হঠাৎ কেন অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম?
বাংলাদেশ

হঠাৎ কেন অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম?

হঠাৎ আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। খাগড়াছড়ির পর সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে রাঙামাটিতেও। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় খাগড়াছড়িতে তিন এবং রাঙামাটিতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৫০ জনের বেশি। খাগড়াছড়ি জেলা সদরে মোটরসাইকেল চুরির একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বুধবার পিটুনিতে মো. মামুন নামের এক যুবক প্রাণ হারান। মূলত খাগড়াছড়ির সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ মিছিলের পর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে পার্বত্য শহর রাঙামাটিতে।

জানা গেছে, শুক্রবার সকালে শহরের জিমনেসিয়াম চত্বর থেকে পাহাড়িদের একটি মিছিল বের হয়ে বনরূপা এলাকায় যায়। সেখানে মিছিলে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছে– এমন অভিযোগ এনে বাঙালিদের বেশ কিছু দোকানপাট, মসজিদের কাচ ভাঙচুর করেন মিছিলকারীরা। তারা সে সময় রাস্তায় চলাচল করা বাস, ট্রাক, ট্যাক্সি, ভাঙচুর করেন।

হামলা প্রতিরোধে লাঠিসোঁটা হাতে মাঠে নেমে পড়েন বাঙালিরাও। তাদের পাল্টা হামলায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কাঁঠালতলীতে অবস্থিত মৈত্রী বিহার, লুটপাট করা হয় বিহারের দানবাক্সের অর্থ। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় বনরূপায় পাহাড়িদের মালিকানাধীন দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় আঞ্চলিক পরিষদের সাতটি গাড়ি। দু’পক্ষের আগুনে পুড়ে যায় বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলও। এর মধ্যে রাঙামাটির তিন সাংবাদিকদের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসন দুপুর ১টা থেকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাঙামাটি পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে। হামলার ঘটনায় শহরে অর্ধ-শতাধিক দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরপর মাঠে নামেন পুলিশ, বিজিবি ও সেনা সদস্যরা।

পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের দাবি, মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে বনরূপায় বাঙালিরা তাদের মিছিলে ইট-পাটকেল ছুড়ে মারে, এতে তাদের বেশ কয়েকজন কর্মী আহত হন।

এরপর দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। বাঙালিরা অভিযোগ করেন, পাহাড়িদের বিক্ষোভ মিছিল থেকে বনরূপা মসজিদ মার্কেট ও মসজিদ মার্কেট সংলগ্ন জামে মসজিদে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। এতে বাঙালিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে পাহাড়িদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করেন। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা শুরু হয়।

মো. আহাত নামে আহত এক যুবক বলেন, ‘সকালে আমি বনরূপাতে ছিলাম। পাহাড়িদের একটি মিছিল বনরূপা ঘুরে যাওয়ার পথে হঠাৎ করেই বাঙালিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। মসজিদে ইট মেরে কাচ ভাঙচুর করে। এ সময় তাদের ইটের আঘাতে অনেকেই আহত হয়। আমার হাতে একটি ইট পড়ে। এখানকার ফার্মেসিতে চিকিৎসা নিয়েছি, ভয়ে হাসপাতালের দিকে যেতে পারছি না।’

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উন্মেষের সভাপতি প্রিন্সি চাকমা বলেন, ‘প্রো বেটার লাইফ (পিবিএল) অফিসে সকালে গিয়েছিলাম। কয়েকজন শিক্ষার্থী আমাদের সঙ্গে ছিল। হঠাৎ দেখি আমাদের অফিসের নিচে আগুন লাগানো হয়েছে। পরে সেনাবাহিনী আমাদের উদ্ধার করতে আসে। আমরা যখন সেনাবাহিনীর গাড়িতে উঠি তখনও বাঙালিরা আমাদের ওপর হামলা করে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। পরে আমাদের নিরাপদ স্থানে রেখে আসেন সেনাসদস্যরা। এ সময় আমাদের সঙ্গে থাকা চার জন শিশুশিক্ষার্থীকে হারিয়ে ফেলি। সেই শিশুদের উদ্ধার করা হবে বলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাকে আশ্বস্ত করেন।’

ডায়াগনস্টিক সেন্টার শেভরন ডক্টরস ল্যাবে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার চিকিৎসক অসিত বরণ ডাম। তিনি বলেন, ‘আমি ল্যাবে যাইনি। স্টাফরাও সেখানে নেই। আমাদের ল্যাবে ভাঙচুর করা হয়েছে এবং আশেপাশের বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বলে শুনেছি।’

রাঙামাটি পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘সকালে পাহাড়িদের একটি মিছিল বনরূপায় এসে ফিরে যাওয়ার সময় ওই এলাকার বাঙালিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বনরূপা মসজিদে হামলা ও ভাঙচুর করে বলে জানতে পেরেছি। এ সময় তারা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এরপরই বাঙালি ব্যবসায়ীরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের পাল্টা ধাওয়া দেয়। এ সময় ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া হয়।’

এদিকে, বিক্ষোভকারীদের আগুনের ঘটনায় ফাইবার অপটিকের কেবল পুড়ে যায়। ফলে রাঙামাটি শহরে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইয়েস নেট-এর পরিচালক মো. শাহীন। তিনি বলেন, ‘পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এতে ফাইবার অপটিকের কেবল পুড়ে যায় এবং ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হয়।’

রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) শওকত আকবর বলেন, ‘হাসপাতালে ৫৩ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৯ জন ভর্তি রয়েছেন। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এক যুবকের মরদেহ হাসপাতালে রয়ে গেছে। তার কোনও আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ আমরা পাচ্ছি না।’

রাঙামাটি সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মু. সাইফুল উদ্দিন জানিয়েছেন, কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। তদন্ত সাপেক্ষে মামলা ও গ্রেফতার করা হবে।

রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মো. মোশারফ হোসেন খান জানিয়েছেন, ১৪৪ ধারা জারির পর পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তিনি সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শনিবার রাঙামাটিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.), স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা সকাল ১১টায় জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করবেন।

Source link

Related posts

দাবির পরও মেলেনি জেলেদের প্রত্যাশিত বরাদ্দ

News Desk

কালী পূজার ইতিহাস ও কাহিনি: শক্তির দেবীর পূজার রূপ ও প্রচলন

Sanjibon Das

এক জেলের জালে ধরা পড়লো ৯৬ মণ ইলিশ, ৪০ লাখে বিক্রি

News Desk

Leave a Comment