কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদের বাসভবনে নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়েছে। উপাচার্য তার পরিবার, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও প্রক্টরসহ ২০ জনকে উপাচার্যের বাস ভবনে অবরুদ্ধ করে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। গত মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) দুপুরের পর এই হামলা চালানো হয়। দীর্ঘ চার ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে র্যাব ও মেট্রোপলিটন পুলিশ যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে তাদের উদ্ধার করে রংপুর সার্কিট হাউজে নিয়ে আসে।
অভিযোগ আছে, কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসীরা উপাচার্যসহ ২০ জনকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার বাসভবনে হামলা চালিয়ে নিচতলায় আগুন ধরিয়ে সব মালামাল লুট করে। আগুনের লেলিহান শিখায় বাসভবন দাউদাউ করে জ্বললেও ফায়ার সার্ভিস কিংবা পুলিশ সেখানে যেতে পারেনি। একপর্যায়ে প্রাণ রক্ষায় দোতলার একটি কক্ষে উপাচার্যসহ ২০ জন দীর্ঘ চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। বিষয়টি জানিয়েছেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (অপরাধ) আবু মারুফ হোসেন।
উপাচার্য ও তার পরিবারকে হত্যাচেষ্টা
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শরীফুল ইসলাম জানান, গত মঙ্গলবার দুপুর ১টার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে পার্কের মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কোটা সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ টিয়ার গ্যাস , রাবার বুলেট আর শর্টগানের গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিল। দুপুর ৩টার দিকে বেরোবির শিক্ষার্থী আবু সাঈদ গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়। তাকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
প্রক্টর জানান, সংঘর্ষ চলার সময় তিনিসহ ২০ দায়িত্বশীল শিক্ষক-কর্মকর্তা উপাচার্যের বাসভবনের নিচতলার অফিসে ছিলেন। হামলার সময় উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ, তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যাক্ষ ড. মজির উদ্দিন, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদ মণ্ডল, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান, কর্মকর্তা অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তাপস গোস্বামীসহ ২০ দায়িত্বশীল কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ৫ শতাধিক বহিরাগত সন্ত্রাসী উপাচার্যের বাসভবনে হামলা চালায়। তারা বাসার সামনে দুটি প্রাইভেটকারসহ ২০টি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় আতঙ্কে সবাই উপাচার্যসহ তার বাসভবনের দোতলায় আশ্রয় নেন।
তিনি জানান, এ সময় নিচতলায় হামলা চালিয়ে আসবাবপত্রসহ মালামাল ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের লেলিহান শিখায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। প্রাণ রক্ষার্থে দোতলায় একটি কক্ষে উপাচার্যসহ ২০ জন আশ্রয় নেন। এর মধ্যে দোতলার বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। বোমাসহ ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সন্ত্রাসীরা উপাচার্যসহ সবাইকে হত্যার জন্য বাসভবন লক্ষ্য করে বোমা, ককটেল ছোড়ে। এতে দোতলার জানালা দরজা ভেঙে খান খান হয়ে যায়।
প্রক্টর বলেন, এই অবস্থায় আমরা প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা দুঃসহভাবে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করি। নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম, আমাদের পুড়িয়ে জীবন্ত হত্যা করা হবে। সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোপলিটন পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আকুতি জানানো হয়, জীবন রক্ষার জন্য। অবশেষে সন্ধ্যা ৭টায় পুলিশ ও র্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেট দিয়ে না গিয়ে পেছন দিক দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে ২০ জনকে উদ্ধার করে গাড়িতে করে রংপুর সার্কিট হাউজে নিয়ে যায়।
প্রক্টর শরীফুল ইসলাম জানান, আর ১০ মিনিট দেরি হলেই সন্ত্রাসীরা আমাদেরকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করতো।
সেখানে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদ মন্ডল বলেন, যারা উপাচার্যের বাস ভবনে হামলা চালিয়েছে, তারা আমাদের জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে। তারা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে পারে না। কারণ তারা শিক্ষকদের ওপর আক্রমণ করে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করতে পারে না।
তিনি বলেন, যারা উপাচার্যের বাসভবনে হামলা চালিয়েছিল তারা কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল না। এরা উপাচার্যের বাসভবনের পেছনে কারমাইকেল কলেজ এলাকা দিয়ে দেয়াল টপকে প্রবেশ করেছিল। তাদের টার্গেট ছিল উপাচার্যের বাসভবনে হামলা চালিয়ে হত্যা করা।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ সে দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমার অফিসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ, প্রক্টর, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ে মিটিং করছিলাম। আমার স্ত্রী দোতলায় আমার বেডরুমে ছিলেন। আকস্মিকভাবে আমার বাসভবনে হামলা চালায়। আমরা সবাই জীবন বাঁচাতে দোতলায় যাই। এ সময় নিচতলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন ধরিয়ে থামেনি তারা, দোতলা লক্ষ্য করে বোমা ও ইট পাটকেল নিক্ষেপ করেছে। আমি জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের ফোন করছিলাম। ফায়ার সার্ভিসকেও ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর ফায়ার সার্ভিস আমার বাড়ির চারদিকে অবস্থান করা সন্ত্রাসী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবের কারণে আসতে পারছিল না।
তিনি বলেন, অবশেষে বাধ্য হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ফোন করি। তিনি রিসিভ করলে আমার স্ত্রীসহ ২০ জনের জীবন রক্ষা এবং উদ্ধারের জন্য অনুরোধ জানাই। এরপর পুলিশ বিজিবি ও র্যাবের একটি দল গুলি বর্ষণ করতে করতে সাইরেন বাজিয়ে আমার সামনে এসে আমাকে আমার স্ত্রী ও অন্যদের তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে সরাসরি সার্কিট হাউজে নিয়ে যায়। ফলে আমরা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাই। এ জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
রংপুর জেলা প্রশাসক মোবাশ্বের হাসান জানান, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তার স্ত্রীসহ অবরুদ্ধ থাকা ২০ জনকে উদ্ধারের অভিযান ছিল দুঃসাহসিক। মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি আবু মারুফ হোসেন, র্যাব-১৩ এর কমান্ডার কামরুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশ ও র্যাব কমান্ডো স্টাইলে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার না করলে জীবন রক্ষা করা সম্ভব হতো না।
এ বিষয়ে র্যাব-১৩ এর এক কর্মকর্তা জানান, তারা জানতে পারে, উপাচার্যসহ ২০ জন আটকা পড়ে আছেন। এ খবর পাওয়ার পর মেট্রোপলিটন পুলিশসহ যৌথভাবে দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে তাদের উদ্ধার করা হয়। এ সময় হামলাকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। পরে কমান্ডো স্টাইলে গুলি ছুড়তে ছুড়তে উপাচার্যের বাসভবনের পেছন দিয়ে সেখানে প্রবেশ করে তাদের উদ্ধার করা হয়।
মেট্রোপলিটন ডিসি আবু মারুফ হোসেন জানান, র্যাব ও পুলিশ যৌথভাবে কমান্ডো স্টাইলে অভিযান চালিয়ে উপাচার্যসহ ২০ জনকে উদ্ধার করে রংপুর সার্কিট হাউজে নিয়ে আসে।