ইতিহাসে অনন্য এক সমরনায়ক এবং রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিত জুলিয়াস সিজার। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ‘জুলাই’ মাসের নামটি তার স্মরণেই। সাধারণ মানুষ থেকে রোমান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়া এবং ক্লিওপেট্রার সঙ্গে প্রণয় ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ঘটনা।
প্রখ্যাত রোমান সেনাপতি ও শাসক জুলিয়াস সিজার রোমান রিপাবলিক নামক ছোট নগর রাষ্ট্র থেকে গড়ে তুলেছিল বিশাল রোমান প্রজাতন্ত্র। শক্তি, সাহস আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে জয় করে নিয়েছিলেন আশেপাশের বহু অঞ্চল আর সামরিক শক্তিতে হয়ে ওঠেন অদ্বিতীয়। তিনিই ছিলেন একমাত্র রোমান জেনারেল যিনি রোমান সাম্রাজ্য বিস্তৃত করেন ইংলিশ চ্যানেল ও রাইন নদী পর্যন্ত এবং শেষ পর্যন্ত তিনি ইংল্যান্ডেও অনুপ্রবেশ করেন। তবে এতো সাফল্য আর শক্তির অধিকারী হয়েও তাকে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৃত্যু বরণ করতে হয় তারই সিনেটরদের হাতে। চলুন জেনে নেয়া যাক জুলিয়াস সিজার এর জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে-
জুলিয়াস সিজারের জন্ম হয় একটি সম্ভান্ত পরিবারে। বলা হয় যে, জুলিয়াস সিজার ছিলেন রোমান পুরাণে উল্লেখিত প্রেমের দেবী ভেনাস ও ইউলাস এর পুত্র ট্রজান রাজকুমার ইনিয়াস (Aeneas) এর পুত্র ইয়্যোলাস (Iulus) এর বংশধর। রোম থেকে ২০ মাইল দক্ষিণে এ্যালবা লংগা নামক স্থানে সিজার পরিবারের বাসস্থান ছিলো। জুলিয়াস সিজারের জন্ম হয় ১২ই জুলাই (মতান্তরে ১৩ই জুলাই), খ্রিষ্টপূর্ব ১০০ অব্দে। সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয়া জুলিয়াস সিজারের পিতার নাম ছিলো গ্যাইয়াস জুলিয়াস সিজার (Gaius Julius Caesar) এবং তিনি ছিলেন প্রাচীন রোমের একজন ম্যাজিস্ট্রেট ও এশিয়া অঞ্চলের শাসক। তার মায়ের নাম ছিলো অউরেলিয়া কোট্টা (Aureliya Cotta) এবং তিনি একটি প্রতাপশালী পরিবার থেকে এসেছিলেন।
মিশর ও রোমান সংস্কার:
মিশরে বসে ক্লিওপেট্রা আশা করে থাকে যে সিজার তার পুত্র টলেমী সিজারকে পিতৃপরিচয় দিয়ে নিজের উত্তরাধিকারী মনোনীত করবে। কিন্তু সিজার তার প্রপৌত্র গ্যাইয়াস অক্টাভিয়াস থুরিনাসকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করেন। তবে সিজারের স্ত্রী ক্যালপুর্নিয়া থাকা স্বত্বেও তিনি ক্লিওপেট্রা ও তার পুত্রকে রোমে নিয়ে আসেন, তাদেরকে আলাদা বাড়িতে রাখেন এবং প্রায়ই তাদেরকে দেখতে যেতেন। এরই মধ্যে তিনি রোমে বিভিন্ন সংস্কার কাজে হাত দেন। তিনি দরিদ্রদের ভূমি পুনর্বন্টন করেন, পুলিশ বাহিনী তৈরি করেন, ঐতিহাসিক কারথ্যাজ নগরী পুনর্নির্মাণ করেন, ট্যাক্স সিস্টেম তুলে দেন। তিনি প্রায় সময়ই সিনেটদের মতামতের তোয়াক্কা না করেই কোনো আইন প্রয়োগ বা পরিবর্তন করে ফেলতেন। ধীরে ধীরে সিজার আরও শক্তিশালী হতে থাকে । ফলে সিনেট এবং বিরোধী দলীয়রা বুঝতে পারে যে এভাবে চলতে থাকলে সিজার একসময় সিনেট বাতিল করে নিজেই সম্রাট বা রাজা হিসেবে এককভাবে শাসন করতে শুরু করবে।
জুলিয়াস সিজারের মৃত্যু:
৪৪ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের ১৫ মার্চ। এই দিনটি ছিল রোম সাম্রাজ্যের বিশেষ একটি দিন। রোমান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এই দিনে নববর্ষ পালন করা হতো। উৎসবে মেতে উঠত সাধারণ প্রজা থেকে শুরু করে অভিজাত শ্রেণি। এই দিনটিতে ধর্মীয় অনেক আচারও পালন করা হতো। দেবতা জুপিটারের উদ্দেশে এই দিনে ভেড়াসহ অনেক সামগ্রী উৎসর্গ করা হতো।বিশেষ ওই দিনটিতে সিজার যখন সিনেটে প্রবেশ করেন, তাকে দেখে সিনেটররা সম্মান জানানোর জন্য উঠে দাঁড়ান। যারা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারা দাঁড়িয়েছিলেন সিজারের কাছাকাছি। সিজারকে তারা সম্রাট হিসেবে চায়নি, তারা চেয়েছিল রোম হবে প্রজাতন্ত্র। আর তাদের কান ভাঙাতে শুরু করে ক্যাসিয়াস, যে কি না হাত মিলিয়েছিল সিজারের শত্রু পম্পির সাথে। ক্যাসিয়াস ষড়যন্ত্র করে সিজারকে হত্যা করার, এবং ভুল বুঝিয়ে সে দলে টানে সিজারের ঘনিষ্ট বন্ধু ব্রুটাসকে।
ব্রুটাস কিন্তু চায়নি সিজারকে হত্যা করতে, কিন্তু তাকে বোঝানো হয়েছিল সিজার সম্রাট হয়ে রোমের প্রজাতন্ত্রকে চিরতরে ধ্বংস করে দেবেন। আর তাই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একপর্যায়ে ব্রুটাসও শামিল হয় ক্যাসিয়াসের ষড়যন্ত্রে। এক গণৎকার সিজারকে সাবধান করে দিয়েছিলেন ইডস অফ মার্চের (রোমান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মার্চ মাসের ১৫ তারিখ, যে দিনটি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালিত হতো, এবং পুরনো দেনাপাওনা চুকানোর দিন হিসেবে পরিচিত ছিল) দিনটা সাবধানে থাকতে। এমনকি তার নিজের স্ত্রী কালপুর্নিয়াও তাকে বাধা দিয়েছিল। কিন্তু সবার নিষেধ অগ্রাহ্য করে তিনি ইডস অফ মার্চে সিনেটে হাজির হন, এবং সেখানে তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়।
ষড়যন্ত্রকারীরা সকলে মিলে মোট ২৩ বার সিজারকে আঘাত করে। এর মধ্যে সর্বশেষ আঘাতকারী ছিল ব্রুটাস। ব্রুটাস আক্রমণের আগপর্যন্ত সিজার পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করলেও, ব্রুটাসকেও তার হত্যাকারীদের শিবিরে দেখে তিনি হার মেনে নেন, এবং সেই বিখ্যাত কথাটি বলেন, “Et tu, Brute?” এবং শেষ করেন, “Then fall, Caesar!” বলে। ঘটনাস্থলে সিজারের মৃতদেহ পড়েছিল প্রায় ৩ ঘণ্টা। এরপর অন্য কর্মকর্তারা এসে তার লাশ সরিয়ে নেন। এই হত্যাকান্ডের পর কী ঘটবে সে উপলব্ধি ছিল না হত্যাকারীদের মধ্যে। সিজারের মৃত্যুর ফলে রোম প্রজাতন্ত্রের দ্রুত অবসান ঘটার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল।
ব্রুটাস ছিল সিজারের অবৈধ সন্তান:
অনেক ইতিহাসবিদেরই ধারণা, ব্রুটাসের মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিল সিজারের। স্বভাবতই, মায়ের সাথে কোনো পরপুরুষের সম্পর্কের গুজব বাজারে রটে থাকলে, সেই পুরুষকে কোনো পুত্রের পক্ষেই সহজভাবে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। তাই অনেকেরই বিশ্বাস, সিজারের প্রতি পূর্বের রাগ মেটাতেই হয়ত তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিল ব্রুটাস। এবং এই মতবাদের সূত্র ধরেই আসে পরের মতবাদটিও। কিছু কিছু ইতিহাসবিদ এমনকি এ কথাও মনে করেন, ব্রুটাসের জন্ম হয়তো সিজারের সাথে তার মায়ের অবৈধ সম্পর্কের ফলেই। এবং সিজার তার শেষ সংলাপে ব্রুটাসকে ‘পুত্র’ বলে অভিহিত করে সে ইঙ্গিতই দিয়ে যান।
এদিকে ব্যক্তিগত প্রতিশোধই যদি ব্রুটাসের মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে, এর স্বপক্ষেও আরেকটি জোরালো যুক্তি রয়েছে। কথিত আছে, সিজার নাকি ব্রুটাসকে এতটাই পছন্দ করতেন যে, নিজের মেয়ে জুলিয়ার বিয়েও তিনি ঠিক করেছিলেন ব্রুটাসের সাথে। কিন্তু পরে তিনি নিজের রাজনৈতিক অবস্থান জোরালো করতে জুলিয়ার বিয়ে দেন পম্পির সাথে। ব্রুটাস জুলিয়াকে ভালোবাসতো, তাই তাকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল সে, এবং মনের জ্বালা মেটাতে সিজারকে হত্যায় সম্মত হয়। তবে নাটকের কাহিনীর সাথে এ মতবাদ একেবারেই সাংঘর্ষিক। কারণ নাটকে আমরা দেখেছি শুরুতে সিজারকে মারার ব্যাপারে তার অসম্মতি ও পুরো নাটকজুড়ে চলা তার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব।
ব্রুটাসের প্রতি সিজারের অভিশাপ কিংবা সাবধানবাণী:
কিছু কিছু ইতিহাসবিদ আবার এমনটিও মনে করেন, শেষোক্ত তিনটি শব্দ ছিল আসলে ব্রুটাসের প্রতি সিজারের অভিশাপ বা সাবধানবাণী। কীভাবে? তাদের মতে, পুরো বাক্যটি শেষ করে যেতে পারেননি সিজার। তিনি মূলত বলতে চেয়েছিলেন, “You too, my son, will have a taste of power.” (তোমাকেও, আমার পুত্র, একদিন ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করতে হবে) এখানে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ বলতে সিজার বোঝাতে চেয়েছিলেন, ব্রুটাসও একদিন ক্ষমতা লাভ করবে, কিন্তু তারপর তাকেও এভাবেই নৃশংসভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে।
শেষ কথা:
সিজার আসলেই শব্দ তিনটি উচ্চারণ করেছিলেন কি না, এবং করলেও তিনি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন, সে প্রসঙ্গে বিতর্ক চলতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। তবে একটি বিষয় কিন্তু নিঃসকোচে বলে দেয়া যায় যে বর্তমান সময়ে শব্দত্রয়ী পরিণত হয়েছে বিশ্বাসঘাতকের প্রতি ছুঁড়ে দেয়া অন্যতম অনুমেয় উক্তিতে। নিত্যদিনের ওঠাবসায়, কিংবা বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস, নাটক-সিনেমায় রেফারেন্স আকারে নানাভাবে আসে এই শব্দত্রয়ী। প্রিয়জন বা বিশ্বাসভাজন কারও দ্বারা ক্ষতির শিকার হওয়ার পর আমাদের মাথায় প্রথম এই শব্দগুলোই আসে। এবং একই সমান্তরালে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আমরা মীর জাফরের মতো ব্রুটাসকেও কল্পনা করে নিই।
কিন্তু আসলেই কি ব্রুটাস আর মীর জাফরকে এক পাল্লায় মাপা উচিত? নাকি ব্রুটাস ছিল প্রকৃতপক্ষেই একজন ‘সম্মানিত ব্যক্তি’? যারা ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকটি দেখেছেন বা পড়েছেন, তারা তো এর উত্তর জানেনই। আর যারা দেখেননি, তারা আর দেরি না করে দেখে বা পড়ে ফেলতে পারেন শত শত বছর ধরে সাহিত্যাকাশে ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করতে থাকা এই নাটকটি। পাশাপাশি আগ্রহী দর্শকরা দেখতে পারেন এই নাটকের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে নির্মিত বিভিন্ন মুভি এডাপ্টেশানও।
তথ্য সূত্র: ইতিবৃত্ত, উইকিপিডিয়া, বাংলদেশ প্রতিদিন , ওয়ার বলেটন কাউন্সিল ।