিয়া মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে যাবে। আমরা চিকিৎসার পাশাপাশি সচেতনতামূলক কার্যক্রমও উপজেলায় চালাচ্ছি।

এদিকে খরতাপে পুড়তে থাকা রাজশাহীতে হঠাৎ করেই ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ওষুধের পাশাপাশি ডাব খাওয়ার পরামর্শও দিচ্ছেন চিকিৎসাকরা। তাইতো নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকায় ওষুধের পাশাপাশি ডাবের ব্যবসাও বেশ জমজমাট। কিন্তু ডাব কিনতে গিয়ে দিশেহারা রোগী ও রোগীর স্বজন।

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের সামনেসহ লক্ষ্মীপুর এলাকায় কমপক্ষে ১০ জন ডাব বিক্রেতার দেখা মেলে। যাদের কেউ অস্থায়ী ভ্যানে আবার কেউ স্থায়ী দোকানে ডাব বিক্রি করছেন। বরাবরের মতোই এখানে ফলের সঙ্গে ডাবের দামও বেশ চড়া।

বুধবার (১৭ এপ্রিল) এ এলাকায় এক পিস ডাব ১৮০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি করতে দেখা গেছে। যেখানে রোগীর কথা চিন্তা করে বাধ্য হয়েই বেশি দামে ডাব কিনছেন ক্রেতারা।

তবে একাধিক সূত্র বলছে, পাইকারি পর্যায়ে ডাবের দাম বৃদ্ধি পেলেও এত অস্বাভাবিকভাবে বাড়েনি। পাইকারিতে ১০০ টাকার নিচেই ডাব কেনাবেচা হচ্ছে। খুচরা পর্যায়ে তা ১৮০ টাকায় যাওয়ার যৌক্তিকতা নেই।

রাজশাহী নগরীর ব্যস্ততম এলাকা জিরো পয়েন্ট মসজিদের সামনে ডাব বিক্রেতা আশরাফ আলী বলেন, ঈদের আগেও ডাবের এতো চাহিদা ছিল না। ঈদের পর গরমও অনেক পড়েছে। ডাবের চাহিদাও বেড়েছে। ১০০ টাকার ওপরে ডাব কিনতেই হচ্ছে। এ কারণে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আমার কাছে তিন কোয়ালিটির ডাব আছে, ১৪০, ১৩০ ও ১১০ টাকা।

আরেক ডাব বিক্রেতা মো. মনির হোসেন বলেন, বড় ডাব তিনি ১৫০ টাকা পিস, মাঝারিটা ১৩০-১৪০ টাকা আর ছোটটা ১১০-১২০ টাকা দামে বিক্রি করছেন।

ক্রেতারা বলছেন, সব জায়গায় দুর্বৃত্তায়ন শুরু হয়েছে। সুযোগ পেলেই ফায়দা লুটছে ব্যবসায়ীরা। নজরদারি না থাকায় যে যা খুশি তাই করছে। এ নিয়ে কথা বলেও কোনও লাভ নেই। তবে যখন বিপদে পড়েন তখন বাধ্য হয়েই কিনতে হয়।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. ইব্রাহীম হোসেন প্রথমে বলেন, ‘আমার কোনও মন্তব্য নেই’। পরক্ষণেই বলেন, এটা কৃষিপণ্য। এটা কিভাবে বিক্রি হয় আপনারা জানেন। তারপরও বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলবো।

এদিকে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় রাজশাহীর প্রকৃতি যেন রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। সকাল থেকেই ঘাম ঝরাচ্ছে সূর্য। প্রকৃতি যেন তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ছে। গাছের সবুজ পাতাগুলো হয়ে উঠেছে বিবর্ণ। বাইরে বইছে গরম বাতাস। আর্দ্রতা কমে যাওয়া পথঘাটের মানুষের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই।  টানা দাবদাহে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছে। বাড়ছে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগবালাই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত দুই দিন থেকে নগরীতে তাপপ্রবাহ নিয়ে সতর্ক থাকতে মাইকে প্রচার করছে জাতীয় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। তারা এই গরমে হিট স্ট্রোকসহ বিভিন্ন রোগ থেকে বাঁচতে সতর্কতামূলক পরামর্শ দিচ্ছেন।
অন্যদিকে রাজশাহীতে একদিনের ব্যবধানে কমেছে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। মাত্র ১ দশমিক ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা কমায় তেমন প্রভাব পড়েনি। তবে তাপমাত্রা কমলেও প্রকৃতিতে গরমের তীব্রতা ছিল। এমন অবস্থায় কয়েকদিন বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই বলছে আবহাওয়া অফিস।

আবহাওয়া অফিস বলছে, বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি। আর দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক আবদুস সালাম বলেন, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ক্রস করেছে। যা তারা তীব্র তাপপ্রবাহ বলে থাকেন। যদিও এই তাপমাত্রা বুধবার (১৭ এপ্রিল) রাজশাহীতে ছিল। বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি। আর দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৬ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আপাতত কয়েকদিন বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই বলে এই পর্যবেক্ষক জানান।

Source link

Related posts

মিধিলির আঘাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত দুবলার চরের শুঁটকিপল্লি, ক্ষতি ৩০ কোটি

News Desk

রাজধানীতে উবারে যুক্ত হলো সিএনজিচালিত অটোরিকশা

News Desk

কুয়াকাটা সৈকতে দেখা মিললো ‘ইয়েলো-বেলাইড সি’ সাপ

News Desk

Leave a Comment