নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বা নাপোলেওঁ বোনাপার্ত (ফরাসি: Napoléon Bonaparte; ১৫ই আগস্ট ১৭৬৯ – ৫ই মে ১৮২১) ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের সময়কার একজন জেনারেল। তিনি ফরাসি প্রজাতন্ত্রের প্রথম কনসাল (First Consul) ছিলেন। তিনি নেপলীয় ১ নামে ১৮ মে ১৮০৪ থেকে ৬ এপ্রিল ১৮১৪ পর্যন্ত ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন এবং পুনরায় ১৮১৫ সালের ২০ মার্চ থেকে ২২ জুন পর্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন। তিনি ইতালির রাজাও ছিলেন। এছাড়া তিনি সুইস কনফেডারেশনের মধ্যস্থাকারী এবং কনফেডারেশন অফ রাইনের রক্ষকও ছিলেন।
তার নেতৃত্বে ফরাসি সেনাবাহিনী এক দশকের বেশি সময় ধরে সকল ইউরোপীয় শক্তির সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং তিনি ইউরোপের অধিকাংশ অঞ্চল তার আয়ত্তে নিয়ে আসেন। ১৮১২ সালে সংগঠিত বিপর্যয়কারী রাশিয়া আগ্রাসন একটি যুগঃসন্ধিক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। রাশিয়া আগ্রাসন এবং ১৮১৩ সালে লিপজিগে পরাজয়ের পর ষষ্ঠ কোয়ালিশন ফ্রান্সে আগ্রাসন চালায় এবং এর ফলস্বরূপ নাপলেয়ঁ ১৮১৪-এর এপ্রিলে পশ্চাৎপসারণ করতে বাধ্য হন। কিছুদিন পরেই নাপলেয়ঁ একটি অভিযান চালান যা হান্ড্রেড ডেস নামে পরিচিত। কিন্তু নাপলেয়ঁ ১৮১৫ সালের ১৮ জুন ওয়াটারলুতে পরাজিত হন। নেপলীয় তার জীবনের বাকি ছ’ বছর ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপ সেন্ট হেলেনাতে কাটান।
নেপলীয় বোনাপার্ত সেনাবাহিনীতে কিছু পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি মিশরে মুখোমুখি সংঘর্ষের উপযোগী সেনাবাহিনী নিয়োগ ছাড়াও যুদ্ধজাহাজের কামান নিয়ন্ত্রণের জন্য গোলন্দাজ বাহিনী স্থাপন করেন এবং সকল বিভাগে আদর্শ সেনাবাহিনী গড়ে তু্লেন। তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে সেরা ধারণাগুলো বেছে নিয়ে অসাধারণ একটি বাহিনী প্রস্তুত করেন, যেটি তাকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু যুদ্ধে জয় এনে দেয়। সেনাবাহিনীতে তার উদ্ভাবন সমূহ বর্তমানে প্রায় সকল সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তিনি সারা বিশ্বে সর্বকালের অন্যতম সেরা সেনাপতি হিসেবে সুপরিচিত। নেপোলিয়ন কোড প্রতিষ্ঠাও তার অন্যতম সেরা কীর্তি। তিনি একটি ফ্রাঙ্কো-ফার্সি জোট গঠন করেন এবং দক্ষিণ ভারতের শাসক টিপু সুলতানের সাথে ফ্রাঙ্কো-ইন্ডিয়ান জোটের একটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সময় ফ্রেঞ্চ প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী সরবরাহ করেছিলেন, ব্রিটিশদের আক্রমণের জন্য উন্মুক্ত পথ উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে তার ক্রমাগত লক্ষ্য ছিল।
তিনি তার পরিবারের সদস্যদের এবং বন্ধুদের তার অর্জিত বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসক এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন। যদিও তাদের শাসন নাপলেয়ঁর পতন ঠেকাতে পারেনি, নেপলীয়র এক ভাতিজা, তৃতীয় নেপোলিয়ন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফ্রান্স শাসন করেন।
প্রথম জীবন:
নাপোলেওঁ দ্য বোনাপার্ত ১৭৬৯ সালের ১৫ আগস্ট ফ্রান্সের কর্সিকা দ্বীপের আজাক্সিও শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের মাত্র একবছর আগে দ্বীপটি জেনোয়া প্রজাতন্ত্র কর্তৃক ফ্রান্সকে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি নেপোলিয়ন বোনাপার্ট নামেই অধিক পরিচিতি লাভ করেন। বোনাপার্ট পরিবার মূলত লুনিজিয়ানায় বসতি স্থাপনকারী লোম্বার্ড বংশোদ্ভূত তুস্কান গোত্রের অন্তর্ভুক্ত, যারা ইতালির একটি অভিজাত সম্প্রদায় হিসেবে বিবেচিত হতেন। পরিবারটি ফ্লোরেন্সে গমন করে এবং দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে অধিক গ্রহণযোগ্য, বোনাপার্ট-সারজানা, ফ্রান্স ত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং ১৬শ শতাব্দীতে তৎকালীন জেনোয়া প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত দ্বীপ করসিকাতে আগমন করেন।
তার পিতা, কার্লো বোনাপার্ট ১৭৪৬ সালে জেনোয়া প্রজাতন্ত্রে জন্মগ্রহণ করেন। নেপোলিয়নের মা, মারিয়া লেটিজিয়া রামোলিনো তার বাল্যকালে গভীর প্রভাব ফেলেন।
নেপোলিয়নের বড় ভাই ছিলেন জোসেফ বোনাপার্ট। নেপোলিয়ন ছিলেন দ্বিতীয়। তার অনুজরা ছিলেন- লুসিয়েন বোনাপার্ট, এলিসা বোনাপার্ট, লুই বোনাপার্ট, পউলিন বোনাপার্ট, ক্যারোলিন বোনাপার্ট এবং জেরোমি বোনাপার্ট।
পারিবারিক কারণে নেপোলিয়ন ছোটবেলা থেকেই অন্যান্য সাধারণ কর্সিকানদের তুলনায় শিক্ষার্জনে অধিক সুবিধা লাভ করেছিলেন। ১৭৭৯ সালের ১৫ মে, নেপোলিয়নের বয়স যখন মাত্র নয়, তখন তাকে ট্রয়েস্রের নিকটবর্তী ছোট্ট শহর Brienne-le-Château -e অবস্থিত একটি ফরাসি মিলিটারী স্কুলে ভর্তি করানো হয়। বিদ্যালয়ে ভর্তির আগে তাকে ফরাসি ভাষা শিখতে হয়েছিল। কিন্তু নেপোলিয়ান সারাজীবনই ইতালীয় টানে কথা বলেছেন এবং তিনি কখনো ঠিকমত বানান করা শিখতে পারেন নি। প্রচলিত আছে যে, নেপোলিয়নের প্রথম দেখা হয় শ্যাম্পেন প্রস্তুতকারক Jean-Remy Moët-এর সাথে। এই দুজনের বন্ধুত্ব শ্যাম্পেন এবং শ্যাম্পেন প্রস্তুতকারক এলাকার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ব্রিয়েনের ডিগ্রী পাওয়ার পর নেপোলিয়ন ১৭৮৪ সালে প্যারিসের এলিট École Royale Militaire-এ ভর্তি হন। সেখানে তিনি মাত্র এক বছরেই দুই বছরের কোর্স সমাপ্ত করেন। একজন পরীক্ষক তার সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন- ” বিমূর্ত বিজ্ঞানের জন্য নিবেদিত প্রাণ, অন্যান্য বিষয়ে কিছুটা আগ্রহশীল; গণিত এবং ভূগোলে ভালো জ্ঞান রয়েছে। তিনি প্রথমে নৌবাহিনী বিষয়ে আগ্রহী হলেও École Militaire-তে “আর্টিলারী” নিয়ে পড়াশোনা করেন।
সেনাজীবনের সূচনা:
1786 সালে ডিগ্রী লাভ করে নেপোলিয়ন সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট পদে ভূষিত হন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র সতেরো । ১৭৮৯ সালের বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত নেপোলিয়ন ভ্যালেন্স এবং এক্সনে সেনারক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী অধিকাংশ বছর তিনি করসিকাতে অতিবাহিত করেন। তখন সেখানে রাজবংশীয়-বিদ্রোহী-সাধারণ কর্সিকানদের মধ্যে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব চলছিল। নেপোলিয়ন জ্যাকোবিনের ফ্যাকশনকে সমর্থন করেন এবং লেফট্যানেন্ট কর্ণেল পদে ভূষিত হন। রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী নেতা প্যাস্কোয়েল প্যাইলির ক্রমবর্ধমান সহিংসতার কারণে বোনাপার্ট এবং তার পরিবার ১৭৯৩ এর জুনে ফ্রান্সে যেতে বাধ্য হন। তার কর্সিকান সহচরীদের সহযোগিতায় নেপোলিয়ন গোলন্দাজ সেনাপতি নির্বাচিত হন এবং টাউলন দখল করেন। টাউলনের উত্থান হয়েছিল প্রজাতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ফলে এবং এটি ব্রিটিশরা দখল করে নিয়েছিল। তিনি বিচক্ষণ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি l’Eguillete কেন্দ্রে সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ করেন, যা পোতাশ্রয়ে ব্রিটিশ জাহাজের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় এবং তারা পোতাশ্রয় ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পরবর্তী একটি সফল আক্রমণে নেপোলিয়ন উরুতে আঘাতপ্রাপ্ত হন কিন্তু অসাধারণ কৃতিত্ব তাকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের পদ এনে দেয়। তার সাফল্য কমিটি অফ পাবলিক সেফটির দৃষ্টিগোচর হয় এবং তিনি বিদ্রোহী নেতা ম্যাক্সিমিলিয়েন রবেসপিয়েরের অনুজ অগাস্টিন রবেস্পিয়েরের একান্ত সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এর ফলস্বরূপ, বড় রবেস্পিয়েরের পতনের পর ১৭৯৪ সালের ৬ আগস্ট কারাগার বন্দী হন কিন্তু দুই সপ্তাহ পরই নেপোলিয়ন ছাড়া পান।
হুইফ অফ গ্রেপশট:
১৭৯৫ সালের ৩ অক্টোবর রাজপক্ষীয়রা এবং বিদ্রোহের বিরোধীরা জাতীয় কনভেনশনের বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলে। নেপোলিয়নকে টুইলারিস(Tuileries) প্রাসাদে প্রতিষ্ঠিত কনভেনশনের রক্ষায় গঠিত বাহিনীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি জোয়েচিম মুরাট (Joachim Murat) নামক একজন তরুণ কর্মকর্তাকে নিয়ে গোলন্দাজ বাহিনীর বিভিন্ন অংশকে একত্র করেন। তিনি এই বাহিনীকে আক্রমনকারীদের বিরুদ্ধে নিয়োগ করেন। তিনি পরে একে এভাবে ব্যাখা করেন যে তিনি হুইফ অফ গ্রেপশট-এর মাধ্যমে পথ পরিষ্কার করেছেন। এই সঘর্ষ সমগ্র ফ্রান্সেই বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ অসাধারণ বিজয় তাকে অনেক খ্যাতি এনে দেয়। তিনি নতুন ডিরেক্টরির নেতা বারাসের (barras) সমর্থন পান। কিছুদিন পরেই তিনি বারাসের প্রাক্তন স্ত্রী জোসেফাইন দ্য ব্যুহ্যারানাইস (Josephine de Beauharnais)। পরবর্তীতে তিনি ১৭৯৬ সালের ৯ মার্চ জোসেফাইনকে বিবাহ করেন।
ইতালিতে সামরিক তৎপরতা (১৭৯৬-৯৭):
বিয়ের পরেই ১৭৯৬ সালের ২৭ মার্চ নেপোলিয়ন ফরাসি আর্মি অফ ইতালির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সফলতার সাথে ইতালি আক্রমণ করেন। লোডিতে(Lodi) তিনি দি লিট্ল করপোরাল(le petit caporal) উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি তার প্রায় সমস্ত সৈন্যকে খুব ভালোভাবে চিনতেন। তা থেকে ধারণা করা যায় সতীর্থদের সাথে তার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কথা। তিনি লোম্বার্ডি থেকে অস্ট্রিয়ানদের বিতাড়িত করেন এবং পাপাল প্রদেশের(Papal States) সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। এর কারণ ছিল, পোপ পিউস ৬(Pope Pius VI) কর্তৃক লুইস ১৬ (Louis XVI) এর কর্মকান্ডের প্রতিরোধ, ফ্রান্স কর্তৃক দুটি ক্ষুদ্র পাপাল ভূখন্ডের দখল। নেপোলিয়ন ইতালি আক্রমণ এবং পোপকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ডিরেক্টরির আদেশ অগ্রাহ্য করেন। অবশ্য পরের বছরই জেনারেল বার্থিয়ের(General Berthier) ইতালি দখল করে নেন এবং ফেব্রুয়ারির বিশ তারিখ পোপকে বন্দী করেন। সেখানেই শারীরিক অসুস্থতার কারণে পোপ মৃত্যুবরণ করেন। ১৭৯৭ সালের শুরুতেই নেপোলিয়ন তার সেনাবাহিনী নিয়ে অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করেন এবং তার শক্তিকে শান্তির জন্য কাজে লাগান। কিছুদিনের মধ্যেই ফ্রান্স উত্তর ইতালির অধিকাংশই দখল করে নেয়। নিচুদেশসমূহ এবং রাইনল্যান্ডও ফ্রান্সের অধিকারে আসে। কিন্তু তখনো ফ্রান্স ভেনিস অধিকার করতে পারেনি। নেপোলিয়ন এরপর ভেনিসে গমন করেন এবং ভেনিস আত্নসমর্পন করতে বাধ্য হয়। এভাবে এক সহস্র বছরের স্বাধীন ভেনিসের পতন হয়। পরবর্তীতে ১৭৯৭ সালেই নেপোলিয়ন ইতালির ফ্রান্স শাসিত রাজ্যসমূহ নিয়ে সিজালপাইন রিপাবলিক (Cisalpine Republic) গড়ে তুলেন।
নেপোলিয়নের সামরিক তৎপরতাসমূহ তার বাস্তবক্ষেত্রে সামরিক শক্তি প্রয়োগের অসীম জ্ঞানেরই প্রতিফলন ঘটায়। নেপোলিয়নের ভাষায়ঃ
“ আমি ষাটটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, কিন্তু আমি এমন কিছু শিখিনি যা আমি শুরুতে জানতাম না। ”
মিশরে সামরিক তৎপরতা (১৭৯৮-৯৯):
১৭৯৮ সালের মার্চে বোনাপার্ট মিশর দখলের জন্য সামরিক অভিযান প্রস্তাব করেন। তখন উসমানীয় সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ কখন আক্রমণ করতে হবে সেটা সম্পর্কে নেপোলিয়নের অবিশ্বাস্য রকম কল্পনা শক্তি ছিল। নেপোলইয়ন প্রায়সময় গুপ্তচর নিয়োগ করে শত্রুপক্ষের গোপন খবর রাখতেন এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট কি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন?
নেপোলিয়নের প্রখ্যাত উক্তি তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব।
দিগ্বিজয়ী এ মহাবীরের এরকম আরো বহু কথা ইতিহাস বরাবরই আলাদা করে স্মরণ করে। স্মরণ করে তার বীরত্ব, প্রজ্ঞা ও বাহাদুরি। তবে কোন এক অজানা কারণে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ইসলাম গ্রহণের অধ্যায়টিকে সবসময়ই এড়িয়ে চলে ইতিহাস।
মহাবীর নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ১৭৯৮ সালে কায়রোর জামে আজহার মসজিদে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে জোরালো মত রয়েছে।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ উপলক্ষে তিনি যে বাণী প্রচার করেন তার দলিল কায়রোর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে এখনও রক্ষিত আছে। তৎকালীন বিশেষ ব্যক্তিদের ডায়েরীতে তার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সত্যতা পাওয়া যায়।
La Cases নামক একজন- নেপোলিয়নের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তিনি তার ডায়েরীতে নেপোলিয়নের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে, সেন্ট হেলেনায় নির্বাসিত হিসেবে অবস্থানকালে জেনারেল গরগারডের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় নেপোলিয়ান বলেছিলেন, ‘আমি মুহাম্মদীয় ধর্মটাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। এতে অল্প হলেও কিছু জিনিস আছে যা আমাদের ধর্মের থেকে অধিক শক্তিশালী।
তিনি আরও বলেন, সব ধর্মের মাঝে মুহাম্মদীয় ধর্ম সবচেয়ে উত্তম।
বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো, ১৭৯৮ খৃস্টাব্দে নেপোলিয়ন মিসর আক্রমণ করতে গিয়ে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েই ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি এক বছর মিসরে থাকেন।
সে সময় ১৭৯৮ খৃস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর বহুল প্রচারিত ফরাসি পত্রিকা Gazzette National ou Le Moniteur Universel এ প্রকাশিত সংবাদেও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং তার নাম পরিবর্তন করে আলী নেপোলিয়ন রাখেন বলে খবর বের হয়।
তৎকালীন মিসরের শীর্ষ আলেমদের সান্নিধ্যে এসে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে তিনি পরিপূর্ণ অবগতি লাভ করেন এবং ইসলামী শরীয়তের আলোকে সমাজ ও জীবনের বিধিমালা প্রণয়নের জন্য মতামত ব্যক্ত করেন।
মিসরে অবস্থানের সময় মিলাদুন্নবীর দিন ফরাসি সৈন্যবাহিনীর মাধ্যমে কায়রোর রাজপথে বিশেষ প্যারেডের আয়োজন করে রাসূলের (সা.) প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটান।
তিনি মিসরের গ্র্যান্ড মুফতিকে চিঠি লেখেন, আমি সব জ্ঞানীদের সঙ্গে নিয়ে কোরআনের নীতিমালার আলোকে একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চাই।
তিনি আরো লেখেন, একমাত্র কোরআনের আইন ও শাসনের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ।
আমেরিকান ঐতিহাসিক Juan Cole তার গ্রন্থ Napoleon’s Egypt: Invading the Middle East এ লেখেন, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট রাসূলের (সা.) জীবনাদর্শে খুব বেশি প্রভাবিত ছিলেন। তার মতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
কোরআন ও রাসূলের (সা.) জীবনী অধ্যয়নের পর তার দৃষ্টিভঙ্গীতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এছাড়াও আরো বহু সূত্রে একথা বলা যায় যে, ইসলাম ও রাসূল সা. এর প্রতি নেপোলিয়নের ছিল বিশেষ ভালবাসা ও বিশ্বাস।
জীবনের শেষ সময়গুলোতে তিনি ইসলামের নির্দেশিত পথে নিজেকে পরিচালিত করতেন। অবশ্য গির্জার সঙ্গে দ্বন্দ্বে যাবেন না বলে তিনি অনেক কিছুই প্রকাশ্যে করতেন না।
ইসলামের প্রতি তার বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার কারণে তৎকালিন মিসরের আলেমরা তাকে মহাসম্রাট উপাধিতে ভূষিত করেন।
পরবর্তীতে ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম, জার্মানি ইত্যাদি দেশে তিনি নেপোলিয়ন কোড বা আইন বিধির যে প্রবর্তন করেন তার অনেকগুলো ধারা ছিলো ইসলামি শিক্ষা ও সভ্যতা থেকে সংকলন করা।
দিগ্বিজয়ী নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উত্থান পতন:
ইতিহাসের বিখ্যাত কয়েকজন দিগ্বিজয়ীর নাম বলতে গেলে অবশ্যই শুরুতে একজনের নাম চলে আসবে যিনি নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। অ্যালেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের পরেই যার নাম। শূন্য থেকে শুরু হয়ে সম্রাট হওয়া, রহস্যময় ঘটনার সম্মুখীন হওয়া এবং সম্রাট-জীবন থেকে এক নির্জন দ্বীপে নির্বাসিত হয়ে মারা যাওয়া- এ সবই নেপোলিয়নের জীবনেরই ঘটনা। এ লেখাটি তাঁকে নিয়েই। যদিও ছোট একটি লেখায় সংক্ষিপ্তভাবে নেপোলিয়নের জীবনী আঁটানো সম্ভবপর না, তাও একটি ছোট প্রচেষ্টা।
১৭৮৫ তে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলেন নেপোলিয়ন, আর্মিতে হলেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। ফ্রেঞ্চ রেভুলশন যখন চলছিল সে সময় তিনি ছিলেন প্যারিসে। ১৭৯২-তে হয়ে গেলেন আর্মির ক্যাপ্টেন। পরের ছয় বছরে আর্মির হয়ে অনেক অভিযানেই অংশ নেন তিনি। তার যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজির কারণে তিনি বিখ্যাত হন। তবে এর মাঝে তিনি একবার গৃহবন্দিও হয়েছিলেন। আবার স্পাই-এর কাজও করেছিলেন!
১৭৯৮-তে ফ্রেঞ্চ আর্মির লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশদের পরাজিত করা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা ধ্বংস করা, পারলে টিপু সুলতানকে হাত করে ব্রিটিশদের হারানো যেতে পারে। তবে এর মাঝে তার মিশর ভ্রমণের ইচ্ছা জাগল এই গুরুত্বপূর্ণ অভিযানের আগে। বিশেষ করে পিরামিড দর্শন। তিনি অনেকজন অভিজ্ঞ, বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, পরিব্রাজক নিয়ে আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে কায়রোর দিকে যান। সাথে তার বাহিনী।
মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে তার আর্মিকে আক্রমণ করে মিসরের মামলুক বাহিনী মুরাদ আর ইব্রাহিম এর নেতৃত্বে। ফ্রেঞ্চ আর্মি যুদ্ধে জিতে যায়। এ যুদ্ধের নাম ছিল ব্যাটল অফ পিরামিড।
তারা পিরামিডের কাছে পৌঁছে যান। রহস্যময় স্ফিংক্স দর্শনের পরে নেপোলিয়ন তাদের বললেন, “আমাকে একা থাকতে দাও। আমি একাই থাকব ভিতরে। তোমরা যাও। বাইরে থাকো।”
ফারাও খুফু এই পিরামিড বানিয়েছিলেন সেই কত হাজার বছর আগে, নিজের কবর হিসেবে। কিন্তু কী কারণে তার কবর এখানে দেয়া হল না সেটা জানা নেই। নেপোলিয়ন জানেন, কিংস চেম্বারের পাশেই আছে কুইন্স চেম্বার। তবে সেটা বেশি আকর্ষণীয় না। পিরামিডের ভেতরে কিংস চেম্বারে পৌঁছে তিনি বসে পড়লেন।
বাইরে বসে গল্প করছিল যে কজন সৈন্য রয়ে গিয়েছিল পিরামিডের বাইরে। সাথে নেপোলিয়নের কাছের কয়েকজন। হাসি তামাশা চলছিল।
সাত ঘণ্টা পর হঠাৎ একজন সৈনিক পিরামিডের দিকে আঙ্গুল তুলে চিৎকার করে উঠল, “দেখ!” মশালের আলোতে একটা কালো আকৃতিকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। একটু কিছু দূর দৌড়ালো, এরপর আবার বসে পড়ল, আবার উঠে দৌড়, এরপর আবার পড়ে গেল মাটিতে। আর আগাতে পারল না। মশাল নিয়ে কিছুদুর আগাতেই, সে চিনে ফেলল, নেপোলিয়ন ছাড়া কেউ না তিনি।
যে কজন সেখানে ছিল, সবাই ছুটে গেল। পানি খাওয়াল তাকে। থরথর করে কাঁপছেন নেপোলিয়ন। কথা বলছেন জড়িয়ে জড়িয়ে, “আমি হারবো… আমি হারবো… সময় কম।”
সে রাতে আর কিছু করা হলো না। নেপোলিয়নকে সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুলতেই কয়েকদিন চলে গেল। মাঝে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “আপনি কী দেখেছিলেন ভেতরে?” তিনি উত্তর দেন, “এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলব না। আর কোনোদিন জিজ্ঞেস করবে না এটা নিয়ে।” একদম একই রকম ঘটনার সম্মুখীন অ্যালেক্সান্ডার দ্য গ্রেটও হয়েছিলেন!
১০ দিন পর নেপোলিয়ন জীবনের প্রথম কোনো যুদ্ধে হেরে গেলেন। নীল নদের যুদ্ধে ব্রিটিশ নেভির অ্যাডমিরাল নিলসনের নেতৃত্বে করা আক্রমণে নেপোলিয়নের ব্রিটিশ রাজ্য বিজয়ের স্বপ্ন চির ধূলিস্মাৎ হয়ে গেল।
কী পরিবর্তন হলো নেপোলিয়নের কেউ জানেন না। এ ঘটনাটাতে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যদিও। কিন্তু এ ঘটনার সত্যতা কি আসলেই নেই?
ফ্রান্সে ফিরেই তিনি ক্যু (coup) করলেন আর নিজে সর্বাধিনায়ক হয়ে গেলেন। কয়েক বছর পর নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট বলে ঘোষণা দিলেন। তার আগের সেই যুদ্ধের জাদু আর নেই। আশপাশের কিছু দেশ আক্রমণ করে ভাল একটা অবস্থান পেয়ে গেল ফ্রান্স ইউরোপে।
নেপোলিয়ন সিদ্ধান্ত নিলেন রাশিয়া আক্রমণ করবেন, তাঁর পুরনো সেই কারিশমা ফিরিয়ে আনবেন। ১৮১২-তে তিনি রাশিয়া আক্রমণ করলেন এবং খুব বাজেভাবে পরাজিত হলেন। পরের বছর খোদ তার নিজের দেশ ফ্রান্সই আক্রান্ত হল! তার আর্মি এত বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে ফ্রান্স রক্ষার মতো শক্তি ছিল না। অস্ট্রিয়া, প্রুসিয়া, রাশিয়া, ব্রিটেন, পর্তুগাল, সুইডেন, স্পেন, জার্মান রাজ্যগুলো সব একসাথে ফ্রান্স আক্রমণ করে।
তার সময় শেষ হয়ে আসে, ফ্রান্স পরাজিত হয়। নেপোলিয়নের ভাগ্য হয় নির্বাসন। ইতালির কাছে এলবা দ্বীপে তিনি নির্বাসিত হলেন। অনেক চেষ্টা করে তিনি পালিয়ে যান, ১০ মাস পর।
আবার ক্ষমতা দখল করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে ইতিহাসের কুখ্যাত কিংবা বিখ্যাত ওয়াটারলু যুদ্ধে হেরে যান। ১৮১৫ সালের ১৮ জুন রবিবার ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হয়েছিল বেলজিয়ামের ওয়াটারলুর কাছে। নেপোলিয়ন এই যুদ্ধে দুইটি সম্মিলিত শক্তি, ওয়েলিংটনের ডিউকের অধীন ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এবং গাবার্ড ভন বুচারের অধীনে প্রুশিয়ান সেনাবাহিনীর নিকট পরাজিত হন। এই দু’ বাহিনী নেপোলিয়নের শত্রু ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সাতটি বাহিনীর সম্মিলনে গড়ে ওঠা মিত্র বাহিনীর কেবল দুটো ফোর্স ছিল। এ যুদ্ধে হারার সাত দিনের মাথায় ক্ষমতা ছেড়ে দেন নেপোলিয়ন।
মৃত্যু রহস্য :
নেপোলিয়ন ছিলেন একজন বলদর্পী মানুষ। শৌর্যবীর্য বিবেচনায় তার সাথে শুধু তুলনা চলে মহাবীর আলেক্সান্ডারের কিংবা জুলিয়াস সিজারের। এমনটি কি ভাবা যায়, তার মতো একজন শক্তিধর মানুষ একদম গতানুগতিক নীরসভাবে দক্ষিণ আটলান্টিকের এক পরিত্যক্ত দ্বীপে পাকস্থলীর ক্যান্সারে মারা গেছেন। বরং ওয়াটারলুর যুদ্ধেই তার মৃত্যু হওয়াটা ছিল স্বাভাবিক। কিংবা তিনি খুন হতে পারতেন কোনো ঈর্ষাপরায়ণ বিদ্রোহীর হাতে। শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণের চেয়ে শত্রুর তলোয়ারের নিচে জীবন দেয়াই ছিল তার জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা শুনছি, কার্যত দেড় দশকের মতো সময় বীরদর্পে ইউরোপ শাসন করে যাওয়া নেপোলিয়ন একটি পুরোপুরি সিক্ত আধা-সেঁকা অন্ধকার এক ঘরে নির্বাসিত অবস্থায় ধীরে ধীরে নিস্তেজ বিবর্ণ হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছেন। এরপর একসময় মারা গেছেন। অন্তত নেপোলিয়নের বেলায় এমনটি অভাবনীয়, সেই সাথে অকল্পনীয়।
আমরা ইতিহাসের মামুলি কোনো চরিত্র নিয়ে কথা বলছি না। বলছি তুখোড় সামরিক ব্যক্তিত্ব, স্বৈরশাসক, প্রশাসক ও আইনপ্রণেতা নেপোলিয়নের কথা। ফরাসি বিপ্লবের শেষপর্যায়ে তিনি ছিলেন একজন সামরিক ও রাজনৈতিক নেতা। প্রথম নেপোলিয়ন হিসেবে তিনি ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন ১৮০৪ সাল থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত। তার আইনি সংস্কার ‘নেপোলিয়নিক কোড’ বিশ্বব্যাপী দেওয়ানি আইনব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কিন্তু তিনি তার চেয়েও বিখ্যাত ছিলেন সেই সব যুদ্ধের জন্য, যেগুলো তিনি লড়েছিলেন কয়েকটি জোটের বিরুদ্ধে। এগুলো ইতিহাসে পরিচিত নেপোলিয়নের যুদ্ধ নামে। এসব যুদ্ধের মাধ্যমে নেপোলিয়ন ইউরোপের বেশির ভাগ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক ধরনের হেজেমনি তথা কর্তৃত্বপরায়ণতা।
নেপোলিয়নের জন্ম ভূমধ্যসাগরের দ্বীপ কর্সিকায়। দ্বীপটির বর্তমান অবস্থান পশ্চিম ইতালিতে, ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ-পূর্বে, ইতালির সার্বভৌম দ্বীপ সার্দিনিয়ার উত্তরে। নেপোলিয়ন অভিজাত ঘরের সন্তান। নেপোলিয়নের বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তার বাবা কার্লো বোনাপার্ট ছিলেন একজন অ্যাটর্নি। ১৭৭৭ সালে তাকে ফ্রান্সের ষোড়শ লুইয়ের কোর্টে কর্সিকার প্রতিনিধি ঘোষণা করা হয়। মা লেটিজিয়ার প্রভাবই বেশি ছিল নেপোলিয়নের ওপর। নেপোলিয়নের বড় ভাই জুসেফ। ছোট তিন ভাই যথাক্রমে লুসিন, লুই ও জেরোম। আর ছোট তিন বোন এলিসা, পলিন ও কেরোলিন। জোসেফের আগে তার এক ভাই ও এক বোনের জন্ম হয়েছিল। এরা মারা যান ছোটবেলায়।
নেপোলিয়নের প্রথম দিকের জীবন কাটে সামরিক কর্মকাণ্ডে এবং তার বিধ্বস্ত পরিবারের দেখাশোনার পেছনে। তার পরও তিনি সময় করে নিয়েছিলেন এক বুর্জোয়া তরুণী ডিজেরি ক্যারিকে ভালোবাসার। ক্যারির পরিবারের সিল্কের ব্যবসায় ছিল মার্সিলিসে। ক্যারির পরিবার ছিল এই বিয়ের বিরুদ্ধে। ফলে তাদের বিয়ে হয়নি। কয়েক বছর পর তার বিয়ে হয় নেপোলিয়নের এক মার্শালের সাথে, এবং জীবনাবসান ঘটে সুইডেনের রানী হিসেবে। এ দিকে নেপোলিয়ন জেনারেল হওয়ার পর ১৭৯৬ সালে বিয়ে করেন সুন্দরী জোসেফাইন ডি বিউহারনাইসকে। তখন জোসেফাইনের বয়স ২৬। কিন্তু তার গর্ভে কোনো পুত্রসন্তান হয়নি। নেপোলিয়ন প্রবলভাবে উত্তরাধিকার হিসেবে পুত্রসন্তান কামনা করেছিলেন। এ কারণে ১৮০৯ সালে জোসেফইনকে তালাক দেন। এবং ১৮১০ সালে বিয়ে করেন স্বর্ণকেশী তরুণী অস্ট্রিয়ার সম্রাটকন্যা মারিয়া লুইসাকে।
নেপোলিয়নের ছিল এক পুত্র : দ্বিতীয় নেপোলিয়ন। তার জন্ম ১৮১১ সালে। মাত্র ২১ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে তিনি মারা যান ১৮৩২ সালে। নেপোলিয়নের বৈধ কোনো কন্যা ছিল না। তবে তার প্রথম স্ত্রী জোসেফাইনের প্রথম স্বামীর ঘরের এক বৈপিত্রেয় কন্যা ছিল। তার নাম হরটেনসি। নেপোলিয়নের কিছু অবৈধ সন্তানও ছিল। এর মধ্যে দুই অবৈধ সন্তানের কথা তিনি স্বীকার করেছেন।
নেপোলিয়ন ফরাসি মূল ভূখণ্ডের আর্টিলারি অফিসার হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন প্রথম ফরাসি প্রজাতন্ত্রের সময়ে। তিনি সাফল্যের সাথে অভিযান চালান ফ্রান্স-বিরোধী প্রথম ও দ্বিতীয় কোয়ালিশনের বিরুদ্ধে। প্রথম কোয়ালিশনের যুদ্ধ চলে ১৭৯২-১৭৯৭ সময়ে। এ যুদ্ধসময়ে ইউরোপীয় দেশগুলো ব্যাপকভাবে উদ্যোগী হয় ফরাসি বিপ্লব সংযত করতে। ১৭৯২ সালের ২০ এপ্রিলে নেপোলিয়ন অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এর কয়েক সপ্তাহ পর প্রুশিয়া অস্ট্রিয়ার পক্ষে যোগ দেয়। এ সময় অস্ট্রিয়ার জোটে ছিল রোম সাম্রাজ্য, প্রুশিয়া, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স রয়েলিস্টস, স্পেন, পর্তুগাল, সার্দিনিয়া, নেপলস ও সিসিলি, অন্যান্য ইতালীয় রাজ্য, ওসমানীয় সাম্রাজ্য ও ওলন্দাজ প্রজাতন্ত্র। আর ফরাসি প্রজাতন্ত্রের জোটে ছিল ফ্র্যাঞ্চ স্যাটেলাইট স্টেটস ও পোলিশ সেনাবাহিনী। দ্বিতীয় কোয়ালিশনের যুদ্ধ চলে ১৭৯৮-১৮০২ সময়ে।
এ সময়ে অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার নেতৃত্বে ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ দ্বিতীয়বার উদ্যোগ নেন বিপ্লবী ফ্রান্সকে সংযত কিংবা অপসারণ করতে। এরা ফ্রান্সের পূর্ববর্তী সামরিক বিজয়কে ম্লান করে দিতে নয়া কোয়ালিশন গঠন করে। এ সময়ে এক জোটে ছিল অস্ট্রিয়া, গ্রেট ব্রিটেন, রাশিয়া, ফ্রান্স রয়েলিস্টস,পর্তুগাল, দুই সিসিলি ও ওসমানীয় সাম্রাজ্য। প্রতিপক্ষ জোটে ছিল ফরাসি প্রজাতন্ত্র, স্পেন, পোলিশ সেনাবাহিনী, ডেনমার্ক-নরওয়ে ফ্র্যাঞ্চ কায়েন্ট রিপাবলিক, বাটাভিয়ান প্রজাতন্ত্র, হেলভেটিক প্রজাতন্ত্র, সিসালপাইন প্রজাতন্ত্র, রোমান প্রজাতন্ত্র ও পার্থেনোপিয়ান প্রজাতন্ত্র।
সে যা-ই হোক, ১৭৯৯ সালে তিনি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন ফ্রান্সের ফার্স্ট কনসাল হিসেবে। এর পাঁচ বছর পর ১৮০৪ সালে ফ্রান্সের সিনেট তাকে সম্রাট ঘোষণা করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে নেপোলিয়নের সময় ফরাসি সাম্রাজ্য বেশ কিছু দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। নেপোলিয়নকে কয়েকটি যুদ্ধ করতে হয় ইউরোপের বড় বড় শক্তির সাথে। এগুলো ইতিহাসে নেপোলিয়নের যুদ্ধ নামে পরিচিত। একনাগাড়ে কয়েকটি যুদ্ধে জয়ের পর ফ্রান্স ইউরোপে প্রভাবশালী অবস্থানে উঠে আসে। এ সময় নেপোলিয়ন ব্যাপক জোট গড়ে তুলে বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের সদস্যদের নিয়োজিত করেন ইউরোপর দেশগুলোকে কায়েন্ট স্টেট হিসেবে শাসন করার জন্য। নেপোলিয়নের এই বিজয় অভিযান আজকের দিনেও গোটা দুনিয়ার মিলিটারি অ্যাকাডেমিগুলোতে পাঠের বিষয় করে তোলা হয়েছে।
১৮১২ সালে রাশিয়ার ফ্রান্সে অনুপ্রবেশের ঘটনা ইতিহাসে চিহ্নিত নেপোলিয়নের ভাগ্যের মোড় ঘুরে যাওয়ার ঘটনা হিসেবে। রাশিয়ার এ অভিযানে তার গ্রেট আর্মি বা গ্র্যান্ড আর্মি ভয়াবহভাবে বিধ্বস্ত হয়, যার পুনর্গঠন তার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। ১৮১৩ সালে ষষ্ঠ কোয়ালিশন লিপজিগে তার বাহিনীকে পরাজিত করে। পরের বছর এই কোয়ালিশন ফ্রান্সে ঢুকে পড়ে এবং নেপোলিয়নকে সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য করে। সেই সাথে তাকে নির্বাসন দেয়া হয় ইতালির ভূমধ্যসাগর তীরের এলবা দ্বীপে। এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এলবা দ্বীপ থেকে পালিয়ে গিয়ে আবার তিনি ক্ষমতায় ফিরে আসেন। কিন্তু ১৮১৫ সালের জুনে ওয়াটারলোর যুদ্ধে পরাজিত হন। ব্রিটিশরা সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনে পাঠিয়ে তাকে আটকে রাখে। সেখানে তিনি জীবনের শেষ ছয়টি বছর কাটিয়ে মারা যান। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট মতে, তিনি পাকস্থলীর ক্যান্সারে মারা যান। তবে সুইডেনের দাঁতের চিকিৎসক ও বিষ বিশেষজ্ঞ স্টেন ফরশুফভুদ ও অন্যান্য বিজ্ঞানী বরাবর বলে আসছেন, নেপোলিয়নকে আর্সেনিক বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়।
স্টেন ফরশুফভুদ (১৯০৩-১৯৮৫) সূত্রায়ন করে গেছেন একটি বিতর্কিত তত্ত্ব। এ তত্ত্বের মতে, নেপোলিয়নের নির্বাসনের সময় তার সাথে থাকা কোনো সদস্য তাকে আর্সেনিক বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছে। তিনি ১৯৬১ সালে সুইস ভাষায় একটি বই লিখে গেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি তার ধারণা ইংরেজি ভাষায়ও রেখে গেছেন তার সহ-লেখক বেন উইডারকে নিয়ে যৌথভাবে লেখা এক বইয়ে।
ফরশুফভুদ ও বেন উইডার নেপোলিয়নের পাঁচটি চুল পরীক্ষা করে আর্সেনিকের অস্তিত্ব খুঁজে পান। এ পরীক্ষায় তার চুলে বিভিন্ন মাত্রার আর্সেনিক ধরা পড়ে। মোটামুটিভাবে এ মাত্রা গড় মাত্রার তুলনায় ২৮ গুণ বেশি ছিল। এর অন্তর্নিহিত অর্থ নেপোলিয়নের ওপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘনমাত্রার আর্সেনিক প্রয়োগ করা হয়েছে। আর এ বিষ প্রয়োগের কাজটি শুরু হয় মৃত্যুর কমপক্ষে পাঁচ বছর আগে। স্টেন ফরশুফভুদের এ তত্ত্ব নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক দেখা দেয়। কেননা তিনি যে চুল পরীক্ষা করেছেন তা নিশ্চিতভাবে তারিখাঙ্কিত ছিল না। তা ছাড়া এ চুল নেপোলিয়নেরই, এমনটিও সুপ্রমাণিত ছিল না। তা সত্ত্বেও ফরশুফভুদের পরীক্ষা করা সব নমুনা চুল আর নেপোলিয়নের বংশানুক্রমে ব্যবহার করা আসবাবপত্রে পাওয়া চুলের নমুনা একই। তা ছাড়া অন্যান্য চুলের নমুনাগুলোও ছিল একই ধরনের। চুলের এ নমুনাগুলো সম্ভবত নেপোলিয়নের অনুগত স্টাফদের দেয়া। অনেক নমুনা চুল ফরশুফভুদের হাত দিয়ে যায়নি, বরং এগুলো সরাসরি স্কটল্যান্ডের টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছিল। অনেকেই সমর্থন করে ফরশুফভুদের তত্ত্ব। ফরশুফভুদ ও বেন উইডারের অভিমত, নেপোলিয়নকে হত্যা করে একজন ফরাসি, যিনি নেপোলিয়নের নির্বাসনের সময়ে তার স্টাফ হিসেবে কাজ করতেন। এই ফরাসি তার প্রতি বিরক্ত হয়ে কাজটি করেন। ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ আজ নেপোলিয়নকে শ্রদ্ধা করে, সে দেশের একজন মহান বীর হিসেবে। সে জন্য তিনি ফরাসি স্টাফের হাতে তার মারা যাওয়ার বিষয়টিও ফরাসি জনগণের কাছে বিতর্কিতই রয়ে গেছে।
নেপোলিয়ন ছিলেন অন্য ধরনের এক মানুষ। তিনি হতে পারতেন উৎফুল্ল, বিমর্ষ, নিষ্ঠুর, উদার ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন। কখনো মানতেন, কখনো মানতেন না কোনো যুক্তি। তিনি যুদ্ধ করেছেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে, আবার প্রশংসাও করেছেন ইংরেজদের। তিনি সারা ইউরোপে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন বৈপ্লবিক ধারণা। সুসংহত করেছেন ফরাসি বিপ্লবের চেতনা। সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাজুড়ে। আবার এর আট লাখ বর্গমাইল এলাকা ছেড়ে দিয়েছেন থমাস জেফারসনের কাছে, মাত্র একরপ্রতি ৬ সেন্টের বিনিময়ে। এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল যার পেইন্টিং আর মূর্তি, সেই মানুষটির সাধারণ মৃত্যু কল্পনা করা যায় কি! সে জন্যই তার মৃত্যু নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা অগ্রহণযোগ্য ইতিহাস ও ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব। আসলেই তিনি কি ক্যান্সারে মারা যান? তাকে কি বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল? যদি তা-ই হয়, তবে কে তাকে হত্যা করল? ১৮২১ সালে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে যিনি মারা গেলেন, তিনি কি নেপোলিয়ন? না, সে দিন কোনো ব্যক্তিই মারা যায়নি? যদি তা হয়, তবে নেপোলিয়নের ভাগ্যে কী ঘটেছিল?
এ নাটকের চরিত্রগুলোও আকর্ষণীয়। তার এক বিশ্বস্ত ভৃত্য ছিল। তার প্রভু সম্পর্কে তার স্মৃতিকথা ১৯৫০-এর দশকের আগে ছাপা হয়নি। তার নিয়োজিত বিভিন্ন ধরনের অনুগত ক’জন পোষ্য ব্যক্তি ছিল। কারো কারো মতে, এরা ছিল প্রতারক চরিত্রের। বিশেষ করে এদের মধ্যে চারজন ছিল ষড়যন্ত্রকারী। অনেক সময় এ নাটকের অনেক দৃশ্যে আগমন-প্রস্থান ঘটেছে অনেক চিকিৎসকের। তার প্রহরীদের মধ্যে সব সময় এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করত কখন জানি তিনি পালিয়ে যান। কারণ, এর আগে তিনি পালিয়েছিলেন এলবা দ্বীপ থেকে। এমনকি দুয়েকজন মহিলাও এসে যোগ হয়েছেন এ কাহিনীতে। এ ঘটনার এক শ’ বছরেরও পর এলেন একজন উৎসুক ডাক্তার, একজন ব্যায়ামের সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক এবং অনেক ইতিহাসবিদ। সব কিছু ছাড়িয়ে আছে নেপোলিয়নক নিয়ে প্রচুর লেখালেখি। লাখ লাখ বই। এসবে বর্ণিত হয়েছে নেপোলিয়নের জীবন ও কর্র্ম। কেউ কেউ বলেন যিশু ছাড়া আর কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে এত লেখালেখি হয়নি। বিষয়টি স্পষ্ট হয়তো নেপোলিয়ন স্বাভাবিকভাবে মারা গেছেন, নয়তো হত্যার শিকার হয়েছেন। বিয়রটি খতিয়ে দেখা যাক।
নির্বাসন:
১৮১৫ সালের ওয়াটারলুর যুদ্ধে ডিউক অব ওয়েলিংটন পরাজিত করেন নেপোলিয়নকে। এর মধ্য দিয়েই পরিসমাপ্তি ঘটে নেপোলিয়নের সম্রাট-জীবন, সেই সাথে তার তুখোড় সামরিক জীবন। তার এ পরাজয়ের মাধ্যমে বোরবন বংশ ফিরে আসে ফ্রান্সের শাসনক্ষমতায়। তখন নেপোলিয়ন সামনে আসে কয়েকটি বিকল্প। ওয়াটারলুর যুদ্ধে হেরে নেপোলিয়নের সামনে করণীয় সীমিত হয়ে পড়ে। তিনি গভীরভাবে চিন্তা করেছিলেন আমেরিকায় পালিয়ে যেতে। এর আগে তার বড় ভাই জোসেফ পালিয়ে আমেরিকা চলে যান। আবার ভাবেন ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করে সাবেক শত্রুদেশ ইংল্যান্ডে সম্মানিত অতিথি ‘ইংলিশ কান্ট্রি স্কোয়াইর’ হিসেবে বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিতে। বোকার মতো তিনি দ্বিতীয় পথটিই বেছে নেন। ব্রিটিশদের মাটিতে পা রাখার কোনো সুযোগ তার হয়নি। তাকে আটক রাখা হয় পোর্টসমাউথ উপকূলে। এবং সেখান থেকে বন্দী হিসেবে পাঠিয়ে দেয়া হয় সেন্ট হেলেনা দ্বীপে। সেখানে তাকে রাখা হয় লংউড হাউসে। এটি ছিল একটি পুনর্গঠিত জীর্ণ কৃষিভবন। সেখানে নির্বাসনে যাওয়ার সময় তার বয়স ৪৭। নেপোলিয়ন সাথে করে সেন্ট হেলেনায় নিয়ে যান একটা রেটিনিউ, অর্থাৎ অনুচর লোকলষ্করের একটি দল। তার রাজকীয় অনুসারীদের মধ্যে বিশেষত ছয়জন ছিলেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ছয়জনের তিনজন তার পুরো নির্বাসন সময়ে (১৮১৫-১৮২১) তার সাথেই ছিলেন। এরা ছিলেন : তার অনুগত ভৃত্য লুই মার্চান্ড, তার গ্র্যান্ড মার্শাল হেনরি বার্ট্রান্ড এবং তার প্রিন্সিপাল অ্যাডভাইজার কাউন্ট চার্লস ডিমনথলন। বার্ট্রান্ড ও ডিমনথলনের স্ত্রীরাও তাদের সাথে ছিলেন।
মার্চান্ড,বার্ট্রান্ড ও ডিমনথলনের ছবি দেখে বোঝা যায় এরা ছিলেন সুদেহী। বার্ট্রান্ড ও ডিমনথলন ছিলেন অসাধারণ সুন্দর। বাকি তিন উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ চাকর ছিলেন ফ্র্যানসিস্কি চিপরিয়ানি, নেপোলিয়নের সব কাজের কাজী ইমানুয়েল ল্যাসক্যাসেস এবং তার লিটারারি অ্যাডভাইজার গ্যাসপার্ড গোরগার্ড। নির্বাসনের সময়ে সাথে গিয়েছিলেন বেশ ক’জন ডাক্তারও। এর মধ্যে গুরুত্বক্রমে কয়জন হলেন : ব্যারি ওমিয়ারা, ফ্রানসিস্কো অ্যান্টোমার্কি ও আলেক্সান্ডার আর্নট। এসব চরিত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাদের কাছে নেপোলিয়নের নির্বাসন ও মৃত্যু সম্পর্কিত রেকর্ড আছে। এদের চারজন মার্চান্ড, বার্ট্রান্ড, ওমিয়ারা ও ডি মনথলন লিখে গেছেন তাদের বিস্তারিত স্মৃতিকথা। অন্যদের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি নানা দলিলপত্র, চিঠিপত্র, রিপোর্ট ও নানা পর্যবেক্ষণ। আমরা যদি ধরে নিই নেপোলিয়নের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি, তবে এদের মধ্য থেকেই আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে কে নেপোলিয়নের খুনি। আর তাদের পাশে তো নাম আসবেই সেন্ট হেলেনার গভর্নর ও নেপোলিয়নের জেলর স্যার হাডসন লাউই’র।
মৃত্যু-পূর্ব ঘটনাবলি:
১৮২০ সালের শরৎকাল। নেপোলিয়নের স্বাস্থ্য ভলো যাচ্ছে না। পেটে প্রচণ্ড ব্যথা। শরীর দুর্বল। সাথে বমি বমি ভাব। মনে হলো, তিনি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছেন। নেপোলিয়নের চিকিৎসকেরা যখন হাডসন লাউই’র কাছে এ কথা জানান তখন হাডসন তা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, এসব ইংরেজদের অপপ্রচার। দু’জন চিকিৎক অবশ্য বলেছিলেন, নেপোলিয়ন হেপাটাইটিসে আক্রান্ত, সেই সাথে আছে আমাশয়। হাডসন সে কথাও কানে তোলেননি।
এর আগে ১৮১৯ সালে নেপোলিয়নের বিশ্বস্ত অনুসারী চিপরিয়ানি কর্সিকান অসুস্থ হয়ে মারা যান। একইভাবে মারা যান লংউড হাউসের আরো দুই ভৃত্য। পরিস্থিতি ছিল রহস্যজনক। দ্রুত এই তিনজনের অসুস্থ হয়ে পড়া ও মারা যাওয়ায় মনে করা হয় তাদের ওপরও বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। নেপোলিয়ন আভাস দিয়েছিলেন, তিনিও এমনটি সন্দেহ করছেন। এবং তিনি আশঙ্কা করছেন, তিনি হতে পারেন এদের টার্গেট। ১৮২১ সালে নেপোলিয়নের স্বাস্থ্যের আরো অবনতি ঘটে। এবং মাসজুড়ে প্রচণ্ড পেটব্যথায় ভুগে ৫ এপ্রিল মারা যান। লাশের ময়নাতদন্ত করেন ডাক্তার অ্যান্টোমার্কি ও আরো পাঁচ ইংরেজ ডাক্তার। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, তার মৃত্যু পাকস্থলীর ক্যান্সারে। তার বাবাও ১৭৮৫ কালে একই রোগে মারা যান। তখন কিছু দ্বান্দ্বিক পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করা হয়। বিশেষ করে তার লিভারের আকার ও অবস্থা নিয়ে বিতর্ক ওঠে। একজন ইংরেজ ডাক্তার বললেন, তার মৃত্যু হেপাটাইটিস-সহ পেটের অসুখে। কিন্তু ময়নাতদন্ত রিপোর্টের অংশবিশেষ হাডসন লাউই মুছে ফেলেন। নেপোলিয়নের শরীরে তুলনামূলক কম লোম ও তার নারীদের মতো নরম দেহের বিষয়টিও রিপোর্টে উল্লিখিত হয়।
মৃত্যুর পরদিন ইংলিশ গ্যারিসন পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় লংউডের অদূরে একটি কবরে নেপোলিয়নকে সমাহিত করে। তাকে রাখা হয় চারটি কফিনে। একটি মেহগনি কাঠের কফিনে রাখা হয় তার লাশ।
এ কফিনটি রাখা হয় আরেকটি মেহগনির কফিনে। এ দু’টি কফিন রাখা হয় আরেকটি সিসার কফিনে। এরপর এই তিনটি কফিন পুরে দেয়া হয় অন্য আরেকটি সিসার কফিনে। এমনকি কবর থেকেও যেন পালাতে না পারে। কবরে পাশে কোনো হেডস্টোন স্থাপন করা হয়নি। কারণ তার পরিবার চায়নি তিনি শুধু নেপোলিয়ন বোনাপার্ট নামে পরিচিত হোন। আর লাউই রাজি হননি তার হেডস্টোনে ‘এম্পারার নেপোলিয়ন’ কথা লেখা থাকুক। এর ১৯ বছর পর ১৮৪০ সালে নেপোলিয়নের কবর খোলা হলো। এ সময় সেখানে ছিলেন এমন কয়েকজন, যারা তার সাথে নির্বাসনে ছিলেন। দেখা গেল, তার দেহ অবিশ্বাস্যভাবে সংরক্ষিত। কফিনের খিলগুলো আবার বন্ধ করে দেয়া হলো। নেপোলিয়নের লাশ ফিরিয়ে নেয়া হলো প্যারিসে। সেখানে তার লাশ রাখা হলো গির্জার সুরম্য এক গম্বুজের নিচে। সেটি আজ পরিচিত ‘নেপোলিয়ন টম্ব’ নামে। তার লাশ আজো সেখানেই আছে। সেটি আজ পর্যটকদের এক আকর্ষণে পরিণত।
মৃত্যুর কারণ কোন রোগ?
কিছু কর্তৃপক্ষ এটি মেনে নিয়েছে যে, নেপোলিয়ন ক্যান্সারে মারা গেছেন। ২০০৩ সালে ফ্রান্সের কিছু জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত লেখায় নানা সমীক্ষার কথা উল্লেখ করে এ কথা বলা হয়। তবে সবাই তা মেনে নেয়নি। তার মতো আর কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের মেডিক্যাল রিপোর্ট এতটা খতিয়ে দেখা হয়নি। বলা হয়, নেপোলিয়ন নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে তিনি শিকার হয়েছিলেন হেমোরয়েডসের। পাঁচড়া ছাড়াও তার ছিল দীর্ঘমেয়াদি চর্মরোগ নিউরোডারমিটিটিস, রেগে যাওয়ার রোগ, মাইগ্রেন ও প্রস্রাবের জ্বালা সৃষ্টিকারী রোগ ডাইসুরিয়া। ১৯৬৬ সালে একটি মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত এক লেখায় উল্লেখ করা হয়, এসব রোগের জের হিসেবে তিনি প্যারাসাইটিক রোগ সিসটোসোমিয়াসিসে ভুগছিলেন। ১৭৯৮ সালে মিসর অভিযানের সময় তার এ রোগ দেখা দেয়। এসব রোগের পর বিষ প্রয়োগের তত্ত্ব তো আছেই।
খুনের সাক্ষ্যপ্রমাণ:
নেপোলিয়নের সাথে ১৮১৫ থেকে ১৮২১ সাল পর্যন্ত পুরো কিংবা আংশিক সময়ে সেন্ট হেলেনাতে অনেকেই ছিলেন। তাদের কয়েকজন স্মৃতিকথা লিখে গেছেন। তার শেষ জীবনের পরিপূর্ণ একটা রেকর্ড পাই ভৃত্য মার্চান্ডের কাছে। নেপোলিয়নের মৃত্যু উপাখ্যানে তার এ রেকর্ড সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মার্চান্ডের স্মৃতিকথা ১৯৫৫ সালের আগে ছাপা হয়নি। সে বছর একজন দাঁতের চিকিৎসক, শৌখিন বিষ বিশেষজ্ঞ ও নেপোলিয়নের বিষয়ে আত্মত্যাগী সংগ্রাহক ফরশুফভুদ আসেন আলোচ্য মৃত্যু নিয়ে, নতুন বিতর্কিত দাবি নিয়ে : নেপোলিয়নকে আর্সেনিক বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। তিনি সুসমন্বিতভাবে আর্সেনিক প্রয়োগের বিষয়গুলোকে সংশ্লিষ্ট করেন। তিনি দেখান নেপোলিয়নের চুলে আর্সেনিকের মাত্রা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। তার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে, কয়েক বছর ধরে তার দেহে আর্সেনিক প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর তার সাথে যোগ দেন আরো অনেকেই।
খুনতত্ত্ব:
নেপোলিয়নের দেহে যদি আর্সেনিক প্রয়োগ করা হয়েই থাকে, তবে কে এই বিষ প্রয়োগ করেছিল? আর তার উদ্দেশ্যই বা কী ছিল? একটা বিষয় স্পষ্ট। খুনি যেই হোন, তিনি নেপোলিয়নের পুরো বন্দীত্বের সময়ে সেন্ট হেলেনাতেই ছিলেন। তাহলে খুনির তালিকা থেকে বাদ পড়েন ইমানুয়েল লেসক্যাসেস, তিনি সেন্ট হেলেনা ছাড়েন ১৮১৮ সালে। এর পরের বছর চলে যান জেনারেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্র্যাঙ্কি গোরগার্ড। অতএব তার নামটিও একই কারণে বাদ পড়ে। যেহেতু নেপোলিয়নকে দেখাশোনার জন্য এক ডাক্তার আসতেন আরেকজন যেতেন, অতএব তাদের কোনো একজনকে খুনি বিবেচনা করা যায় না।
এর পর অবশেষে থাকে দু’টি সম্ভাবনা : হাডসন কিংবা নেপোলিয়নের ঘরের কেউ। প্রথম সম্ভাবনা বাস্তব নয়। হাডসন লাউই জেলরের দায়িত্ব বহন করছিলেন। তিনি বার বার চেষ্টা করেছেন ইংরেজদের ঘাড়ে এমন বদনাম যেন না আসে যে, ইংরেজেরা এই বিখ্যাত বন্দিব্যক্তিত্বের প্রতি খারাপ আচরণ করছে। তা ছাড়া ইংরেজেরা ও ইউরোপীয়রা চায়নি নেপোলিয়নের খুনি হিসেবে পরিচিত হতে। তা ছাড়া নেপোলিয়নের কাছে পৌঁছাও ছিল কঠিন। ১৯১৬ সালের পর স্বল্পবাক হাডসন কখনোই নেপোলিয়নের সাথে দেখা পর্যন্ত করেননি। যে ইংলিশ গ্যারিসন নেপোলিয়নের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল, তারাও খুব কমই তার সাক্ষাতে আসত।
তা হলে নেপোলিয়নের ঘরের কেউ তাকে খুন করার প্রশ্ন আসে। শেষ দিন পর্যন্ত তার সাথে ছিলেন চার ব্যক্তি। প্রথমত, তার অনুগত বিশ্বস্ত ভৃত্য মার্চান্ডকে খুনি ভাবা কঠিন। এরপর সেখানে ছিল বার্ট্রান্ড, গ্র্যান্ড মার্শাল ও তার স্ত্রী। তার স্ত্রী থাকতেন লংউড থেকে এক মাইল দূরে। তখন অবশেষ সম্ভাবনা থাকে কাউন্টেস ডি মনথলন খুনি হওয়ার। ১৮১৯ সালে কাউন্টেস ডি মনথলন তার নবজাতক কন্যা নেপোলিয়ানাকে নিয়ে সেন্ট হেলেনা ছেড়ে যান। কেউ কেউ মনে করেন নেপোলিয়নই নেপোলিয়ানার বাবা।
নেপোলিয়ন টম্বের নিচে কার লাশ?
একটা ধারণা আছে, নেপোলিয়ন ১৮২১ সালের ৫ এপ্রিল মারা যাননি। তিনি সেন্ট হেলেনা থেকে পালিয়ে গেছেন। ধারণাটা অদ্ভুত শোনায়। যেমনটি অদ্ভুত শোনায় হিটলার বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন আর্জেন্টিনার পর্বতাঞ্চলে বললে। বেশ কিছু লেখক, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য থমাস হুইলার অভিমত দিয়েছেন, সেন্ট হেলেনায় বন্দী থাকার প্রথম দিকের বছরগুলোতে নেপোলিয়নের জায়গায় আনা হয় আরেকটি দ্বৈতচরিত্র। হুইলারের বিশ্লেষণ মতে, সার্জেন্ট পিয়েরে রোবিয়াউডকে আনা হয় নেপোলিয়নের জায়গায়। অন্যত্র তিনি পরিচিত ফ্রাঙ্কো ইউজেনি রোনিয়াউডভ নামে। তিনিই সেন্ট হেলেনায় ক্যান্সারে মারা যান। তার লাশই এখন সমাহিত আছে নেপোলিয়নের টম্বে।
এক খুনির প্রতিকৃতি:
১৮৪০ সালের অক্টোবরের দিকে নেপোলিয়নবাদীরা রাজা লুই ফিলিপকে চাপ দেয় সেন্ট হেলেনা থেকে তাদের বীরদের দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য। বিক্ষোভকারীদের চাপে পড়ে লুই ফিলিপ নেপোলিয়নের নির্বাসনের সাথীদের একটি প্রতিনিধিদল পাঠায় সেন্ট হেলেনা থেকে লাশ ফেরত আনার জন্য। এদের মধ্যে যারা জীবিত ও চলনক্ষম ছিলেন তারা এ প্রতিনিধিদলের সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। একমাত্র কাউন্ট ডি মনথলন এ প্রতিনিধিদলের সদস্য হতে পারেননি। ৬৭ বছর বয়সী বার্ট্রান্ডও সে সফরে ছিলেন। তার স্ত্রী ফ্যানি মারা যান ১৮৩৬ সালে। লেসক্যাসেস তখন বৃদ্ধ ও অন্ধ। তার প্রতিনিধিত্ব করেন তার পুত্র ইমানুয়েল, যিনি বালক বয়সে বাবার সাথে লংউডে ছিলেন। চিকিৎসক ব্যারি ওমিয়ারা ও ফ্রানসিসকো অ্যানটোমার্কি কয়েক বছর আগে মারা যাওয়ায় যেতে পারেননি। মধ্যবয়সী বিশ্বস্ত লুই এ প্রতিনিধিদলে ছিলেন। কাউন্ট ডি মনথলরন সে সময়ে জেলে থাকায় যেতে পারেননি।
নেপোলিয়নবিষয়ক শীর্ষস্থানীয় ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ ড. ডেভিড চ্যান্ডলার জোর দিয়ে বলেছেন, ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নকে খুন করেছেন তার স্বদেশী কাউন্ট ডি মনথলন। তিনি এ ব্যাপারে ৯৯.৯৯ শতাংশ নিশ্চিত বলে ঘোষণা দেন। তার মতে, সেন্ট হেলেনায় নেপোলিয়নের নির্বাসনে যাওয়া আর মৃত্যুর মধ্যবর্তী ছয় বছর সময়ে ধারাবাহিকভাবে তার ওপর আর্সেনিক প্রয়োগ করেছেন কাউন্ট চার্লস ডি মনথলন। তাকে এ নির্বাসন দ্বীপে মনে করা হতো নেপোলিয়নের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু আসলে তিনি কাজ করছিলেন ফরাসি রয়েলিস্টদের আদেশ-নির্দেশে। ফরাসি রাজতন্ত্রীদের ভয় ছিল নেপোলিয়ন আবার ফ্রান্সে ফিরে এসে আরেক বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবে। তার যোগাযোগ ছিল ফরাসি রাজা দশম চার্লসের সাথে। ফরশুফভুদ ও উইডারের মতে, মনথলন তার কাছ থেকেই নেপোলিয়নকে খুন করার আদেশ পেয়েছিলেন। কিন্তু তার এ গোপন যোগাযোগ কোনো কাজে আসেনি। কারণ এই প্রতারক রাজা ১৮৩০ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন।
১৮৪০ সালের প্রথম দিকে রাজা লুই ফিলিপ নেপোলিয়নের লাশ প্যারিসে ফিরিয়ে আনবেন কী আনবেন না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ভাবছিলেন। ডি মনথলন তখন সংযুক্ত ছিলেন লুই বোনাপার্টের সাথে। লই বোনাপার্টেরই তৃতীয় নেপোলিয়ন হওয়ার কথা। তখন ডি মনথলন তার ইংল্যান্ডের ঘাঁটি থেকে ফ্রান্স আক্রমণের উদ্যোগ নেন। ডি মনথলনের বেশির ভাগ উদ্যোগের মতো এটিও ব্যর্থ হয়। ফ্রান্সের রাজকীয় বাহিনীর হাতে তিনি বন্দী হন। রাজা লুই সরকার তাকে ২০ বছরের শাস্তি দিয়ে কারাগারে পাঠায়। সেন্ট হেলেনায় নির্বাসিতেরা যখন পুনর্মিলনী উৎসবে যোগ দেন, তখন ডি মনথলন তার সাজার মেয়াদ শুরু করেন।
১৮৫০ সালে নেপোলিয়নের ভাইয়ের ছেলে লুই বোনাপার্ট হন তৃতীয় নেপোলিয়ন। অবশ্য বিখ্যাত নেপোলিয়নের ছেলে ছিলেন দ্বিতীয় নেপোলিয়ন। কিন্তু তিনি মাত্র ২১ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে ১৮৩২ সালে মারা যান। ডি মনথলন কখেনা ভালো কখনো খারাপ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছিলেন বোনাপার্ট পরিবারের সাথে। তবে তার স্থান হয়নি তৃতীয় নেপোলিয়নের সরকারে। নির্ধারিত ২০ বছর সাজার ছয় বছর ভোগের পর ডি মনথলন বৈশিষ্ট্যহীনভাবে অনেকটা নীরবে মারা যান ১৮৫৩ সালে।
নেপোলিয়ন খুন হয়েছিলেন কি না, তিনি তার খুনি ছিলেন কি না, এ সম্পর্কে তিনি কিছুই বলে যাননি। তার স্মৃতিকথায় এ ব্যাপারে কোনো উল্লেখ নেই, আভাস-ইঙ্গিত নেই। তার স্ত্রীর স্মৃতিচারণে উল্লেখ আছে, তার স্বামীর এ সম্পর্কিত কোনো পরিকল্পনার কথা তিনি জানেন না। অন্য যারা এ সম্পর্কিত স্মৃতিকথা লিখে গেছেন, তারাও ডি মনথলনকে খুনি চিহ্নিত করে কিছু বলেননি। যদি ডি মনথলন নেপোলিয়নের খুনি হিসেবে কোনো লেগ্যাসি রেখে গিয়ে থাকেন, তবে তিনি হবেন ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত খুনি। আর কারো কারো মতে, তিনি হবেন ইউরোপীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র।
নেপোলিয়নকে নিয়ে লেখালেখি:
এক হিসাব মতে, বিভিন্ন ভাষায় নেপোলিয়নকে নিয়ে কমপক্ষে পাঁচ লাখ বই লেখা হয়েছে। কম করে বললেও বলতে হয়, ১৮২১ সালে নেপোলিয়নের মৃত্যুর পর প্রতি বছর নেপোলিয়নের ওপর এক হাজার ৪০০ করে বই বের হচ্ছে। আর অন্য অর্থে গড়ে প্রতিদিন বের হচ্ছে চারটি করে বই। নেপোলিয়নের নির্বাসনের ওপর রয়েছে ২৫ হাজার বই। এর পাঁচ ভাগের এক ভাগ বইও যদি ইংরেজিতে লেখা হয়ে থাকে, তবে তার ওপর ইংরেজি বই রয়েছে পাঁচ হাজার।
নেপোলিয়নকে নিয়ে লেখা অগুণতি বইয়ের মধ্যে আছে সেন্ট হেলেনার নির্বাসন সময়ে সেখানে থাকা তার চার ঘনিষ্ঠ স্টাফ বার্ট্রান্ড, মনথলন, লেসক্যাসাস ও গোরগার্ডের লেখা বই। আছে তার প্রধান এক ভৃত্য মার্চান্ড। এসব স্মৃতিকথার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কিছু আধুনিক বই বিষ প্রয়োগে নেপোলিয়নকে হত্যা করার ধারণা থেকে লেখা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে যেসব লেখকের বই উল্লেখযোগ্য তারা হচ্ছেন ফরশুফভুদ (১৯৬১, ১৯৯৫), উইডার (১৯৮২, ১৯৯৫)। আরো কয়েকটি বই রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে নেপোলিয়ন ১৯২১ সালের ৫ মে মারা যাননি। এ ছাড়া কিছু বইয়ে সেন্ট হেলেনায় তার নির্বাসন জীবনের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে আনা হয়েছে। এসব লেখকের মধ্যে আছেন কাউফম্যান (১৯৯৯) ও গিলস (২০০১)।
অবশ্য যে কারোরই উচিত নেপোলিয়নের পূর্ণ জীবনী পড়া। সাম্প্রতিক এমনি দু’টি বই লিখেছেন স্কম (১৯৯৭) ও ম্যাকলিন। স্কমের অভিমত, নেপোলিয়ন নিশ্চয়ই স্বাভাবিকভাবে মারা যান। আর ম্যাকলিন বলছেন নিশ্চিতভাবেই বিষ প্রয়োগে নেপোলিয়নকে হত্যা করা হয়েছে। নেপোলিয়নকে নিয়ে লেখা অনেক বই-ই উপন্যাসসম। কিন্তু তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস একটি গুরুত্বপূর্ণ বই।
তথ্য সূত্র:
1.https://www.dailynayadiganta.com/
2.https://hindi.indiawaterportal.org/
3.https://bn.wikipedia.org/wiki/
4.https://www.dailynayadiganta.com/