রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতি বছর ৩০ হাজার শিশুর জন্ম
বাংলাদেশ

রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতি বছর ৩০ হাজার শিশুর জন্ম

কক্সবাজারের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে হরহামেশাই অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা ও আগুন সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। এ অবস্থায় নিরাপত্তা নিয়ে বেশ উদ্বেগ ছিল। তার ওপর প্রতি বছর আশ্রয় শিবিরে জন্ম নিচ্ছে ৩০ হাজার শিশু। এসব কারণে দিন দিন চাপ বাড়ছে আশ্রয় শিবিরগুলোতে। রোহিঙ্গা জনবিস্ফোরণে এখন নীতিনির্ধারকরাও রীতিমতো চিন্তিত।

সম্প্রতি শরণার্থী বিষয়ক এক সভায় বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণে জোর দেওয়ার কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রতি বছর ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্মের তথ্য দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এই দেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেওয়ার পাঁচ বছরে প্রায় দেড় লাখ শিশুর সংখ্যা বেড়েছে।’

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআরের তথ্য মতে শিবিরগুলোতে প্রতি বছরে প্রায় ৩০ হাজার শিশু যোগ হচ্ছে। 

ইউএনএইচসিআরের হিসাবে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী ৯ লাখ ২৩ হাজার ১৭৯ জন নিবন্ধিত রয়েছেন। এর মধ্য চার লাখ ৭০ হাজার ৮২২ জন শিশু। অর্থাৎ রোহিঙ্গা শিবিরের ৫১ শতাংশই শিশু। এদের মধ্য সাত শতাংশ শিশু চার বছর বা তার কম বয়সী। আর ১১ শতাংশ পাঁচ থেকে ১১ বছর বয়সী। এই চার বছরের বেশি সময়কালে জন্মের আনুমানিক সংখ্যা সম্পর্কে, স্বাস্থ্য সেক্টরের সদস্যরা একাধিক সমীক্ষা পরিচালনা করেছেন। এতে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার শিশু জন্মের তথ্য উঠে এসেছে। অর্থাৎ তাদের মতে প্রতিদিন ক্যাম্পগুলোতে জন্ম নিচ্ছে ৮৩টি শিশু। তবে সঠিক পরিসংখ্যান নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে।

এ অবস্থায় রোহিঙ্গা শিবিরে জন্ম নিয়ন্ত্রণ না করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের মহাসচিব এইচএম নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এখন স্থানীয়দের জন্য মহাবিপদ হয়েছে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে, প্রতি বছর শিশু জন্মের সংখ্যা উদ্বেগ বাড়িয়েছে।পুরো দেশ হুমকির মুখে পড়েছে। এসবের একমাত্র সমাধান রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।’
 
সরেজমিনে দেখা যায়, ২০১৭ সালের আগে দুই হাজার পরিবারের সাড়ে আট হাজার রোহিঙ্গা নিয়ে গড়ে ওঠে টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবির। এখন সেখানে ৩৬ হাজার মানুষের বসতি। চার বছর বেশি সময়ে সেখানে মানুষ বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ।
 
এ বিষয়ে লেদা ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বলেন, প্রতি বছর মানুষ বাড়ছে। কিন্তু থাকার ঘরের জায়গা বাড়ছে না। তবে এটা সত্যি যে, গত কয়েক বছরে এখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতি হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা জন্ম নিয়ন্ত্রণে বিষয়ে সচেতন নয়। বেশিরভাগই অশিক্ষিত, যে কারণে জন্ম নিয়ন্ত্রণে কোনও পদ্ধতি মানছেন না তারা। তবে আমরা চেষ্টা করছি, তাদের বোঝানো কাজ চলছে।’ 

জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনও ব্যবস্থা নেন কিনা জানতে চাইলে লজ্জা পান লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের সৈয়দ আলম দম্পতি। পরে তার স্ত্রী মিনারা বেগম জানান, কখনও তারা কোনও ব্যবস্থা নেননি। এ বিষয়ে কোনও ধারণাও নেই তাদের।

ঠিক দুই ঘর পরেই ববিতা আয়েশাদের বাস। তিন সন্তানের জননী ৩০ বছরের আয়েশা এখন ফের আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। শুধু তাই নয়, আরও সন্তান নিতে আগ্রহী তার স্বামী। আর জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি সম্পর্কে কোনও ধারণা বা আগ্রহ নেই তাদের।

এদিকে ক্যাম্পের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক চিকিৎসক বলেন, ‘আমাদের যেমন ক্লিনিক হাসপাতালে গিয়ে সন্তান প্রসব হয়, সেরকম অবস্থা বা মানসিকতা রোহিঙ্গা নারীদের নেই। ক্যাম্পের ৭০ শতাংশ নারী সন্তান প্রসব করেন ঘরে, তারা কোনও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যান না। এ কারনে শিশু জন্মের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে না।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করছে এমন একটি সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্যাম্পগুলোতে এখন কত জন গর্ভবতী নারী রয়েছেন, এর সঠিক হিসাব কারও কাছে নেই। ফলে প্রতিদিন কত শিশু জন্ম নিচ্ছে সেটি সঠিকভাবে বলা মুশকিল। যেটা শুরু থেকে ধারণা করা হয়েছিল, সেই সংখ্যা ধরেই সংস্থাগুলো কাজ করছে, যদিও এ সংখ্যা বাড়তে পারে বা কমতে পারে। আবার নারীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী হলেও তাতে পুরুষরা আগ্রহী নয়।’

 কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু কাজটা খুব কঠিন। তাদের মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু এতে আদৌ কোনও কাজ হচ্ছে কিনা, সেটা বলা মুশকিল। তবু আমরা সবাই মিলে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

রোহিঙ্গা শিবিরে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কার্যকর কঠিন জানিয়ে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার সামছু দৌজা নয়ন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ও অন্ধকারে ছিল। ফলে এটা নিয়ে তাদের কোনও চিন্তা নেই। এরপরেও তাদের সচেতন করার জন্য কাজ চলছে।’ 

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে আগস্ট মাসে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা শুরু করলে সাত লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রস্তুতি থাকলেও গত কয়েক বছর চেষ্টা করেও রোহিঙ্গাদের ফেরত নিচ্ছে না মিয়ানমার। ফলে ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশ সরকার একটি নিরাপদ ও উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৩ দফায় ২৯ হাজার ১৪১ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে কক্সবাজার থেকে মধ্য বঙ্গোপসাগরের ভাসানচর দ্বীপে স্থানান্তর করেছে। সেখানে সরকার এক লাখেরও বেশি শরণার্থীকে রাখার মতো একটি কমপ্লেক্স তৈরি করেছে। 

Source link

Related posts

অক্সিজেন সংকটে সাতজন করোনা রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ

News Desk

রথযাত্রায় ৫ জনের মৃত্যু: প্রশাসন সতর্ক করলেও শোনেননি আয়োজকরা

News Desk

ডিসেম্বরের মধ্যেই কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ করার নির্দেশ

News Desk

Leave a Comment