শিশুরা একসঙ্গে পড়ে স্কুলে। বন্ধু হিসেবে বসে পাশাপাশি সিটে। একসঙ্গে খেলাধুলা, পাঠ, সবই চলে। তবে বৈষম্য শুধু হোটেলে।
বন্ধুরা যখন হোটেলে বসে খাবার খায়, টিফিন করে, তখন কবিতা-বিশালরা বসে হোটেলের বাইরের বেঞ্চে। ওখানেই দেওয়া হয় খাবার। সামাজিকভাবে এমন বৈষম্য তৈরি করে রেখেছেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কয়েকটি হোটেল মালিক।
কুলাউড়া পৌর শহরের পরিনগর রেলওয়ে হরিজন কলোনিতে বসবাস করা হরিজন সম্প্রদায়ের সন্তানরা জানায়, স্কুলের টিফিনের সময় বা ছুটির সময় তারা হোটেলে বসে খেতে পারে না। তাদের বন্ধুরা একই সঙ্গে এসে হোটেলে প্রবেশ করলেও তাদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। তাদের কাগজে বা আলাদা নিজস্ব পাত্রে খাবার নিয়ে হোটেলের বাইরে বসতে হয়।
হরিজন সম্প্রদায়ের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিতের অভিযোগ এনে প্রতিকার চেয়ে সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। যার অনুলিপি জেলা প্রশাসক, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র ও ওসি বরাবর পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের কুলাউড়া শাখার সভাপতি মৎলা বাসপর অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা হরিজন সম্প্রদায় এসব সামাজিক বা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমরা শহরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করি। আমাদের ছেলে-মেয়ে শহরের বিভিন্ন স্কুলে পড়ালেখা করে। কিন্তু স্কুল টিফিনের সময়ে অন্য বাচ্চারা হোটেলে ভেতরে বসে খায় আর আমাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুল ড্রেস পরে গেলেও তাদের কাগজে নাশতা দেওয়া হয়। ’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা উপজেলা প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করছি, আমাদের মৌলিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা যেন গ্রহণ করা হয়। ’
শহরের হোটেল মালিকদের অভিযোগ, হরিজন সম্প্রদায়ের অনেকে মদ্যপ অবস্থায় হোটেলে আসেন। যা অন্যরা মেনে নিতে পারে না এবং বিভিন্ন সময় অভিযোগ করে। ক্রেতাদের অসুবিধা হওয়ার কারণে তাদের (হরিজন) জন্য হোটেলের বাইরে বেঞ্চ দেওয়া হয়েছে। হরিজনদের হোটেল থেকে পার্সেল বা হোম ডেলিভারি নিয়মিত দেওয়া হয় বলেও জানান তারা।
কুলাউড়া হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. লোকমান মিয়া বলেন, ‘আমাদের মধ্য কোনো বৈষম্য নেই। আমরা ব্যবসা করতে এসেছি, ব্যবসা করব। হরিজনরা হোটেলে সবার সঙ্গে বসে খেতে চায়; কিন্তু হোটেলের অন্য কাস্টমাররা এতে আপত্তি করে। তবে স্কুলে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের হোটেলে না খাওয়ানোর বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। ’
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমি একটি হোটেল পরিদর্শন করেছি এবং হোটেল মালিককে বলেছি, সংবিধান বা আইনের কোনো জায়গায় এমন কথা আছে কি না যে হরিজন বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সাথে একত্রে বসে খাওয়া যাবে না? তাই সবাইকে বলেছি এভাবে কোনো জাতিকে বৈষম্য করা যাবে না। দ্রুত হোটেল মালিকরা বিষয়টি সমাধান করবেন বলে আমাদের কাছ থেকে সময় নিয়েছেন। ’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাহমুদুর রহমান খোন্দকার বলেন, ‘জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের হোটেল একসঙ্গে বসে খেতে পারবে। এতে কোনো বাধা নেই, এখানে কোনো জাতিকে হেয় করে দেখা চলবে না। হরিজনদের পক্ষ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর হোটেল মালিকদের ডেকে নির্দেশনা দিয়েছি, কাউকে হেয় না করে সুন্দর পরিবেশে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য। এর পরও যদি কোনো হোটেল মালিক ফের হরিজনদের সাথে এ ধরনের আচরণ করেন তবে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’