রাসেলস ভাইপার নিয়ে যা বললেন গবেষক ড. ফরিদ আহসান
বাংলাদেশ

রাসেলস ভাইপার নিয়ে যা বললেন গবেষক ড. ফরিদ আহসান

রাসেলস ভাইপার সাপ নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ বলছেন, এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বিষধর সাপ, যার কামড়ে অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষের মৃত্যু হয়। আবার কেউ বলছেন, চিকিৎসা নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে এই জাতীয় নেতিবাচক প্রচারণার কারণে মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় রাসেলস ভাইপার নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বিস্তারিত জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ আহসান; যিনি সাপটি নিয়ে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন।

রাসেলস ভাইপার নিয়ে জানার আগে চলুন জেনে নেওয়া যাক, পৃথিবীতে ঠিক কত প্রজাতির সাপ আছে এবং সেগুলোর মধ্যে বিষধর সাপের সংখ্যা কত?

সাপ বিষয়ক গবেষকরা বলছেন, বিশ্বে এখন পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজারের কিছু বেশি প্রজাতির সাপের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সাত শতাধিক প্রজাতির সাপের বিষ থাকলেও সবগুলোর কামড়ে মানুষ মারা যায় না। এক ছোবলে মানুষের মৃত্যু হতে পারে, এমন বিষধর সাপের সংখ্যা আড়াই শতাধিক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৫৪ লাখ মানুষকে সাপে কামড়ায়, যার মধ্যে প্রায় ৮১ হাজার থেকে এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। যারা প্রাণে বেঁচে যান, তাদের মধ্যে কয়েক লাখ মানুষ অঙ্গহানি, পঙ্গুত্ববরণসহ শারীরিক ও মানসিক নানা ক্ষতির মুখে পড়েন। সাপে কাটার পর যথাসময়ে চিকিৎসা না দিতে পারার কারণে অনেকের অঙ্গহানি এবং মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাপের কাপড়ে আহত বা মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে বড় অংশই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। এরপর শিশুরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বিশ্বে যে আড়াই শতাধিক বিষধর সাপের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলোর মধ্যে শীর্ষ বিষধর সাপের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইট ‘লাইভ সায়েন্স’। নিউইয়র্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির ওই তালিকায় রাসেলস ভাইপারের নাম রয়েছে ছয় নম্বরে। তালিকার শীর্ষে আছে, তাইপান প্রজাতির দুটি সাপ।

ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব নিউরোফার্মাকোলজির বরাত দিয়ে লাইভ সায়েন্স বলছে, ইনল্যান্ড তাইপানই এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে বিষধর সাপ। এক ছোবলে এটি যে পরিমাণ বিষ বের করে, তা প্রাপ্তবয়স্ক অন্তত ১০০ জন মানুষকে মারার জন্য যথেষ্ট। এই সাপের বসবাস অস্ট্রেলিয়ায়। দ্বিতীয়ত কোস্টাল তাইপান সাপটিরও আবাসভূমিও অস্ট্রেলিয়ায়। দুটি সাপেরই অ্যান্টিভেনম আবিষ্কার করা হয়েছে।

তৃতীয়ত কিং কোবরা। লন্ডনের ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে’র তথ্যমতে, কিং কোবরা বিশ্বের দীর্ঘতম বিষধর সাপ। বাংলাদেশে এদের শঙ্খচূড় এবং রাজ গোখরা নামে ডাকা হয়। সর্বোচ্চ ১৮ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, চীন, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ফিলিপাইনসহ এশিয়ার অনেক দেশে এদের বিচরণ। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের শিক্ষক ও জীববিজ্ঞানী শন ক্যারল বলছেন, প্রতিবার ছোবলে একটি কিং কোবরা যে পরিমাণ বিষ ঢেলে দেয়, সেটি একটি পূর্ণবয়স্ক হাতিকে কয়েক ঘণ্টায় এবং একজন মানুষকে ১৫ মিনিটেই মেরে ফেলতে পারে।

চার নম্বরে রয়েছে ব্যান্ডেড ক্রেইট। বাংলাদেশে এটি ডোরা কাটা শঙ্খিনী, ডোরাকাটা কাল কেউটে, শাঁকিনী, শাঁখামুটি নামে পরিচিত। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং ভুটান ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই এদের বিচরণ। এর শরীরে কালো এবং হলুদ রঙের ডোরাকাটা দাগ থাকে, যার মাধ্যমে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। এর বিষে শরীরের পেশিগুলো অবশ হয়ে আসে এবং মানুষ নিঃশ্বাস নিতে না পেরে মারা যায়।

স-স্কেলড ভাইপার বিষধর সাপের তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে। ভারতে প্রতি বছর সাপের কামড়ে যত মানুষ মারা যান, তার একটি উল্লেখযোগ্য মারা যান স-স্কেলড ভাইপারের কামড়ে। মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও এটি দেখা যায়। কামড়ানোর পর ক্ষতস্থানটি ফুলে যায়। বিষে স্নায়ু অবশ হয়ে আসে এবং শরীরের অভ্যন্তরে রক্তপাত ঘটে। এতে কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যায়।

রাসেলস ভাইপার রয়েছে ৬ষ্ঠ স্থানে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মানুষ সবচেয়ে বেশি যে চারটি সাপের কামড়ের শিকার হয়, রাসেলস ভাইপার সেগুলোরই একটি। ইন্ডিয়ান কোবরা, ক্রেইট বা কেউটে, স-স্কেলড ভাইপার এবং রাসেলস ভাইপারকে গবেষকরা একত্রে ‘দ্য বিগ ফোর’ নামে ডেকে থাকেন। 

বাংলা ট্রিবিউন: রাসেলস ভাইপারকে কেন বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল?

ড. ফরিদ আহসান: সাপটি আগে শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলে দেখা যেতো। ২০০২ সালে ওই অঞ্চলে এর উপস্থিতি দেখা না যাওয়ায় সাপ বিষয়ক গবেষকরা বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিলেন। মূলত শুষ্ক অঞ্চলের সাপ এটি। জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য সংকট ও আবাসস্থল হুমকিতে পড়ায় হয়তো বাসস্থান পরিবর্তন করেছিল। আসলে এটি বিলুপ্ত হয়নি। বিশেষ করে পদ্মা তীরবর্তী জেলা ও চরাঞ্চলে উপস্থিতি দেখে বোঝা যায়, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। 

বাংলা ট্রিবিউন: রাসেলস ভাইপার কি বিদেশি সাপ?

ড. ফরিদ আহসান: না। যুগ যুগ ধরে বরেন্দ্র অঞ্চলে বসবাস ছিল এবং আছে। চন্দ্রবোড়া এবং উলুবোড়া নামে ডাকা হয়। দুই দশক আগে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলেও এটি দেশেই ছিল বলে আমার বিশ্বাস। হয়তো আগে এক স্থানে থাকলেও পরে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে গেছে। এর আদি বাসস্থান বাংলাদেশ। কেউ কেউ বলে থাকেন, ভারত থেকে পানিতে ভেসে এসেছে, আসলে এমন মনে করার কোনও সুযোগ নেই।

বাংলা ট্রিবিউন: দেশে কত প্রজাতির সাপ আছে, কতটি বিষধর?

ড. ফরিদ আহসান: দেশে এখন পর্যন্ত ১০৬ প্রজাতির সাপ আমার দৃষ্টিতে এসেছে। এর মধ্যে ৩২ প্রজাতি বিষধর। রাসেলস ভাইপার তার মধ্যে একটি। দেশে তার চেয়েও বেশি বিষধর সাপ আছে।

বাংলা ট্রিবিউন: আরও বিষধর সাপ কোনটি?

ড. ফরিদ আহসান: ব্যান্ডেড ক্রেইট। এটিকে ডোরা কাটা শঙ্খিনী, ডোরাকাটা কাল কেউটে, শাঁকিনী, শাঁখামুটি ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। আরেকটি হলো কিং কোবরা। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম বিষধর সাপ। বাংলাদেশে এদের শঙ্খচূড় এবং রাজ গোখরা নামে ডাকা হয়। দেশে সবচেয়ে বেশি মারা যায় এই দুই প্রজাতির সাপের কামড়ে। তবে দেশে ছয় প্রজাতির সাপে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। তার মধ্যে বেশি মৃত্যু হয় ক্রেইট প্রজাতির তিনটি, কোবরা প্রজাতির দুটি এবং ৬ষ্ঠ ধাপে মৃত্যু রাসেলস ভাইপারে।

বাংলা ট্রিবিউন: নাম কেন রাসেলস ভাইপার?

ড. ফরিদ আহসান: ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতে এসেছিলেন স্কটিস সার্জন প্যাট্রিক রাসেল। ১৭৯৬ সালে এই সাপ নিয়ে গবেষণা করেন। তার নাম অনুসারেই নামকরণ করা হয়। অর্থাৎ, প্যাট্রিক রাসেল থেকেই রাসেলস ভাইপার। বাংলাদেশে ২০০২ সালে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন রাসেলস ভাইপারকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিল। তবে বিলুপ্ত হয়নি। আগে বিশেষ করে বরেন্দ্র এলাকায় থাকলেও এখন উপকূলীয় এলাকার কয়েকটি জেলাসহ অন্তত ৪০টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।

বাংলা ট্রিবিউন: রাসেলস ভাইপারের স্বভাব কেমন?

ড. ফরিদ আহসান: দেখতে অনেকটা অজগরের বাচ্চার মতো। সাঁতার জানে। মানুষ কাছাকাছি গেলে হিসহিস শব্দ করে। একসঙ্গে তিন থেকে ৬৫টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়। আরও বেশিও দিতে পারে। গর্ভধারণকাল ছয় মাস এবং বাচ্চা দুই বছরের মধ্যে পরিপক্ব হয়ে ওঠে। সাধারণত নিশাচর। রাতে চলাচল করতে পছন্দ করে। মানুষের বসতবাড়ি এড়িয়ে চলে। থাকার জন্য ঝোপঝাড়, ফসলের মাঠ কিংবা জমির গর্ত পছন্দ। ইঁদুরসহ অন্যান্য শিকার ধরার জন্য চতুর। ধানক্ষেত এবং এর আশপাশের এলাকায় বসবাস করে। ফলে কৃষকরাই আক্রমণের শিকার হন বেশি। কাউকে আঘাত করলে স্নায়ু অবশ হয়ে আসে এবং ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণ বাড়তে থাকে। ফলে ফুসফুস এবং কিডনি আক্রান্ত হয়ে ব্যক্তি মারা যায়। তবে জীবনের হুমকিবোধ না করলে নিজে থেকে কামড় দেয় না। মেটে রঙের হওয়ায় মাটির সঙ্গে সহজে মিশে থাকতে পারে।

বাংলা ট্রিবিউন: রাসেলস ভাইপারের প্রজনন বা আগের চেয়ে সংখ্যা কি বেড়েছে?

ড. ফরিদ আহসান: নব্বইয়ের দশক থেকে দেশে সেচ পদ্ধতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দুই-তিন ফসলি জমি বেড়েছে। এ কারণে জমিতে ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে গেছে, যা রাসেলস ভাইপারের খাবার। ভালো খাবার আর বংশবিস্তারের যথাযথ পরিবেশ পাওয়ায় প্রজনন বেড়েছে। কারণ এর উচ্চ প্রজনন-ক্ষমতা আছে। ডিম না দিয়ে বাচ্চা দেয়, ফলে দ্রুত বংশবিস্তার করছে। অবশ্যই আগের চেয়ে বংশবিস্তার ও সংখ্যা বেড়েছে। 

বাংলা ট্রিবিউন: কীভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে?

ড. ফরিদ আহসান: বংশবিস্তার বেড়ে যাওয়ায় নদীর স্রোত ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় এটি বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে গেছে। কচুরিপানায় কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে। অনেক সময় দেখা যায়, কচুরিপানায় সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে। একসময় কয়েকটি জেলায় দেখা যেতো। সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এখন প্রায় সব জেলায় দেখা যাচ্ছে। আমার ধারণা, উষ্ণ জলবায়ুর কারণে বাসস্থান পরিবর্তন করেছে। গর্ত এবং ঝোপঝাড়ে বসবাস হওয়ায় বর্ষায় সেগুলো ডুবে যায়। এজন্য উঁচু স্থান ও ফসলি জমিতে আশ্রয় নিয়েছে।

বাংলা ট্রিবিউন: বিষধর এই সাপ কেন লোকালয়ে আসছে? 

ড. ফরিদ আহসান: নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, বনভূমি ও চরের প্রাকৃতিক প্রাণীর আবাস নষ্ট করা, সাপের শিকারি; যেমন খ্যাঁকশিয়াল, বেজি, তিলা নাগ ঈগল, খাটাশ, বনবিড়াল, প্যাঁচা ইত্যাদি হত্যার কারণে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় লোকালয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে।

বাংলা ট্রিবিউন: ফেসবুকে নেতিবাচক প্রচারণা সম্পর্কে আপনার মতামত কি?

ড. ফরিদ আহসান: দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে ফেসবুকে সাপটি নিয়ে প্রচুর নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এটি মানুষের মধ্যে অযথা আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। অনেকে সাপ দেখলেই রাসেলস ভাইপার মনে করে মেরে ফেলছে। এতে সাপটির বংশ শেষ হয়ে যাবে। এটি পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। 

বাংলা ট্রিবিউন: কামড়ের কত সময়ের মধ্যে মৃত্যু হতে পারে?

ড. ফরিদ আহসান: এটি নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তবে কামড়ালে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ঘটে না। দ্রুত চিকিৎসা নিলে সুস্থ হওয়া যায়। বিশেষ করে কামড়ানোর ১০০ মিনিটের মধ্যে অ্যান্টিভেনম নিতে পারলে মৃত্যুরোধ করা যায়। এর বেশি সময় গড়ালে রোগীর শারীরিক ক্ষতি হয়। এখন সরকারি জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে অ্যান্টিভেনম পাওয়া যাচ্ছে। অ্যান্টিভেনম-ই আক্রান্ত রোগীর প্রধান ওষুধ। বাংলাদেশে সব বিষধর সাপের জন্য একটাই কার্যকর অ্যান্টিভেনম ব্যবহার হয়। এর নাম পলিভ্যালেন্ট।

বাংলা ট্রিবিউন: আক্রান্ত ও মারা যাওয়া রোগীর সংখ্যা কেমন?

ড. ফরিদ আহসান: সারা দেশে এক বছরে সাপের কামড়ে যে পরিমাণ লোক মারা যায়, তা হিসাব করলে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মারা যাওয়া রোগীর সংখ্যা ২৫-৩০ শতাংশ। আগেই বলেছি, এর চেয়ে ক্রেইট ও কোবরা সাপের কামড়ে মৃত্যু বেশি। প্রতি বছর দেশে অন্তত ১৫ হাজার মানুষকে সাপে কাটে। এর মধ্যে অর্ধেকই সঠিক সময়ে হাসপাতালে না আসায় এবং অ্যান্টিভেনম না নেওয়ায় মারা যান। ২০১৮ সালে আমাদের (ফরিদ আহসান ও আবু সাঈদ কর্তৃক প্রকাশিত) গবেষণাপত্র ‘ডিস্ট্রিবিউশন অভ রাসেলস ভাইপার ইন বাংলাদেশ’ এ উল্লেখ করেছি; ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ২০টি রাসেলস ভাইপার মানুষকে আঘাত করেছিল। এর মধ্যে আট জন রোগী ওঝার কাছে চিকিৎসা গ্রহণ করেন এবং বাকিদের মধ্যে অধিকাংশই ওঝার কাছে গিয়ে সময় নষ্ট করে পরে হাসপাতালে আসেন। এদের অধিকাংশই ওঝার অপচিকিৎসা অথবা দেরি করে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে মারা গেছেন। এখনও গ্রামে-গঞ্জে সাপে কামড় দিলে লোকজন সাধারণত সাপুড়ে বা ওঝা-বৈদ্যের কাছে যায়। এগুলো না করে সাপে কামড়ানো রোগীকে দ্রুত সরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসার পরামর্শ দিচ্ছি। 

বাংলা ট্রিবিউন: শুধু কি রাসেলস ভাইপার নিয়েই গবেষণা করছেন?

ড. ফরিদ আহসান: আমি মূলত সব ধরনের সাপ নিয়ে গবেষণা করছি। দীর্ঘদিন রাসেলস ভাইপার নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। এখন নতুন করে আবারও সামনে আসায় গবেষণা শুরু করেছি।

বাংলা ট্রিবিউন: কামড় এড়াতে করণীয় কী?

ড. ফরিদ আহসান: যেসব এলাকায় রাসেলস ভাইপার দেখা গেছে, সেসব এলাকায় চলাচলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। লম্বা ঘাস, ঝোপঝাড়, কৃষি এলাকায় হাঁটার সময় সতর্ক থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় কাজ করার সময় বুট ও লম্বা প্যান্ট পরতে হবে। রাতে চলাচলের সময় অবশ্যই টর্চলাইট সঙ্গে রাখতে হবে। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। পতিত গাছ, জ্বালানির লাকড়ি ও খড় সরানোর সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সাপ দেখলেই মারা যাবে না, মানুষ দেখলে এমনিতেই সরে যাবে সে।

বাংলা ট্রিবিউন: কামড় খেলে করণীয় কী?

ড. ফরিদ আহসান: পায়ে কামড়ালে বসে পড়তে হবে, হাঁটা যাবে না। হাতে কামড়ালে হাত নড়াচাড়া করা যাবে না। কারণ হাত-পায়ের গিরা নড়াচড়ায় মাংসপেশির সংকোচনের ফলে বিষ দ্রুত রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ওঝার কাছে না গিয়ে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে যাবেন। আতঙ্কিত হবেন না। রাসেলস ভাইপারের অ্যান্টিভেনম নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।

বাংলা ট্রিবিউন: প্রাদুর্ভাব কমাতে করণীয় কী?

ড. ফরিদ আহসান: সাধারণত বেজি, গুইসাপ, বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বনবিড়াল, মেছো বিড়াল, তিলা নাগ ইগল, সারস, মদনটাক পাখি এবং কিছু প্রজাতির সাপও রাসেলস ভাইপার খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এসব বন্য প্রাণী মানুষ নির্বিচার হত্যার কারণে প্রকৃতিতে রাসেলস ভাইপার বেড়ে গেছে। তাই বন্য প্রাণী দেখলেই অকারণে হত্যা ও আবাসস্থল ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

বাংলা ট্রিবিউন: বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।

ড. ফরিদ আহসান: বাংলা ট্রিবিউনকেও ধন্যবাদ

Source link

Related posts

৮ মার্কেটেই ভ্যাট দেয় না ৯০৪ প্রতিষ্ঠান

News Desk

জনগণের দিকে বিএনপির দৃষ্টি থাকে না

News Desk

সড়কে ৫ ভাইকে চাপা দেওয়ার ঘটনায় মামলা, পিকআপ জব্দ 

News Desk

Leave a Comment